প্রচেষ্টা................
হাল আমলের বাংলাদেশ নিয়ে কিছু ভালো কথা বলার আছে। আবার সেসব ছাপিয়ে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেওয়ার মতো নানা ঘটনাও ঘটছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারের কয়েকটি শুভ উদ্যোগের মধ্যে আছে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক পেঁৗছে দেওয়া, কৃষিকাজে সরকারের দেওয়া সেবা বিশেষ করে সারের ভর্তুকি পাওয়ার জন্য কৃষক পরিচিতি কার্ড দেওয়া, খুবই দরিদ্ররা যাতে ন্যায্যমূল্যে বা স্বল্পমূল্যে সরকারি ব্যবস্থায় চাল-গম পায় সে জন্য একধরনের রেশন কার্ড পুনঃপ্রবর্তন করা, গার্মেন্ট শ্রমিকদের ভর্তুকি দেওয়া দামে চাল সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা, বোরো ধান চাষের জন্য পানি সেচের যন্ত্র চালু রাখতে শহরে লোডশেডিং করে হলেও গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং স্কুল পর্যায়ে দেশজুড়ে কয়েকটি প্রান্তিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। এ পদক্ষেপগুলো সামগ্রিকভাবে, অর্থাৎ সবগুলো যোগ করলে দেশের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের জীবন স্পর্শ করবে। তাই বলা যায়, এগুলো জনহিতকর কাজ।
সরকার কিছু নদীর নাব্য পুনরুদ্ধারের জন্য বড় মাপে ড্রেজিং করার কাজে হাত দিয়েছে। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমানের জন্য প্লেন লিজ নিয়েছে। ঢাকা-নিউইয়র্ক পথে বাংলাদেশ বিমান আবার চলছে। এ প্রতিষ্ঠানের ঢাকা-লন্ডন সরাসরি ফ্লাইট আবার শুরু হয়েছে।
এসব কাজ সরকারের কর্মকাণ্ডে কিছু গতিময়তার লক্ষণ। নদী বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের দেশ সমতল হওয়ায় এখানে এসে বেশির ভাগ নদীর গতিবেগ ও স্রোতধারা এমন হয়ে যায় যে, তাতে নদীতে পলি পড়ার মাত্রা বেড়ে যায়। আর সে জন্যই ড্রেজিং করে ভরে-ওঠা নদীর মূলধারার গভীরতা বাড়ানো হলেও সেটা ধরে রাখা খুব কঠিন। কারণ প্রতি বছরই নতুন করে পলি পড়ে। তাই প্রথমবারের পরও বছর বছর ড্রেজিং চালিয়ে যেতে হবে।
এতে সব প্রক্রিয়াটা হয়ে যায় ব্যয়সাপেক্ষ। তবুও ড্রেজিং করে যদি নৌপথগুলো চালু রাখা যায়, সেচের খালগুলোয় পানি পেঁৗছে দেওয়া যায়, তাহলে যে অর্থনৈতিক উপকার পাওয়া যাবে তার দরুন ওই খরচকে যুক্তিসংগত বিনিয়োগ হিসেবে ধরা যাবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনামূল্যে পাঠ্যবই দিতে পারাটা বড় কাজ, কিন্তু একই রকম বড় কর্তব্য হচ্ছে শিক্ষার মান বাড়ানো। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়া অনেক ছেলেমেয়ে তাদের কর্মক্ষেত্রেরও অনেক বিষয়কে ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারে না। প্রায়ই আংশিক তথ্য দেয়।
প্রয়োজনীয় সব তথ্য জানতে চাইলে স্বীকার করে যে তা তার জানা নেই অথবা চরম বিরক্তি প্রকাশ করে। কিন্তু আমাদের যদি উন্নতি করতে হয়, ডিজিটাল যুগে ঢুকে তার সবটা সুবিধা নিতে হয়, তাহলে আমাদের যুবক-যুবতীদের লেখাপড়া এমন মানের হতে হবে, যাতে যেকোনো বিষয় সার্বিকভাবে উপলব্ধি করার এবং পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করার ক্ষমতা তারা অর্জন করতে পারে। মানুষের জ্ঞানের পরিধি যেমন বিস্তৃত হচ্ছে, ঠিক তেমনই জানার প্রয়োজন বাড়ছে অথচ সময়ের পরিমাণ যতখানি ছিল ততখানিই থাকছে। ফলে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করার চাপ বাড়ছে। এই চাপ মোকাবিলা করে কাজ করতে হলে যিনি কাজ করবেন তার মৌলিক শিক্ষার মান বাড়াতেই হবে।
