আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিব্রত দৌড়ের বিবৃতি এবং বিস্কুটের আক্ষেপ (১৯৯৪-১৯৯৯)

আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে

৯৪ এ ইরান থেকে ফেরার পর দৌড়াদুড়িতে খানিক বিশ্রাম মিলল । লোকমুখে শোনা , বিশ্রাম পেলে মৃদুহাস্য বদনমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে , কিন্তু ইরানের মুক্ত প্রান্তর ছেড়ে আসা ঢাকার কংক্রিট আমার মত ১০ বছরের বালককে অষ্টপ্রহর নিরুদ্ধনিঃশ্বাস করে তুলল। মাসখানেক বাদে ভর্তিপরীক্ষা নামক মহারণে টিকে গিয়ে সফলভাবে জীবনে প্রথমবারের মত ছাত্র হওয়ার গৌরব অর্জন করলাম । একখানা স্কুলের সাথে পেলাম স্কুলের সামনে এক চিলতে মাঠ । সে মাঠে স্বল্পায়ু টিফিন পিরিয়েডে এলোপাতাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে অন্তত প্রাণ রক্ষা হল ।

জুন মাস ঘনাইয়া আসিতেই ফুটবল বিশ্বকাপের তুমুল দামামা বাজিয়া উঠিল । বয়স অতিশয় কম হলেও ফুটবলখোর হিসেবে আমি ছিলাম অকালপক্ক । সুদূর মার্কিন মুল্লুকে খেলা হওয়ার দরুণ ৯৪ বিশ্বকাপের খেলাগুলোর বেশির ভাগ গভীর রাতে শুরু হত । কিছু খেলা হত সকালবেলায় । আমি জন্মলগ্ন থেকে ব্রাজিল অন্তঃপ্রাণ , কিন্তু সেবার গোল বাধালো সাঈদ ওয়াইরান ।

ওয়াইরানের আরব্য রজনীর রুপকথা বলার আগে তার দেশ নিয়ে দু'টো কথা বলার প্রয়োজন বোধ করি । সৌদি আরব সেবার প্রথম বিশ্বকাপে উন্নীত হওয়ায় , তাদের নিয়ে ছেলেখেলা করার জন্য ইউরোপের তৎকালীন পরাশক্তি হল্যান্ড আর শক্তিধর বেলজিয়ামের হাত নিশপিশ করছিল , সেটা বলাই বাহুল্য । রুড গুলিত , রাইকার্ড সমৃদ্ধ ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে খেলাটা হল এক সকালে । আমার ভাবনার বিপরীতে লক্ষ্য করলাম , সৌদি খেলোয়াড়দের মাঝে শেখীয় দুম্বা-দামড়া ধবধবে খেলোয়াড়ের উপস্থিতি নেই , বরং মোটামুটি সবাই লিকলিকে কালো , তালপাতার সেপাই হয়ে আমার স্বাজাত্যবোধ-জাত সহানুভূতি জাগ্রত করে তুলল। সেই সকালে সৌদিরা দাঁতে দাঁত চেপে খেলল , ওলন্দাজদের ঘাম ঝরলো দেদারসে , কোন রকমে ২-১ এ ম্যাচ জিতে মান রক্ষা করল তারা।

বিশ্বকাপ নিয়ে পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া বাচ্চা-বালকের অতিশয় চঞ্চলতা দেখে , আমার মা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসলেন । ঘরে জারি হল রেড অ্যালার্ট , রাত ১২ টার পর খেলা দেখা যাবে না । বাবাকে উকিল ধরে , বাবার শার্টের কোণা ধরে ব্রাজিল জার্মানির কিছু কিছু খেলা দেখার সুযোগ হতে থাকল , কিন্তু সৌদি আরব-বেলজিয়াম খেলার মাহেন্দ্রক্ষণে বাবার সন্ধান মিলল না । সন্তর্পনে রাত দ্বিপ্রহরে টিভি অন করিলাম । প্রসঙ্গক্রমে বলি, সেই যুগে , বেলজিয়াম দলে কালজয়ী এনজো শিফো ছাড়াও গোলবারের নিচে মাইকেল প্রেডহোম নামীয় এক অতন্দ্র প্রহরী অবস্থান করিতেন ।

