দ্য ইনভিজিবল
(০১)
গলার টাইয়ের ন্যট খুলতে খুলতে বিমর্ষ রাকিব সাহেব ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরে ঢুকে একবার দেয়ালে ঝোলানো চে'র ছবিটার দিকে
তাকালেন। তারপর বিকৃত হাসলেন। হাতের 'দি হেয়ারি এপ' বইটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে ফ্যানটা ছাড়লেন। তিনি দেখতে পেলেন তার বউ বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন।
বউয়ের কোলে তিন বছর বয়েসী চে'। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। রাকিব সাহেব হেসে উত্তর দিয়ে দেয়ালের দিকে আবার তাকালেন। বউ চে'কে পায়ের উপরে ঘুম পাড়াতে লাগলেন। বউয়ের দিকে কটমট তাকিয়ে রাকিব সাহেব চে'র গালে আলতো একটা চুমু দিলেন।
জেগে কেঁদে উঠলো চে'।
কিছুক্ষণ পর ফ্যানের গতি আরেক দফা বাড়িয়ে দিয়ে রাকিব সাহেব এবার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন।
হামিদা বানু দেখলেন। কিছুই বললেন না। তার স্বামীকে এখন তার কাছে যুদ্ধ ফেরত ক্লান্ত যোদ্ধা মনে হচ্ছে।
বার বার তিনি মাথা ধরছেন। তার স্বামীর মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে নিশ্চয়।
এই প্রচন্ড শীতের রাতে একটা মানুষ বাহির থেকে এসে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, বিষয়টা তার কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না। কী এমন ব্যাপার!
জানেন, সময় মত নিজেই গড়বড় করে ঘটনা বলে দেয়া শুরু করবেন। এটাই তার স্বভাব।
... কী হতে পারে ? হামিদা বানু স্বামীর দিকে তাকালেন। আশ্চার্য ! রক্তবর্ণ হয়ে আছে চোখ দু'টো। এত রক্তবর্ণ! ভয় করে তাকিয়ে থাকতে। অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি।
...'ফ্যান ছেড়ে রাখলে যে ? আমারতো কাঁপুনি এসে গেল।
বাচ্চাটার ঠান্ডা লেগে যাবে'।
রাকিব সাহেব কোন উত্তর করলেন না। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। হামিদা একবার ধাক্কা দিয়ে চাইলেন। নড়চড় হলো না।
তারপর সাতপাঁচ ভেবে নিজেই উঠে গিয়ে ফ্যানটা বন্ধ করে দিলেন।
...... (০২)
-'আচ্ছা, আমার মধ্যে কি তুমি কোন অস্বাভাবিকতা দেখেছো কখনো?'
রাকিব সাহেব প্রশ্ন দিলেন হামিদা কে।
হামিদা চোখ গোল করে উত্তর করলেন. 'না তো,কেন'?
-'এমনি জিজ্ঞেস করলাম'। কোন কারণ নাই'।
হামিদার সাহস হলো না পূনর্বার জিজ্ঞেস করার।
স্বামীকে তিনি এ রকম সময়ে ভয় করেন। স্বামীর চোখে এখন অদ্ভূত এক আগুন খেলা করছে। ঝাপসা এলোমেলো দৃষ্টি।
-'আমার মনে হয় আমার মধ্যে এমন কিছু অস্বাভাবিকতা আছে হামিদা। যে টা আমি নিজেও আইডেন্টিফাই করতে পারছি না।
তুমি কীভাবে পারবা'।
-'কী হয়েছে বলো!' হামিদার শঙ্কিত প্রশ্ন। '
-'না, তেমন কিছু না। এই!'
-'তুমিতো সন্ধ্যায় কোন এক বন্ধুর দেয়া পার্টিতে গেলে। এর মধ্যে এমন কী ঘটলো যে এমন প্রশ্ন আসছে'?
রাকিব সাহেব চুপ করে রইলেন।
অনেক্ষণ পর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে হামিদা বললেন 'ঘরে বাজার নাই,জান তো? চালের বস্তাও শেষ। সব শেষ। বাবুর দুধ আনতে হবে।
ওহ! বাসা ভাড়া নিতে এসেছিল। তোমার কী মন খারাপ?
........ (০৩)
-'কিছু বলছো না যে? পার্টি কেমন হ'ল? তুমিতো কখনোই এরকম পার্টিতে যাও নাই।
এবার নিশ্চয় অনেক মজা পেয়েছো। সব সময়তো বাসা আর অফিস। সমাজে কারো সাথে মিলতে চাওনা। মাঝে মধ্যে সামাজিকতা মেইনটেইন করতে হয়। অত মোটামোটা বই পড় সারাক্ষণ, এটুকু কেন যে তুমি বোঝ না, বুঝি না'।
রাকিব সাহেব পাশ ফিরে শু'লেন। চে'র গায়ের উপর হাত পড়তেই মোচড় দিয়ে কেঁদে উঠলো চে'!
