দ্বৈরথ
দেশে গিয়ে প্রায় দুমাস ঝাড়া হাত-পা হয়ে বসে ছিলাম। ফান্ড বন্ধ হয়ে গ্যাছে, আর যাই হোক বেতন দিয়ে পড়াশোনা সম্ভব না। কাজেই আমেরিকায় ফিরে যাবার আগ্রহও পাচ্ছি না। বুয়েটের চাকরীতে ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছে না। কাজেই পাবনাতেই কিছু একটা করব কি না সেরকম একটা পাগলাটে ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খায় মাঝে মাঝে।
কোন কাজ না থাকলে যা হয়, প্রতিদিনই ঘুম থেকে উঠে রিমোট টিপে টিপে বুড়ি ছোঁয়ার মত ৪০ টা চ্যানেলের মুখ দর্শন করে দেখবার মত কিছু না পেয়ে 'ধুত্তোরী' বলে সোফায় রিমোটটা ছুঁড়ে ফেলে চেক শার্টটা গায়ে গলিয়ে বাণী সিনেমার মোড়ে চলে যাওয়া, এটাই আমার নিত্যকার রুটিন। সহপাঠী বন্ধুরা সব পেটের ধান্দায় ব্যস্ত, অতি অবশ্যই পাবনার বাইরে, আর বান্ধবীরা কেউ চাকরী আর কেউ সংসার সামলাতে ব্যস্ত। অনাহুত অতিথির মত কারো কাছেই আর যাওয়া চলে না। আরেকটা সময় কাটাবার মত জায়গা অবশ্য আছে। এডোয়ার্ড কলেজের খেলার মাঠ।
সেখানে গিয়ে কোন শান বাঁধানো বেন্চিতে বসে অলস দুপুর কাটানো যায়। বেকারত্ব কাকে বলে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। অবশ্য খারাপ লাগে না এরকম সাময়িক বেকারত্ব। কিন্তু আমার কি হবে এই চিন্তায় বিমর্ষ পরিবার-পরিজনের মুখ দেখার হাত থেকে বাঁচার জন্যই পালিয়ে বেড়াই বাস্তবতা থেকে। দিনের পর দিন আমি বসে থাকি শানের বেন্চিটায়, অথচ সামনের দৃশ্যের কিছুই বদলায় না।
সেই একই ব্যস্ত মানুষজন, ফুটবলে কিক দেয়া কিশোর, আর বই-খাতা হাতে ক্লাসগামী তরুণ-তরুনী। হঠাৎ একদিন একঘেয়ে এই দৃশ্যপটে নতুন এক চরিত্র নজরে পড়ে। চোয়াল ভাঙা, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ওঠা মুখটা একটু একটু পরিচিত লাগে। তবে কতিপয় সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গীতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ানো এই ক্যাডারটিকে ঘাঁটাতে চাই না, কে জানে কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। একদিন চোখাচোখি হয়, তবে সতর্ক ভঙ্গীতে আমাকে মেপে নিয়ে ক্যাডারটি স্হানত্যাগ করতে গিয়েও কেন জানি থমকে দাঁড়ায়।
তারপর এগিয়ে আসে। হঠাৎ আমাকে চিনে ফেলবার অনুভূতি ফুটে ওঠে তার চোখে।
অপরিচিত এক সন্ত্রাসীর মুখে নিজের নাম শুনে আমি যারপরনাই বিস্মিত হই,আঁতিপাঁতি করে স্মৃতি হাতড়েও আমি স্কুল জীবনে কোন সন্ত্রাসীর সাথে এক বেন্চিতে বসবার কথা মনে করতে পারি না। শুধুই সাদা শার্ট আর খাকি প্যান্ট পরা একদল কিশোরের ছবি ভেসে ওঠে, ক্যানভাসটা উলটে-পালটে দেখেও সেখানে কিছুতেই আমি সামনে দাঁড়ানো চোপা-ভাঙা যুবকের ছবিটা বসাবার জায়গা খুঁজে পাই না। তবু হাসির উত্তরে মুখে হাসি ফুটিয়ে চিনে ফেলেছি ভাব ধরে অপরপক্ষের পরিচয়ের প্রত্যাশায় থাকি।