সেবার বিশ্বকাপে মাইকেল সেরা গোলরক্ষীর পুরস্কারটিও হস্তগত করেছিলেন । কিন্তু সৌদি আরবের সাথে খেলার শুরুতে যা ঘটল , তা অভাবনীয় । দর্শকরা তখনও গ্যালারিতে আড়মোড়া ভাঙেননি , কিন্তু মাঝমাঠে লিকলিকে কুচকুচে সৌদি তুর্কী , সাঈদ ওয়াইরানের পায়ে বল যাবার পর স্রষ্টার বিচিত্র খেয়াল হল । কাউকে পাস না দিয়ে সাঈদ যে দৌড়টি শুরু করলেন , তার খানিকটা সোজাসুজি , খানিকটা সর্পীল , কিঞ্চিত স্বপ্নিল , শৈল্পিক আর গতিশীল । স্বপ্নের সে দৌড়ের শেষে যখন মাইকেলকে একাকী পেয়ে গেছেন , পেছনে তখন ছিটকে পড়ে আছে গোটা ছয়েক বেলজীয় পরাস্ত ফুটবল সেনা ।

শেষ শটে যখন মাইকেলকেও বশ্যতা শিকার করালেন সাঈদ , ঘড়ির কাটায় তখন ৫ মিনিটেরও কম , স্কোরকার্ডে সৌদি ১ বেলজিয়াম ০ । আমি মুগ্ধ বিহ্বল হয়ে গেলাম । মুগ্ধটার রেশ কাটতে না কাটতেই বেরসিক মা হাজির হয়ে নির্মমভাবে টিভি সুইচ অফ করে দিলেন । ব্রাজিল আর্জেন্টিনা হলে হয়ত মা খানিক সদয় হতেন , কিন্তু সৌদি আরবের খেলার মাহাত্ম তাকে বোঝানোর সাধ্য কার ? মনে জমা দুঃখ নিয়ে চোখ বুজলাম। মরুদুলাল সাইদের স্বপ্নের দৌড় দ্বিতীয় রাউন্ডে গিয়ে থেমে গেল ঠিকই , কিন্তু জাদুকর হিসেবে তদ্দিনে আরেকজন শুরু করে দিয়েছেন তার ভেল্কি ।

তার নাম --------- রবের্তো বাজ্জিও । ইতালির হয়ে একা পায়ে দ্বিতীয় রাউন্ড , কোয়ার্টার ফাইনাল , সেমিফাইনালে গোলের পর গোল করে গেলেন , আর প্রতিটা গোলের পর হাতের তালু ঠোঁটে ছুঁয়ে গ্যালারির দিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে দৌড়ুলেন সেই ট্রেডমার্ক দৌড় । ওমন ছুঁড়ে দেয়ার নাম যে ফ্লাইং কিস , সে শব্দটি তখনও আমার ডিকশনারিতে আপলোড হয়নি । কিন্তু হাস্যোজ্জল হাত চুমু ছুড়ে দেয়া বাজ্জিওর দৌড় আমাকে আষ্ঠে পৃষ্ঠে ঘিরে ধরল । সেসময় যা ঘটিল , তাতে রীতিমত কেলেঙ্কারি হয়ে যাবার সম্ভাবনা জাগলেও , স্রষ্টার কৃপায় শেষমেশ আর তা হল না ।

ওয়াইরান ভূতে আমি তখন ভালোমতই সওয়ার , বিশ্বকাপ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আমাদের পিচ্চিদের মাঝে ফুটবল জোয়ারও তুঙ্গে , পায়ে বল আসলেই নিজেকে ওয়াইরান মনে হয় , আর চারদিকটা যেন ভরে যায় লাল জামা পড়া বেলজিয়ান ডিফেন্ডারে । সবাইকে ছিটকে ফেলে গোল দেয়ার ফ্রেমের শেষটায় আমি আবার এককাঠি সরেস , সেখানে থাকে ব্যাজ্জিওর হাত চুমু ছুঁড়ে দেয়া দৌড় । Man proposes , but god disposes .... কয়েকদিন আপ্রাণ চেষ্টার পরও সাঈদ ওয়াইরানের বদলে মেহরাব হয়রান হয়েই রইলাম , সাইদের পরের ফ্রেমের ব্যাজ্জিওর দৌড়ও জীবন পেল না , ছুঁড়ে দেয়া হল না সেই অজানা অনুভূতি । উল্লেখ্য , গ্যালারিতে সে সময় মেয়েদের অনেকেই উপস্থিত থাকত । যে ছেলেটি মেয়েটির দিকে লজ্জায় চোখ তুলেও তাকায় না , সে ওমন কিছু ছুড়ে দিলে , কি ঘটতে পারত , পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন , সেদিক থেকে ভাবতে গেলে পিঠের আয়ু বাড়ল।

