কত কিছু যে করতে চাই, তবুও কিছু করতে না পারার দায়ে মাথা খুঁটে মরি ।
পিয়ানোর একটা টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে পেছনে। কোথাও থেকে খুব সাধারণ সুরের সহজ একটা টোন ভেসে আসছে। কালচে লাল পর্দাটা সরে গেল। আমি চোখ খুললাম।
চোখটা আরও বড় করে চারপাশে তাকালাম। রুমটা বেশ অন্ধকারই বলা চলে, তাও দরজার ফাঁক দিয়ে একটা মিষ্টি আলো আসছে। খাটের পাশেই ছোট টেবিল, এর উপর পানি আর জগ রাখা। যদিও তৃষ্ণা লাগছে, তাও কী মনে করে আর ওদিকে হাত বাড়ালাম না। চারপাশে আবারও তাকালাম।
আওয়াজ পাচ্ছিলাম কোত্থেকে! টুংটাং।
অন্ধকারে আস্তে আস্তে চোখ সয়ে আসছে। অনেকগুলা বেড। বুঝাই যাচ্ছে সবাই ঘুমিয়ে আছে। বেশ বড় রুম।
বেশ দূরে দরজা। আস্তে ফাঁক করা। এতদূর যাওয়ার মত শক্তি নেই শরীরে। ভালভাবে পেছনের আওয়াজটা আবারও খেয়াল করলাম। নাহ, এখানে পিয়ানো বাঁজানোর প্রশ্নই ওঠে না কারও।
আওয়াজটা সম্ভবত আমার মাথার ভিতর থেকে আসছিল। এখন আর নেই। কিন্তু চোখ বন্ধ করে শরীরটাকে ছেড়ে দিলেই কানটা আবারও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সব শব্দ নেই, পেছনে শুধু কল্পিত পিয়ানোর আওয়াজ। টুংটাং।
রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ভোঁতা একটা চাঁদ মাথার উপরে আর তার চারপাশে সাদা আলো। সাই সাই করে গাড়ি যাচ্ছে আশে পাশে। এদের সামনে থেকে দেখে ভাল লাগে না, কিন্তু পেছন থেকে লাল আলোটা দেখলে আমার কেন যেন ভাল লাগে। এসময় শুধু ভাবতে ইচ্ছা করে।
বিষণ্ণ হতে মন চায়। জোর করে খুশি হওয়া যায় না বটে, তবে এমনি এমনি বিষণ্ণ হওয়া যায়। প্রকৃতি মানুষকে এমন বানিয়েছে কেন সেটা প্রকৃতিই ভাল জানে। পথশিশুরা এখনও পানির খালি বোতল আর কাগজ কুড়াচ্ছে। তবে শিথিল গতিতে।
হয়ত কালকের কাজটা শুধু এগিয়ে রাখছে। আজকে এদের দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে না, শুধু চাঁদের চারদিকের সাদা আলোটার দিকে তাকাতে ইচ্ছা করছে। এই আলোটা একটা বৃত্তের মতন। আলোটার সাথেই পাশের কালো আকাশটার একটা সীমানা টানা আছে। এর ভেতর দিয়ে কখনও কখনও মেঘ ঢুকে ঢুকে পড়ে, কখনও হয়ত শহুরে কাক উড়ে যায়।
যদি আঁকতে পারতাম, এঁকেই ফেলতাম। খুব হয়ত কঠিন হবে না এই দৃশ্যটা আঁকা। কল্পনা করছি আমি খুব সুন্দর করে ছবিটা আঁকব। একোটা সাদা রঙের ঘরে রাখব সবার দেখার জন্য। ঘরটার মাঝে সবসময় পিয়ানোর সুর ভাসতে থাকবে।
খুব আস্তে আস্তে, যেন কেউ নিশ্চিত হতে না পারে যে আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে। টুংটাং টুংটাং একটা আওয়াজ হবে চারপাশে, যেমনটা এখন আমার চারপাশে হচ্ছে।
কেন যেন মনে হচ্ছে কী না কী হয়ে গেছি। মনে হচ্ছে যেন যা ইচ্ছা করে ফেলতে পারি। মনে হচ্ছে যেন সব জানি।
মনে হচ্ছে যে, সামনে যেই মেয়েটা সেজেগুঁজে হাসছে, তার সবগুলো কষ্টের সবগুলোর কারণ আমি জানি। এই মেয়েটাকে দেখলাম আমি অনেকক্ষণ ধরে। বেশ অনেকক্ষণ। মেয়েটা কারণে অকারণে হাসছে। আমার দিকে তাকিয়েও যেন দেখছে না।
