সাত মাসেও রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সাভার থানার পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্ত শেষ হয়নি। কিন্তু প্রাণহানির দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই শিল্প দুর্ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ২১ জনের মধ্যে আটজন জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
গত ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ভবনটি ধসে পড়ে। এতে এক হাজার ১৩৪ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন প্রায় দুই হাজার। এ ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে পাঁচটি।
এর মধ্যে তিনটি ভবনধসের ঘটনায়। ভবনের অন্যতম মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে। হত্যার অভিযোগে একমাত্র মামলাটি করেছেন নিহত একজন শ্রমিকের স্ত্রী।
কিন্তু ভবনধসের মামলাগুলো যথেষ্ট দুর্বল বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। রাজউকসহ সরকারি সংস্থার করা মামলাগুলো জামিনযোগ্য এবং যে ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, তাতে শাস্তির পরিমাণও কম।
সরকারের সব মামলা দায়িত্বে অবহেলা, ইমারত আইন ভঙ্গের মতো অভিযোগে করা। রাজউক ও পুলিশের করা দুর্বল ধারার দুই মামলা নিয়ে এখন এগোচ্ছে পুলিশ। হত্যা মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই। অস্ত্র মামলায় সম্প্রতি সোহেল রানার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
জামিন: গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্টের বিচারপতি নাজমুল হক ও বিচারপতি মোশরেফা হোসেনের বেঞ্চ থেকে জামিন পান পুলিশের করা মামলার এক নম্বর আসামি রানা প্লাজার জমি ও ভবনের মালিক সোহেল রানার বাবা আবদুল খালেক।
তিনি আরেকটি মামলায় বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ থেকে জামিন পান।
বিচারপতি কাশেফা হাসান ও বিচারপতি নাজমুল হকের বেঞ্চ থেকে জামিন পান সাভার পৌরসভার বরখাস্ত হওয়া মেয়র ও সাভার পৌর বিএনপির সভাপতি রেফাতউল্লাহ। আরেকটি মামলায় তিনি বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ থেকে জামিন পান।
বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ থেকে আরও জামিন পান রানা প্লাজা ধসের পর যুবলীগের নেতা সোহেল রানাকে যশোরে আত্মগোপনে থাকতে সহায়তাকারী অনিল দাস, শাহ আলম ও আবুল হাসানও। এই বেঞ্চ থেকে রানা প্লাজার অনুমোদন ও নির্মাণ-প্রক্রিয়া তদারকির দায়িত্বে থাকা পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী এমতেমাম হোসেনও দুটি মামলায় জামিন পেয়েছেন।
দুটি মামলায় বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের বেঞ্চ থেকে জামিন পেয়েছেন রানা প্লাজার নকশা অনুমোদনের জন্য সুপারিশকারী সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ও পৌরসভা যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খান।
গত ২৫ অক্টোবর বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের বেঞ্চ থেকে জামিন পান সাভার পৌরসভার উপসহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান।
সোহেল রানাসহ আরও কয়েকজন জামিন নেওয়ার জন্য আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। রানার বাবা আবদুল খালেক জামিনে মুক্ত হওয়ার পর এলাকায় ফিরে ছেলের জামিনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
গ্রেপ্তার হওয়া ২১ জনের মধ্যে স্থানীয় অধিবাসী প্রকৌশলী আবদুল রাজ্জাক উচ্চ ও নিম্ন আদালতে আটবার জামিনের আবেদন করলেও তিনি এখনো জামিন পাননি।
রানা প্লাজায় ফাটল দেখা দেওয়ার দিন সোহেল রানার অনুরোধে ভবনটি পরিদর্শনে এসেছিলেন তিনি। পরিদর্শন করে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি ভবনটি বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে তাঁর পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন।
বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যেও প্রকৌশলী আবদুল রাজ্জাক রানা প্লাজা ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেন বলে বক্তব্য দেন। রাজ্জাকের পরিবার এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ উচ্চ ও নিম্ন আদালতে দাখিল করেছেন।
সিআইডির তদন্ত: সাভার থানা পুলিশের করা মামলায় প্রাথমিক তদন্তে সিআইডি ৩০ জনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অভিযুক্ত করেছে।