তার প্রস্তুতি কি আমরা নিচ্ছি! ভর্তুকি দিয়ে শ্রমিকদের বা অতিদরিদ্রদের চাল সরবরাহ করায় নিশ্চয়ই প্রাপকের খেয়ে বাঁচার ব্যবস্থা নিশ্চিত হচ্ছে এবং এটা বড় কথা। তবু বিপদ হলো, জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয় যদি অতিরিক্ত বেড়ে যায়, যেমন- ভাতের সঙ্গে যে তরকারি_তার সবজির দাম, চুলা জ্বালানোর খরচ, বস্তির ঘর ভাড়া বা যাতায়াতের খরচ, যেমন- বাস ভাড়া এবং অসুখ হলে চিকিৎসার খরচ, নূ্যনতম পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য সাবান-মাজনের দাম প্রভৃতি, তাহলে ওই চালের ভর্তুকি থেকে সে স্থায়ী অথবা খুব বেশি উপকার পাবে না। এ পরিস্থিতিতে জরুরি হয়ে পড়বে মানুষের আয় বাড়ানো। এখানে এই উদাহরণগুলো দিলাম এ কথা বোঝানোর জন্য, বর্তমান সরকারের যেসব কাজ ভালো বলে উল্লেখ করেছি, সেগুলোর প্রকৃত মূল্য যাচাই হবে আজ থেকে এক বছর বা দুই বছর বা পাঁচ বছর পর_এর থেকে কী ফল পাওয়া গেল তার ভিত্তিতে। অর্থাৎ এক দিনের বাহবা দেখে লোকে একটা সরকারের ভালো-মন্দ নির্ধারণ করে না বা করতে পারে না।
এখানে রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকেও কয়েক মুহূর্তের জন্য নজর দিই। এত দিন বলা হচ্ছিল, সবকয়টি সংসদীয় কমিটি তৈরি হয়ে যাওয়ায় সংসদ নামের প্রতিষ্ঠানটি বেশ কার্যকর হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে, সংসদীয় কমিটিগুলোর অধিকাংশ সুপারিশ বা অনুরোধ সরকার রক্ষা করছে না। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রী তাঁদের নিজ স্বার্থটি বাগিয়ে নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হতে দেননি। এভাবে যদি সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়, তাহলে মানুষ ওগুলোর দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকবে কেন? সংসদের বিরোধী দল তাদের অধিবেশন বর্জন স্থগিত করে সংসদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছে।
বলা চলে, তারা জনগণের চাপেই সংসদে ফিরে গেছে। এখন সংসদে যদি দেশ ও জাতির এ সময়ের বড় সমস্যাগুলো আলোচনার জন্য না তুলতে দেন স্পিকার অথবা সরকারি দল, তাহলে বিরোধী দল অধিবেশনে যোগ দিলেইবা জনগণের কী লাভ হলো? বরং এ রকম পরিস্থিতিতে বিরোধী দল জনগণকে বলতে পারবে, 'এই সরকার স্বৈরাচারী হয়ে গেছে। এই সরকার সংসদে জবাবদিহি করতে চায় না, জনগণের দুঃখ-বেদনার কথাও কানে তুলতে চায় না। ' কাজেই মানুষ যেন এখন রাজপথের আন্দোলনকেই দাবি আদায়ের ও সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা-জুলুমের জন্য উপযুক্ত পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেন। তাই সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসা এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি সপ্তাহে এক দিন সংসদ সদস্যদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই যে গণতন্ত্রকে সচল রাখা ও সবল করা এবং জাতীয় সংসদকে অর্থপূর্ণ করার জন্য একমাত্র করণীয় বা যথেষ্ট নয়_এটা সরকারকে বুঝতে হবে।
শুরুতেই বলছিলাম, এই সরকারের আমলে এমন সব ঘটনাও ঘটছে, যা অনেককে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। এসবের মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা অথবা উদাসীনতা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যেতে থাকা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নৈরাশ্যজনক হয়ে পড়া। গত বছরের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)-এর সদর দপ্তরে সৈনিকদের বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহীদের হাতে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭২ জন নিহত হওয়ার শিরদাঁড়া হিম করা, বেদনাদায়ক ও ঘৃণ্য ঘটনাবলি এখনো দেশবাসীর মনে তরতাজা স্মৃতি হয়ে বেঁচে রয়েছে। বিদ্রোহের বিচার কেবল শুরু হয়েছে। খুন, লাশ গায়েব করা, অগি্নসংযোগ, নারীদের শ্লীলতাহানি ও লুণ্ঠনের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার অদূর ভবিষ্যতে শুরু হবে।