মাস ঘুরে অবশেষে এলো সত্যিকার দৌড়ের ক্ষণ । জীবনের সব দৌড় গল্প থেকে সত্যি করার জন্য স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা । কেমন দৌড়াই সে বিষয়ে ভাল জ্ঞান ছিল না বিধায় , প্রতিযোগিতার আগের দিন ক্লাসের ছেলেরা মিলে উত্তপ্তকরণ (ওয়ার্ম আপ) করার ব্যবস্থা হল । সে দৌড়ের পুরোটা জুড়েই আমার মস্তক গুঁতোদ্দত ষাঁড়ের মত সামনের দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে রইল , মাঠের ওমাথায় পৌছে যখন মাথা তুললাম , দেখলাম সবাই পেছনে পড়ে গেছে । এ ঘটনায় আমার ছোট মনে প্রবল আশার সঞ্চার হল ।

শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর । আশপাশে পঞ্চম শ্রেণী ছাড়াও ষষ্ঠ আর সপ্তম শ্রেণীর স্বল্প-উচ্চতার বেশ কিছু পটেনশিয়াল কিছু দৌড়বিদকে দেখলাম । আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম , ষাড়ের শিং গুঁতোনোর ভঙ্গিতেই মাথা নিচু করে বাতাস ফুঁড়ে ছুটব । স্টার্ট বলতেই শুরুটা করলামও ঠিক অমন , কিন্তু টের পেতে শুরু করলাম আমার নাক ক্রমশ মাটির দিকে ছুটে যাচ্ছে , খানিক পরেই অবধারিত ক্রাশ ল্যান্ডিং। মাঠের মাঝামাঝি এসে তীব্র ঘষা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ।

দু'হাত দিয়ে ঠেকাতে গিয়ে বিমানের পাখারুপী হাতের একটা আঙ্গুল মচকে গেল বুঝি । এবড়ো থেবড়ো রানওয়েতে , চাকাবিহীন বিমানের ক্র্যাশ ল্যান্ডিংয়ে অবলা বিমানের কি ভয়াবহ কষ্ট হয় , তার যেন জীবন্ত স্বাক্ষী হয়ে রইলাম । হাত পা ছলে যাবার পরও আমার কিছু গায়ে লাগত না , যদি মায়ের কাছে ব্যাপারটা চেপে যাওয়া যেত , কিন্তু ডান হাঁটু বরাবর প্যান্টের বিশাল ফুটো দিয়ে দৃশ্যমান রক্ত ঝড়া হাঁটু , সে অবকাশ রাখল না । মা যথারীতি , ইন্টারন্যাশনাল অ্যামেচার অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের কর্মকর্তারুপে আবির্ভূত হয়ে আমাকে অ্যাথলেটিকস ফিল্ডে সাময়িকভাবে ব্যান করে দিলেন । ব্যান খাবার পরও মায়ের অজান্তে দৌড়াদৌড়ি , গরম পানি , ঠান্ডা পানি , বোম বাস্টিং চলতেই থাকল ।

বছর ঘুরে আসল আরেকটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা । কথায় বলে , স্বভাব যায় না ধুলে , ইল্লত যায়না মলে । দুরুদুরু বক্ষে আরেকবার নিজের নাম দিয়ে দিলাম । এবার প্রতিজ্ঞা ছিল , আর নয় ষাঁড়ের নত মাথা হেট দৌড় , দৌড়াব এবার বুক উঁচিয়ে । হলও তাই , কিন্তু হিটেই দেখা গেল , আমার পেছনে তেমন কাউকে দেখা গেল না ।