"কিরে, সৈকত না? চিনতে পারলি না? আমি মাসুদ। " কবে ক্লাসের লাস্ট বেন্চিতে বসে থাকা ছোটখাট রোগা-পটকা মাসুদ নামের ছেলেটা শালগাড়িয়ার ত্রাস 'কালা মাসুদ'-এ পরিণত হল সেটার হিসেব মেলাতে গিয়ে হিমসিম খেতে হয়। আমি নিজেও লাস্ট বেন্চিতে বসতাম। এতে অনেক সুবিধে, সামনে বসে খামোখা স্যারের সাথে চোখাচোখি হওয়া থেকেও বাঁচা যায়, আর এন্তার খ্রাপ খ্রাপ গল্প করা যায়। তখনকার ইঁচড়ে পাকা গ্রুপে ছিল মনে হচ্ছে ছেলেটা।
এখন জীবিকার তাগিদে ছেলেটার হাতে উঠে এসেছে কাটা বন্দুক, আর আমি হয়েছি ক্যারিয়ারের রেস কোর্সের ঘোড়া। নিজের ইচ্ছেয় দৌড়ই না আর, শুধু দৌড়ই বিধাতা নামক জকির ইচ্ছেয়। চলার পথ পাল্টে গেলেও নিমেষেই আমরা অতীত হয়ে যাওয়া দশ বছরের দূরত্ব অতিক্রম করে আগের মত স্কুলের বন্ধুতে পরিণত হই। এতক্ষণে ওর চোয়াল-ভাঙা রুক্ষ চেহারা ছাপিয়ে আমি বছর চৌদ্দর কোন কিশোরের মুখ দেখতে পাই। অনেকক্ষণ গল্প করি দুজন।
ফেলে আসা স্কুলজীবনের গল্প, প্রথম প্রেমের গল্প। বেশ কিছুক্ষণ গল্পের পর ওর এক সাগরেদ এসে দাঁড়ায়। "ওস্তাদ, চলেন"। উঠে দাঁড়ায় মাসুদ। আমিও উঠে পড়ি।
এরপর মাঝে-সাঝেই দেখা হয়, ও ব্যস্ত না থাকলে টুকটাক গল্প হয়। ওর ব্যস্ততা মানে অবশ্য এলাকা নিয়ন্ত্রণ অথবা টেন্ডার বাজি। অস্ত্র ঘটিত ব্যাপার-স্যাপারও থাকতে পারে। এগুলোর সুলুক-সন্ধান নেবার চেষ্টা করি না। একদিন কথাচ্ছলে বলে ফেলে, সৈকতরে, খুব টেনশনে আছি, বুঝলি।
র্যাব খুঁজতেছে। কবে যে মাইরা ফেলায়। ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখি। যাওয়ার আগে বলে যায়, ভালো থাকিস, তুই তো আমাদের গর্ব রে, তোর কথা সবাইরে বলি। আমি ওকে আর বলিনা যে, আমার ভবিষ্যত অন্ধকার।
আমেরিকায় আর ফিরে যেতে পারব কিনা জানি না। কিন্তু ও চলে যাবার পরও 'গর্ব' শব্দটা মাথায় ঘুরতে থাকে। কিছুতেই ছুঁড়ে ফেলতে পারি না সেটাকে। বাড়ি ফিরে হঠাৎ নিজের মধ্যে পুরনো সৈকতটাকে খুঁজে পাই, পুরনো রেসপন্স লেটারগুলো খুঁজে বের করে আবার মেইল করি। এরপর বেশ কদিন ইউনিভার্সিটিগুলোর সাথে যোগাযোগে ব্যস্ত ছিলাম।
ওর সাথে দেখা হয়নি বেশ কয়েকদিন। ফোন নাম্বারও রাখি নি ঝামেলা এড়াবার জন্য।
একদিন সকালে পাতে রুটি-তরকারী উঠিয়ে দিতে দিতে মা বলেন, কাল রাতে কালা মাসুদকে ক্রসফায়ারে দিয়েছে র্যাব। ছেঁড়া রুটির টুকরো মুখে তুলতে গিয়ে থেমে যাই, গলায় কোথায় যেন দলা পাকানো কষ্ট জমে ওঠে। থম ধরে থাকি সারা সকালটা।
গুমোট বাতাসটা কাটাবার জন্যই একসময় মেইল ওপেন করি। নর্থ ডাকোটা থেকে আসা মেইলটা খুলে দেখি, ফান্ড হয়েছে আমার। আমাকে নিয়ে গর্ব করা, নতুন করে বাঁচতে শেখানো কোন এক সন্ত্রাসীর কথা মনে করেই বোধহয় ঘোলাটে মনিটরে ওপেন করা কাঙ্খিত চিঠিটা আস্তে আস্তে ঝাপসা,আরো ঝাপসা হয়ে ওঠে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।