...... (০৪)
পার্টি জমে উঠেছে।
সবাই যার যার আলোচনায় মগ্ন,খাবার-দাবার পর্ব চলছিলো। রাকিব সাহেব এক কোণে একটা সফট ড্রিংকসের ক্যান নিয়ে বসে ছিলেন। তিনি আবার হার্ড ড্রিংকসে অভ্যস্থ নন।
কোলা-টোলাও তার চোখের বিষ। তবু এটাই এখন ভরসা। যে বন্ধু তাকে এই পার্টিতে ইনভাইট করেছেন, তিনি বার বার বলে দিয়েছেন, 'দোস্তো, অন্তত: সোসাইটি মিলাইতে এক চুমুক হার্ড নিস'। রাকিব সাহেব সেখান থেকে উঠে এসে এই কর্ণারে বসেছেন। তাকে খুবই বিমর্ষ এবং চিন্তিত মনে হচ্ছে।
কোন ভাবনার অতলে ডুবে আছেন। হাতের ক্যানটা হাতেই ধরা। এক চুমুকও পড়েনি তাতে।
তার এই বন্ধুটি বিশেষ বড়লোক। ইউনিভার্সিটিতে এক সাথে বেড়ে উঠলেও তারপর তারা একত্রে বেড়ে উঠতে পারেন নি।
রাকিব সাহেবকে রেখে তার এই বন্ধুটি তরতর করে বেড়ে উঠে গেছেন। সোসাইটি বোঝাই।
........... (০৫)
ডান পাশে গান বাজছে। "বাবুজি তেরা ধীরে চলো...."। অনেকেই গানের সাথে সাথে ডান্স করছেন।
ডান্স ফ্লোর জমে উঠেছে। বুড়ো বুড়িদেরও তাল যাচ্ছে। রওনক সাহেব, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব। তার নাচের তালে ডান্স ফ্লোরে ধমাধম আওয়াজ হচ্ছে।
'জিগি জিগি জিগি জিগি,জিগজি জিগি'
রাকিব সাহেব নিবিষ্ট ধ্যানে ডান্স ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
তার চোখ লাল হয়ে আছে। তিনি অনবরত ঘামছেন । তার মস্তিষ্কে কিছু অস্বাভাবিক চিন্তা যোগ হচ্ছে। খুবই অস্বাভাবিক। যে রকম চিন্তা করা উচিত নয়।
তার ভিতরে একটা অনাকাঙ্খিত প্রবল ইচ্ছা জন্ম নিচ্ছে। হঠাৎ করে, আকস্মিক কোন একটা অকারেন্স ঘটাতে তার ইচ্ছা হচ্ছে। কেউ প্রত্যাশা করবে না, এমন ঘটনা। ...সবাই ঘোরের মধ্যে থাকবে। হঠাৎ!
এর আগে প্রায়ই তার এই ধরনের ইচ্ছা জাগতো।
কখনো প্রশ্রয় দেন নি ।
বড় কোন শপিং মলে ,ফাইভ স্টার হোটেলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময়,কিংবা আকাশ বিস্তৃত ভবনের পাশে দিয়ে যেতে তার এই ইচ্ছা জাগতো।
রাকিব সাহেব বারবার বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে চাইছেন, পারছেন না। জোর করে অবচেতন মস্তিষ্ক চিন্তায় বাধ্য করছে তাকে।
...... (০৬)]
ডান্স ফ্লোর জমে উঠেছে।
সবাই উম্মাতাল। চেতনাহীন। সবার লক্ষ্য একদিকে। ডান্স ফ্লোরে। নর্তকীর উল্লম্ব নৃত্যে মাতোয়ারা।
হঠাৎই ছন্দপতন। একটা আর্ত চিৎকারে সারা ফ্লোর একাকার! ভয়ানক আর্ত চিৎকার। কেউ থিতু হতে পারেনি। কারো মস্তিষ্কে ধরেনি। অবচেতনে।
এটা হতে পারে না। এটা হচ্ছে না।
রাকিব সাহেবের বিভৎস চেহারা। নিষ্টুর চোখ জোড়া। নাকের ছিদ্রগুলো পর্যন্ত অস্বাভাবিক বড় দেখাচ্ছে।
অমানসিক। তার হাতে একটা শক্ত লৌহদন্ড। তিনি মুহুর্তে,চোখের পলকে ভাঙতে শুরু করে দিলেন। টেবিলে মদের সাজানো বোতলগুলো। দামি দামি খাবারগুলো।
দেখতে ভয়ানক সুন্দর আসবাবপত্রগুলো। অসামাজিকভাবে ভেঙে ফেললেন। রঙিন দেয়ালগুলো, মহামূল্যবান ঝোলানো শিল্পকর্মগুলো আক্রান্ত করে দিলেন। আর অপূর্ব ফুলের টবগুলো। সবাই ভীতসন্ত্রস্ত।
কারো মুখে শব্দ নেই, কোন বোধ নেই। কারো কিছু করার নেই। রাকিব সাহেবের হাতে লম্বা একটা ছুঁচালো লৌহদন্ড।
......... (০৭)
রাকিব সাহেব ভেঙে দ্রুত বের হয়ে এলেন । উন্মত্তের মতন গোঙাতে গোঙাতে।
......... (০৮)
-'বউ, আসলে বলো তো আমার মধ্যে কখনো কোন অস্বাভাবিকতা তোমার চোখে ধরা পড়েছে'?
হামিদা বানু চোখ গোল গোল করে মাথা নাড়ায়। -'না, দেখিনিতো'।
কেন,কী হয়েছে'?
-'কিছু না, এমনি এমনি জিজ্ঞেস করলাম আর কি। এখনো বেতন হয়নি। চাল-ডাল-নূন সবই আনবো।
একটু ধৈর্য্য ধরো'।
হামিদা বানু অবাক চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
কিছুই বুঝতে পারলেন না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।