সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
বেরিয়ে আসুন ডুলাহাজারা সাফারী পার্কেঃ
কক্সবাজারের ডুলাহাজারায় অবস্থিত দেশের একমাত্র সাফারী পার্ক। বিলুপ্তপ্রায় ও বিরল প্রজাতি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বংশবৃদ্ধিসহ মানুষের চিত্ত বিনোদন, গবেষণা ইত্যাদি পরিচালনার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন চকরিয়া উপজেলা এলাকায় স্থাপিত দেশের একমাত্র "ডুলাহাজারা সাফারী পার্ক" পর্যটকদের আকর্ষনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। এখানে রয়েছে কয়েক হাজার পশু-পাখী। সাফারী পার্ক ও চিড়িয়াখানার মধ্যে পার্থক্য হলো -সাফারী পার্কে পশুপাখী থাকে মুক্ত পরিবেশে আর দর্শনার্থীরা থাকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে।
ভারতের হায়দ্রাবাদ জু' তে বিকাশ লাভ করা দক্ষিণ এশীয় মডেলের এই সাফারী পার্ক ইতিমধ্যে প্যারা হরিণ, মিঠা পানির কুমির, আফ্রিকান কুদু, উলুক ভালুকসহ বিভিন্ন বিলুপ্ত ও বিরল প্রজাতির পাখি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করে চলেছে।
বন্যপ্রাণীগুলো বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল জুড়ে স্ব-প্রতিভভাবে ঘোরাঘুরি করার দৃশ্য দেখে যেকোন লোক আনন্দিত না হয়ে পারে না। সাফারী পার্কের ধারণায় মূলতঃ বন্যপ্রাণীগুলোকে যেন তাদের আপন নিবাসে দেখার মতো। বাঘ ও সিংহ যাতে একটি নির্দিষ্ট এলাকার জুড়ে ঘুরে বেড়াতে পারে সে জন্য ৩০০ হেক্টর এলাকাকে আলাদা প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত করা হয়েছে। এসব বন্যপ্রাণী যাতে অবাধে ঘুরে বেড়ানো এবং প্রয়োজনে আবার খাঁচায় আবদ্ধ করা যায় তার জন্য তালিম দেয়া হয়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সময় বাঘ ও সিংহ কে দেখার জন্য উচুঁ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ইতিমধ্যে নির্মিত হয়েছে।
যা বাংলাদেশের আর কোথাও নেই।
কক্সবাজার জেলার এই বনাঞ্চলে এক সময় উচুঁ জাতের গর্জন, বৈলাম, চাপালিশ, তেলসুর, চাম্পাফুল এবং বিবিধ লতা গুল্মরাজি সমৃদ্ধ ছিল। তখন এই বনাঞ্চলে ছিল হাতী, ভলুক, বাঘ, হরিণ, বানরসহ অসংখ্য প্রজাতির পশুপাখি। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ ও অবৈধ শিকারের ফলে বন্যপ্রাণী ও বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতিগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ১৯৮০-৮১ সালে কক্সবাজার বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের অধীন ডুলাহাজরা ব্লকের সাড়ে ৪২হেক্টর জমিকে ঘিরে হরিণ প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হরিণ এনে ছাড়া হয়। কিন্তু এসব হরিণের জন্য পর্যাপ্ত খাবার ও পানির ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলো বেষ্টনী ডিঙিয়ে বাইরে চলে যেতে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ কয়েক হেক্টর এলাকা জুড়ে পাহাড়ী ছড়ার মাটি খনন করে একটি হ্রদ সৃষ্টি করেন। যাতে সারা বছর হরিণসহ পাখির প্রয়োজনীয় খাবার পানির উৎসের সৃষ্টি হয়। এ প্রকল্পটি দেশী-বিদেশী পর্যটক ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষিত হলে এটির আরো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মতামতের ভিত্তিতে ১৯৯৭-৯৮সালে সাফারী পার্ক প্রকল্প প্রনয়নের কাজ শুরু হয়।