তাঁদের মধ্যে ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাকি সাতজনের নাম ও পরিচয় চিহ্নিত করা হবে জানিয়ে সিআইডির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁদের সবার বিরুদ্ধেই রানা প্লাজা ধস ও সোহেল রানাকে সহযোগিতা করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে ভবনটিতে অবস্থিত পোশাক কারখানা ফ্যান্টম টেকের অন্যতম মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডেভিড মেয়ের রেকো ঘটনার পর পরই তাঁর মাতৃভূমি স্পেনে চলে গেছেন। ফলে তাঁকে আর গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
সিআইডির তদন্তে দেখা গেছে, ভবনটির দুর্বল নকশা, মূল নকশাবহির্ভূত তলা নির্মাণ, নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, নির্মাণ চলাকালীন তদারকি না করা, ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ভবনের মালিক সোহেল রানা ও তাঁর বাবা আবদুল খালেক প্রয়োজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে শ্রমিকদের জন্য আসলে একটি মৃত্যুফাঁদ তৈরি করেছিলেন।
সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর প্রথম আলোকে বলেন, সোহেল রানার বাবাসহ গ্রেপ্তার হওয়া ২১ জনের অধিকাংশই রানা প্লাজা নামক মৃত্যুকূপ নির্মাণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। আর বাকি ব্যক্তিরা রানাকে আশ্রয় এবং পলায়নে সহায়তা করে একই রকম অপরাধ করেছেন। মামলা: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় সাভার মডেল থানায় মামলা করেন। এ মামলায় ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাদ দিয়ে শুধু সোহেল রানাকে আসামি করা হয়েছিল।
এরপর সাভার মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ বাদী হয়ে ২৫ এপ্রিল আরও একটি মামলা করেন।
রানা প্লাজা ধসকে দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে দণ্ডবিধির ৩৩৭/৩৩৮/৩০৪ (ক)/৪২৭/৩৪ (৯) ধারায় করা ওই মামলায় সোহেল রানা ও তাঁর বাবা আবদুল খালেক, ফ্যান্টম অ্যাপারেলসের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম, ফ্যান্টম টেকের এমডি ডেভিড মেয়ের রেকো, ইথার টেকের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান এবং নিউ ওয়েভ বটম ও স্টাইলের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনানসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
সিআইডি এ মামলার ভিত্তিতেই বর্তমানে তদন্ত করছে। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গেছে, এ মামলাটির বড় দুর্বলতা হচ্ছে এটি জামিনযোগ্য এবং শাস্তি দুই থেকে ছয় বছরের কারাদণ্ড। কিন্তু তদন্তকারীদের প্রাপ্ত তথ্য হলো—সোহেল রানা ও তাঁর বাবাসহ অন্যরা সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক শাহিন শাহ পারভেজ ধামরাই থানায় অস্ত্র আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলা করেছিলেন।
এরমধ্যে অস্ত্র আইনের মামলায় সোহেল রানার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
পোশাকশ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলী আক্তার ঢাকা মহানগর মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে রানা প্লাজা ধসকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে ৩০২/৩৪/৫০৬ ধারায় আরেকটি মামলা করেন। এই মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।
জানতে চাইলে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, রানা প্লাজার ঘটনায় করা মামলার শুরু থেকেই অসংগতি ছিল। যে ধারাগুলো অনুসরণ করে মামলাগুলো করা হয়েছে, তাতে এ নির্মম ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যথাযথ শাস্তি পাবেন না বলে আশঙ্কা থেকে যায়।
সুলতানা কামাল আরও বলেন, পুলিশ এ ঘটনার তদন্ত করার সময় ভাবতে পারে, ‘যাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করছি, তাঁরা তো সরকারি দলের ও সরকারি লোক। ’ স্থানীয় নানা কারণে তাঁরা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট থাকতে পারেন। ফলে এ ধরনের ঘটনায় একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত ছিল, যেখানে মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নিতে পারতেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।