বুঝতে বাকি রইল না , আমার দৌড়ের হালত বড়জোর "শামুক খালে কচ্ছপ রাজা"র মতন । কিন্তু তার চেয়েও বড় ঘটনা ঘটল অন্য জায়গায় । টাচলাইন অতিক্রম করেও পুরনো কুফা পিছু ছাড়ল না , একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে হাঁটু গেড়ে মৃদুভাবে পড়লাম । তাতেই যা হবার হয়ে গেল , আগের বারের ডানহাটুর সাথে ইনসাফি করে এবার বাঁ হাটু ছলে গেল , সাথে সে ক্ষত দৃশ্যমান করার জন্য প্যান্ট ভেদ করে বিশাল এক জানালাও রচিত হল। পাঠক মাত্রেই জানেন , ইন্টারন্যাশনাল অ্যামেচার অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন প্রথমবার ডোপ পাপের জন্য দু'বছরের জন্য সাময়িক , আর দ্বিতীয়বার পাপের জন্য আজীবন অ্যাথলেটকে নিষিদ্ধ করে থাকে ।

দ্বিতীয় দফায় মত প্যান্টের হাঁটু ফাটিয়ে ফেলার অপরাধকে ডোপপাপের মত ট্রিট করে মা আমাকে আজীবন দৌড়াদৌড়িতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিলেন । নিষেধাজ্ঞা মেনে খুব ভদ্র হয়ে গেলাম এমন না । তবে , গরম পানি , বোম বাস্টিংয়ের মত আধ মেয়েলি খেলা ত্যাগ করে আমরা বন্ধুরা সুপুরুষ হওয়ার ধান্দায় টিফিন পিরিয়ডে লং জাম্পের প্রবর্তন ঘটালাম । ধীরে ধীরে লং জাম্পে অংশ নেয়া টিফিনিয়ারের সংখ্যা বেড়েই চলল । লং জাম্পের লম্ফ দেয়ার আগে বেশ খানিকটা জোরে দৌড়ে আসতে হয় ।

যেভাবেই হোক , টিফিন পিরিয়ড জাম্পে আমি বিপুল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলাম । আগের বছর যে ছেলেটি লং জাম্প জিতেছে , তাকে হারাতে লাগলাম নিয়মিত । আসলো ক্লাস সেভেনের প্রতিযোগিতার ঘোষণা । মায়ের অজ্ঞাতে নতুন স্বপ্নে বুক বেঁধে আবার নাম লেখালাম প্রতিযোগিতায় । ভাবখানা এমন যে স্প্রিন্টার কার্ল লুইস ক্যারিয়ারের শেষে এসে যেমন পুরোদস্তুর লং-জাম্পার হয়ে গিয়েছিলেন , আমিও ঠিক তেমন কেউ ।

কিন্তু একি হল ? ইভেন্ট তালিকায় আতিপাতি করে খুঁজেও লং জাম্পের দেখা মিলল না , জাম্প একটাই , সেটা ট্রিপল জাম্প । হাজার হোক জাম্প্ তো জাম্পই । ট্রিপল জাম্পের আগে স্যার নিয়ম শিখিয়ে দিলেন । দৌড়ে একস্টেপ , দু স্টেপ , তারপর ফাইনাল ঝাঁপ । পুরো দৌড়টার মাঝে একটা দারুণ রিদম আছে , নর্তকীদের মত ।

শরীরটা একবার এদিকে বাঁকে , পরক্ষণে উল্টোদিকে । স্টেপ গুলো ফেলতে হয় এক পায়ে । যথাসময়ে আমার পালা আসল , দৌড়ে গেলাম , কিন্তু হায় , কোথায় আমার নাচের মুদ্রা ? এক পায়ের বদলের ব্যাঙের মত জোড়া পায়ে দিলাম প্রথম লাফ , তারপর চরম হাস্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে জোড়া পায়ে দ্বিতীয় লাফ , ফাইনাল লাফ নিয়ে তখন বিরাট দ্বিধা , অসহায়ত্ব । স্যারই এগিয়ে এলেন , সামনে হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করলেন ..... "ডিসকোয়ালিফাইড" দৌড়ের ক্যারিয়ারে ততদিনে ওয়াইরান হতে চাওয়া মেহরাব , হয়রান এক ব্যর্থের নাম । পরের বছর স্কুল বদলে চলে গেলাম আইডিয়াল স্কুলে ।

বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নিজের পা দু'টোকে আটকে রাখতে পারলাম না । তার আগে আবু বকর স্যারের কথা বলি , যার কাছে আমি অংক বিজ্ঞান প্রাইভেট পড়তাম । স্কুলের স্যারদের মাঝে তিনি ছিলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় , ব্যাচে পড়ার সময় স্যার খেলাধুলা বিষয়ক গল্পে বিশাল কনট্রিবিউশনের জন্য স্যার আমাকে বেশ পছন্দ করতেন । মাঠে নেমে যখন দেখলাম , স্যার মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন , তখন খানিক দমে গেলাম । আগের স্কুলের সব ব্যর্থতার অতীত স্মৃতি মুছে আমি তখন নতুন খোলসে ।