বর্তমান প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম বার ক্ষমতাসীন হয়ে সাফারী পার্কটির নামকরণ করেন যথারিতী "বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্ক"। এই সাফারী পার্কে হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের সাড়ে ৪২হেক্টর এলাকাসহ মোট ৯০০ হেক্টর এলাকার বনাঞ্চলকে অর্ন্তভূক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। জীব বৈচিত্র ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের পাশাপাশি শিক্ষা, গবেষণা, ইকো-ট্যুরিজম ও চিত্ত বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিগত ২০০০-২০০১ সালে শুরু হওয়া প্রথম পর্যায়ের উন্নয়ন কাজে সাফারী পার্কের প্রস্তাবিত ৯০০ হেক্টরের মধ্যে ৬০০ হেক্টর বনাঞ্চলের উন্নয়ন সাধন করা হয়। সম্প্রতি ৩ বছর মেয়াদী দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে গত ২০০৩-২০০৪ অর্থ বছর থেকে। এ পর্যায়ে সংলগ্ন আরো ৩০০ হেক্টর বনাঞ্চলকে সাফারী পার্কের আওতায় নেয়া হয়।
দেশের চিড়িয়াখানা গুলোতে যে সব বন্য প্রাণী রয়েছে তার সবগুলো প্রাণী ছাড়াও এখানে রয়েছে বিরল প্রজাতির প্যারা হরিণ। যা প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিগত ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারীতে খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা এলাকার মধ্যপাড়া টিলা নামক স্থানে বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী প্যারা হরিণের কয়েক মাস বয়সী একটি বাচ্চা খুুঁজে পায় উপজাতীয়রা। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত মাটিরাঙার সেই স্থান থেকে আনা হয়েছে এই বাচ্চাকে। তার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন দেখা দেয় একজন সঙ্গীর।
কিন্তু দেশের আর কোথাও কোন প্যারা হরিণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। প্যারা হরিণের বংশ রক্ষার তাগিদে একটি নারী প্রজাতির প্যারা হরিণ সংগ্রহ করা জরুরী। এই পার্কে রয়েছে বিরল প্রজাতির একজোড়া আফ্রিকান কুদু। যা দেশের আর কোথাও নেই। এছাড়াও ভারত থেকে আমদানী করা ২৯টি মিঠা পানির কুমীর এই পার্কের লেকে ছাড়া হয়েছে।
এই পার্কের ভেটেনারী সার্জন ডাঃ জাহেদ মোহাম্মদ মালেকুর রহমান জানান, সাফারী পার্কে ২৫প্রজাতির বন্যপ্রাণী, ৫০প্রজাতির পাখি ও ৮প্রজাতির সরীসৃপ রয়েছে। এসব বন্যপ্রাণী, পাখি ও সরীসৃপের আনুমানিক সংখ্যা দেড় হাজার। কারন এই পার্কে মাত্র ৫টি হনুমান ছাড়া হলেও বর্তমানে শতাধিক হনুমানের আনাগোনা লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া প্রচুর বানর বন জঙ্গল থেকে এখানে এসে ভিড় করেছে। ফলে বন্য প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অনুরূপভাবে পাখির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে প্রজননের কারনে সাম্বার হরিণেরও বংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে রয়েছে ন্যাচারাল হিষ্ট্রি মিউজিয়াম। প্রায় ২০০০ প্রাণীর দেহাবশেষ, ষ্টাফিং ও স্পেসিমেন সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। প্রায় ৩০০ প্রজাতির গাছপালার হারবেরিয়াম সংগ্রহ করে এই মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে।