আর এরই মধ্যে তিনটি প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এক. হত্যাযজ্ঞের মূল কারণ উদ্ঘাটন করা গেছে কি? দুই. বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের উসকানিদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের চেনা গেছে কি? তিন. এই ভয়ঙ্কর ঘটনা থেকে সরকার কোনো শিক্ষা নিয়েছে কি? প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে তদন্তকারীরা যখন আদালতে হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করবেন তখন। তবে তাঁদের অনুসন্ধানের ফল আদালতের বাইরে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না সেটা আলাদা কথা। কারণ ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে, বিদ্রোহের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যেমন- বর্তমান সরকারি দলের কে কে গত নির্বাচনের আগে থেকেই জেনে আসছিলেন, বিডিআর সৈনিকদের মধ্যে সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে আসা তাদের কমান্ডিং অফিসারদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ আছে, মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে 'ডাল-ভাত কর্মসূচি' নামে বিডিআরের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে চাল-ডাল বিক্রির প্রকল্প থেকে পাওয়া লাভের টাকা কোথায় গেল তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসারদের বিরুদ্ধে সন্দেহ আছে এবং বিডিআর সৈনিকদের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে না নেওয়ায় তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করছে।
তাঁরা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন একটা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে পারলেন না। অথবা বিডিআর সৈনিকরা বার্ষিক দরবারের তারিখের বেশ আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি রেখে আসা সত্ত্বেও এবং ২১ ফেব্রুয়ারি বিদ্রোহীদের লিফলেট সেনা কর্মকর্তাদের হস্তগত হওয়ার পরও কেন উত্তেজনা প্রশমন বা বিদ্রোহ এড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। আর বিডিআর বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপন্ন সেনা কর্মকর্তারা মোবাইল ফোনে কথা বলে বা এসএমএস করে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের, র্যাব ও পুলিশকে জানানো সত্ত্বেও বিদ্রোহীরা পিলখানার ভেতরে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করা ও ব্যাপকভাবে সংগঠিত হওয়ার আগেই এসব বাহিনী থেকে পিলখানার ভেতরে সশস্ত্র প্রতিরোধকারী বা বিদ্রোহ দমনকারী পাঠানো হলো না। এখানে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। যথা- বিদ্রোহীরা যখন বিদ্রোহ করার জন্য ব্যারাক থেকে বের হয় তখন তাদের কাছে অস্ত্র ছিল না।