জানা গেল , দূরপাল্লার দৌড়ে একসাথে সবাই অংশ নেবে । অতীত ইতিহাস আর স্যারের চাহনি , দুয়ে মিলিয়ে স্বল্প পাল্লার দৌড় বাদ দিলাম , রাতারাতি পরিণত হলাম দূরপাল্লার দৌড়বিদে । একসাথে এত ছেলের মাঝে ব্যর্থ হলেও কেউ বুঝতে পারবে না , এতটুকুন ভরসা নিয়ে নেমে গেলাম । কিন্তু হায় , বিধাতা অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন আলাদা করে । স্কুলের মাঠ ছোট বলে একটা বৃত্তাকার দাগের চারপাশে ১৮ বার ঘুরতে বলা হল ।

বিপুল সংখ্যক ছেলে একসাথে শুরু করল সে দৌড় । বৃত্তের ব্যাসার্ধ কম হওয়ার কারণে খানিক পর টের পেলাম বৃত্তের কেন্দ্রের দিকে অস্বাভাবিক ভাবে বেশি হেলে দৌড়াচ্ছি । পাঠক যদি ভিজুয়ালাইজ করতে চান , তবে মোটরসাইকেল রেসে হাঁটু ছুয়ে বাঁক নেয়া ভূমির সমান্তরাল বাইকগুলোর কথা ভাবুন । খানিক পর দেখা গেল , যে ছেলেটি সবচেয়ে ভাল দৌড়াচ্ছে , সে আমার কাঁধ ঘেষে যেন ঠিক পেছনে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । খুশি হওয়ার বদলে , গভীর হতাশা ততক্ষণে আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে , হয়ত ভাবছেন কেন? কারণ ছেলেটি এর মধ্যেই এক ল্যাপ বেশি দৌড়ে আমার গায়ে ঘেঁষে আছে ।

ফিজিক্সের রুলস রেগুলেশন নিয়ে তখনও জ্ঞান হওয়ার সুযোগ হয়নি , তাই কেন্দ্রমুখি বল , বিমুখি বল , ত্বরণ নিয়ে শরীরে যে অনুভূতি হচ্ছে , সেগুলো বিজ্ঞানের পরিভাষায় অনুবাদ করতে পারছিলাম না । ফিজিকস বলে , কেন্দ্রমুখী বলের ভেক্টর দিক ,সবসময় বৃত্তাকার পথের স্পর্শক বরাবর । এমন হাবিজাবি ফিজিক্সের সূত্রগুলো সিরিয়াল ধরে যেন প্রমাণ করার ক্ষণ এসে গেল । হঠাৎ করে ভীড়ের মাঝে কারও পায়ে যেন আটকে গেল আমার পা , স্পর্শক বরাবর উড়ে গেলাম যেন , তারপর খানিক দূরে গিয়ে ধপাস করে পতন , চোখে পড়ল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কারও একজনের পা , ধীরে মাথা তুললাম .... নির্বাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন ... আবু বকর স্যার । (( ট্রিপল জাম্প এবং দূর-পাল্লার দৌড়ে এমন মর্মান্তিক ক্যারিয়ার শেষে আমার উপলব্ধি হল , আমাকে আমার সম্ভবনাময় ইভেন্ট বিস্কুট দৌড় থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ।

অংকের মাথা বেশ ভাল ছিল বলে , ঝটপট অংক কষে দিতে পারতাম । কাজেই অংক যদি খুব কঠিন হত , তাহলে বিস্কিট সবার শেষে খেয়েও আমিই বিস্কিট দৌড় জিততাম । কিন্তু যে বয়সে এই ইভেন্টটি অনুষ্ঠিত সে বয়সে আমাকে গৃহে পাঠদান করে , এ ইভেন্টের বিজয় আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়)) দৌড় নিয়ে লেখা প্রথম পর্ব : স্মৃতির দৌড় , দৌড়ের স্মৃতি : গল্পে , অনুভবে (১৯৮৮-১৯৯৪)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.