এছাড়া পার্কের প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে রয়েছে অসংখ্য প্রজাতির গাছপালা। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দুলাহাজরা ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম স্থাপন যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এতে পর্যটক, শিক্ষার্থী ও গবেষকরা বিপদাপন্ন এবং বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ করতে পারবেন বলে মনে করছেন সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এই সাফারী পার্কের নাম নিয়ে বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে কর্তৃপক্ষীয় বক্তব্য হচ্ছেঃ-সাফারী পার্কের নাম করার সময় বন বিভাগ মন্ত্রনালয়ে যে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছিল তা ইংরেজীতে লেখা হয়েছিল। ডুলাহাজারা ইউনিয়ন এলাকায় অবস্থিত বলে বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কের নাম বঙ্গবন্ধু "ডুলাহাজারা" সিদ্ধান্ত নেয়।
ইংরেজী কে বাংলায় অনুবাদ করার সময় সচিবালয়ের "বিজ্ঞ ব্যক্তিরা" ডুলাহাজরা লিপি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ফলে এই নাম বিভ্রাটের উদ্ভব ঘটে। বর্তমানে সাফারী পার্কের কোথাও 'ডুলাহাজারা' আবার কোথাও 'দুলাহাজরা' আবার কোথাও 'দুলাহাজারা' লিখে কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক থেকে সাফারী পার্কের দিকে যাওয়ার চিহ্ন সম্বলিত পাকা করা সাইনবোর্ড, টিকিট কাউন্টার, মূল ফটক ইত্যাদিতে ডুলাহাজারা লেখা আছে। আবার পার্কের অভ্যন্তরে বন্যপ্রাণী চিকিৎসালয়, বিশ্রামাগার, মিনিবাস প্রভৃতিতে দুলাহাজারা লেখা রয়েছে।
একই জিনিসের দু'রকম নাম নিয়ে সচেতন পর্যটক মাত্রই প্রশ্ন তুলছেন। কিন্তু কোন সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না।
স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি জানান, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক থেকে যে রাস্তা ধরে সাফারী পার্কে যাওয়া হয় তার নাম সুজা রোড। মোগল আমলে সম্রাট শাহ সুজা আপন ভাই আওরঙ্গজেবের তাড়া খেয়ে মিয়ানমার অঞ্চলে পালিয়ে যাওয়ার পথে বাজার জাতীয় মালামাল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ডুলা বা হাতা দিয়ে বাজার আনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডুলাহাজারা নামকরণ করা হতে পারে। কারন বিপুল সংখ্যক সৈন্য সামন্ত থাকার কারনে শাহ সুজা’র অনুগতরা হাজারেরও অধিক ডুলা ব্যবহারের কারনে এই নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।
তারা এই বক্তব্যের সমর্থনে আরও জানান, সেসব সৈন্য সামন্তদের রঙ্গ ঢং করার কারনে ডুলাহাজারা এলাকার একটি স্থানের নাম এখনও রংমহল হিসেবে পরিচিতি রয়েছে। অন্যদিকে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাহ, রামু উপজেলার ঈদগড় প্রভৃতি নামকরণের সঙ্গেও সম্রাট শাহ সুজার কাহিনী জড়িত।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন মনোরম পরিবেশে এই সাফারী পার্ক অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে ১০৭ কিলোমিটার দক্ষিণে ও কক্সবাজার শহর থেকে ৩৫কিলোমিটার উত্তরে এই সাফারী পার্কের অবস্থান। এখানে জীব বৈচিত্র্য দেখার জন্য পার্কে প্রবেশ করতে হলে বয়স্কদের ১০টাকা দামের টিকিট নিতে হয়।
১৫বছরের কম বয়সীদের জন্য ৫টাকা প্রবেশ ফি। শিক্ষা সফরে আগত ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ২টি প্যাকেজ রয়েছে। ৩০ থেকে ১০০ জনের গ্রুপকে দিতে হয় ১০০টাকা প্রবেশ ফি। আর ১০০জনের বেশী শিক্ষার্থীদের গ্রুপের জন্য প্রবেশ ফি ২০০টাকা। বিদেশী পর্যটকদের জন্য ৫ ডলার বা সমপরিমাণ বাংলাদেশী মুদ্রা।
সাধারণতঃ ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার পরদিন এখানে সর্বাধিক দর্শনার্থীর ভিড় হয়। কোন কোন বছর এসব দিনে অর্ধ লক্ষাধিক পর্যটক সমাগম ঘটেছিল। পর্যটন মৌসুমের প্রায় প্রতিদিন ১০০০ থেকে ৮০০০ লোক এ পার্ক পরিদর্শনের জন্য এসে থাকেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।