তারা একটি ছোট দলে একটি অস্ত্রাগারে গিয়ে সেখানে কর্তব্যরত একমাত্র সেনা কর্মকর্তাকে বন্দি করে চাবি বের করে নিয়ে অস্ত্রাগার খোলে। তারপর অস্ত্র বিতরণ শুরু হয়। অর্থাৎ বিদ্রোহীরা অস্ত্র নিয়ে পিলখানার সব জায়গায় অবস্থান নিতে বেশ সময় লেগেছে। দুই. আক্রান্ত হওয়ার পরপরই র্যাবখ্যাত কর্নেল গুলজার এবং আরো কয়েক সেনা কর্মকর্তা সহকর্মীদের কাছে তাঁদের বাঁচানোর জন্য বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সম্ভবত এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাবের একটি সশস্ত্র দল বিডিআরের একটি ফটকে দ্রুত পেঁৗছে যায়; কিন্তু সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নির্দেশ না আসায় তাঁরা পিলখানার ভেতরে ঢুকতে পারেননি।
এ তথ্য দুটি বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ফৌজদারি আইনে বিচার হবে খুন ও অন্য যেসব অপরাধের, সেগুলোর তদন্তকর্তারা তো এসব বিষয় আমলে নেবেন না। তবে উপরোক্ত দুই তথ্যের সঙ্গে আমরা একটা মন্তব্য যোগ করতে চাই। সেটা হলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পিলখানায় সেনাবাহিনীর ঝটিকা অভিযান চালাতে দুই ঘণ্টা সময় লাগত বলে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য পদস্থ কেউ কেউ যে দাবি করেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা শুনেছি, বিমান বাহিনীর বৈমানিকরা যাতে মুহূর্তের হুকুমে জঙ্গিবিমান নিয়ে আকাশে উঠতে পারে সে জন্য 'ংপৎধসনষব' নামে একটি প্রক্রিয়া আছে।
রাজধানীতে রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধানকে (অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীকে) নিরাপত্তাদানের জন্য বা শত্রুর আক্রমণ থেকে রাজধানী রক্ষা করার জন্য সেনাবাহিনীরও এমন একটা ব্যবস্থা থাকতে হবে বলেই তো আমাদের মনে হয়। এ ছাড়া আমার বিশ্বাস করার কারণ আছে, সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিডিআরপ্রধানের নিবিড় যোগাযোগ থাকে। টিভি চ্যানেল এনটিভির জন্য একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে আমরা একবার বিডিআরের তৎকালীন প্রধান প্রয়াত মেজর জেনারেল শাকিলের সঙ্গে দেখা করে অনেকক্ষণ আলাপ করেছিলাম। তিনি রাজিও হয়েছিলেন; কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি বলেন, সেনাপ্রধানের সম্মতি নিয়ে তবেই তিনি আমাদের সাক্ষাৎকার দেবেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ তখন বিদেশ সফরে ছিলেন।
এ ঘটনায় আমার বিশ্বাস জন্মায়, বিডিআর এবং সেনাবাহিনীর কর্তৃপক্ষের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ থাকে। সে জন্য আমি এখনো বুঝে উঠতে পারি না, ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে কেন কোনো না কোনো সরকারি সশস্ত্র দল পিলখানায় বিদ্রোহীদের দমন করতে বা তাদের কোণঠাসা করে ফেলতে ঝটিকা আক্রমণ চালাতে পারল না। তবে এখনো দেশে যা ঘটছে তা বারবার মনে করিয়ে দেয়, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর জন্য প্রয়োজন রয়েছে জরুরি পরিস্থিতিতে জরুরিভাবে এগিয়ে আসার বন্দোবস্ত রাখার।
এখানে আজকে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, বিডিআর বিদ্রোহ থেকে সরকার নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য উন্নততর ব্যবস্থা নিতে কোনো শিক্ষা নিয়েছে কি না। এ বিষয়ে আমার গভীর সন্দেহ আছে।
পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে যে হাঙ্গামা ও ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটল সেটা তো হতে পেরেছে সরকারের তরফ থেকে সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায়। ওই এলাকা সীমান্তে একটি স্পর্শকাতর অঞ্চলে অবস্থিত। সেখানে মাসাধিককাল ধরে পাহাড়ি-বাঙালি উত্তেজনা চলছিল। যুগপৎ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে (এবং তা জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরেই) সেই উত্তেজনা দূর করা উচিত ছিল। একই সঙ্গে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি জোরদার করা অবশ্যই প্রয়োজন ছিল।
এখানে প্রশ্ন আসে, সরকার সেদিকে নজর দিল না কেন! বাঘাইছড়িতে শুক্র ও শনিবার সংঘর্ষ ও ঘরবাড়ি আগুনে পোড়ানোর প্রতিবাদে শনিবারই খাগড়াছড়িতে দু-দিন পর অবরোধ করার ডাক দেয় ইউপিডিএফ, যারা কাজকর্মে বেশ উগ্র। এই দু-দিনের মধ্যে কেন খাগড়াছড়ি শহরে ও তার আশপাশে সরকার (বিশেষত জেলা প্রশাসন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য এলাকাবিষয়ক মন্ত্রণালয়) যথেষ্ট শক্তিশালী নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা নিল না? সরকার কী করে একটা জেলা শহরে দিনদুপুরে এত ঘরবাড়ি পোড়াতে দিল? বর্তমান পরিস্থিতিতে পার্বত্য এলাকায় জনজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা ও আইন রক্ষা করা তো জাতীয় নিরাপত্তা-চিন্তার অন্তর্ভুক্ত বিষয় হওয়ার কথা! একইভাবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কিছু মফস্বল এলাকায় যেভাবে অহরহ আইনশৃঙ্খলাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে দেওয়া হচ্ছে তাতে মনে এমন একটা ছবি তৈরি হয়, দেশের অনেক জায়গায় জান-মাল-ইজ্জতের নিরাপত্তা নেই। এতে জনমনে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয় তা অভ্যন্তরীণ জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল করে। তা দুর্বলতর হয় যখন জনগণ দেখতে পায়, এটা করা হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় অবস্থিত লোকদের সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে।
দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে যখন আমরা ক্রমাগত অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ছি তার মধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে সরকার যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি বা জোটের কাছে (যার নাম দেওয়া হয়েছে সিন্ডিকেট) আত্দসমর্পণ করে বসে আছে।
অন্তত তিন-চারজন মন্ত্রীর সাম্প্রতিক উক্তি থেকে তেমনি মনে হয়। এই মন্ত্রীরা তাঁদের ইতিপূর্বেকার কর্মজীবনে সফল ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন। তাঁরা হাল ছেড়ে দিলে আসলেই বিপদের কথা। কারণ তাহলে আমরা সাধারণ মানুষ যাব কোথায়?
আর বলেছি মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা। দেশজুড়ে পুলিশের একটি দলের পক্ষ নিয়ে কাজকর্মের মাধ্যমে সেই লঙ্ঘন হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
সরকারি সুপারিশে প্রমাণিত মামলা তুলে নেওয়া আর নেহাতই সন্দেহের বসে বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের দিনের পর দিন হাজতে রাখা, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া, বিদেশ যেতে না দেওয়া, যা ইদানীং ঘটছে নিয়মিত আইনের শাসন ও মানবাধিকার_এই দুটোকেই বলতে গেলে ধ্বংসই করে ফেলেছে। আর কিছু না হোক, অন্ততপক্ষে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জেলে বন্দি অবস্থায় মৃত্যু ও অহেতুক রিমান্ডে নেওয়ার নজিরগুলো যদি একটু কমত তাহলেও আতঙ্ক কিছুটা দূর হতো।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[সূত্রঃ কালের কন্ঠ, ২৭/০২/১০]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।