সামনে দিয়ে যারা যাচ্ছে, আরেকটা লোক তাদের কী যেন বলছে, আর মেয়েটার দিকে দেখাচ্ছে। মেয়েটাও তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। বুঝাই যাচ্ছে,তাদের ব্যাবসা এভাবেই চলে। কয়েকজনকে বললে চার ভাগের একভাগ হয়ত রাজি হয়।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম এখানেই।
পেছনের ছাপড়া ঘরটায় মেয়েটা নিয়ে গেল নীল শার্ট পড়া লোকটাকে। টেম্পোরারি ঘর। সকালেই হয়ত উঠিয়ে ফেলবে আবার। কিছুক্ষণ পরে নিশ্চিন্ত মনে নীল শার্ট পড়া লোকটা তৃপ্তি শেষে চলে গেল, ক্লান্ত মেয়েটা আবারও হাসি হাসি মুখ করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল। আমাকে দেখেও দেখল না।
আসলে যৌনতাকে না, মেয়েটার কষ্টটাকে দেখে আমার হঠাৎ লজ্জা লাগছিল। এই সমাজেরই অংশ হিসেবে আমার লজ্জিত হওয়া উচিত বোধহয়।
আমি আর দাঁড়ালাম না। একে দেখে লাভ নেই। আজকে ত শুধু আমার চাঁদ দেখার দিন।
ভোঁতা চাঁদ আর পেছনের টুংটাং আওয়াজ। আজকের সারাটা রাত ত এসব নিয়েই কাঁটিয়ে দেয়ার প্ল্যান ছিল। চোখ বন্ধ করলেই আওয়াজটা আবার পাই। মাথার ভিতরে যেন একটা ব্যাথা বাড়ছে। মেয়েটার দিকে যতক্ষণ তাকাচ্ছিলাম, মেয়েটার মনের সব কথা যেন আমার মাথার ভিতর খেলা করছিল।
আর মাথার ব্যাথাটা বাড়ছিল। আওয়াজটা যেন মাথার ভেতরে আরও একটু জোরালো শুনি এখন। টুংটাং টুংটাং।
নির্জন রাস্তায় হাটতে থাকি আমি। এখন আর কোন গাড়ি নেই।
নিশ্চুপ রাস্তা। মাঝে মাঝে রিকশা যায়, কোন কোন বাসার বারান্দায় আলো জ্বলে কিছুক্ষণের জন্য। এরপরে আবার বন্ধ হয়ে যায়। শীতকালে সবাই বোধহয় আগে আগে কম্বলের নিচে যেয়ে ঢোকে। কম্বলের নিচে বাচ্চাদের খুনসুটি চলে, বড়রাও থেমে থাকে না।
এমনকি হয়ত উঁচু উঁচু বিল্ডিংএর সবচেয়ে উপরের তলার কাজের মেয়েটাও এসময় কর্তার সাথে আনন্দ করে। কিছু বলার নেই। আজকে রাতে এসবই মনে হচ্ছে শুধু। কেন যেন আজকে সব কিছুর পেছনেই অন্ধকার দেখছি। মনটা বিষন্ন বলেই কী নাকি বিষণ্ণ হতে ইচ্ছা করছে বলে ! আমি দেখতে থাকি রাস্তায় শোয়া আরও একগাদা মানুষকে, যাদের গায়ে কম্বল নেই।
যারা হাত পা গুটিয়ে শুয়ে আছে, মাথাটা কুঁজো করে, যেভাবে মায়ের গর্ভে ফিটাস শুয়ে থাকে। তখনও এদের মা হয়ত কোন বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ করেছে। গর্ভের জন্য বাড়তি কিছু করতে দেয় নি তার দৈন্যতা। এখন এরা প্রকৃতির কোলে ওভাবেই শুয়ে থাকে। এখনও প্রকৃতিকে এদের উপকারে আসতে দেয় না প্রকৃতির দৈন্যতা।
অথবা বাঁধা হিয়ে থাকে এদেরই দুর্ভাগ্য। যেমনটা হয়ে আসছে সবসময়।
আমি নির্জন রাস্তায় হাঁটতে থাকি।
পাশে একটা গাছ রেখে এগিয়ে যাই। সেই গাছে পাখির বাসা থাকে।
হয়ত এই গাছটা মানুষের লোভের শিকার হয়ে কাঠ হবে আগামীকাল।
পাশে রেখে যাই একটা দোকান। বন্ধ দোকান। হয়ত মানুষের লোভের শিকার হয়ে বেদখল হবে আগামী পরশু।
পাশে রেখে যাই বাড়ি ঘর, বস্তি, গাছ, কুকুর মানুষ।
আমি হেঁটে যেতে থাকি শেষ মাথায়, যেখানে এসে রাস্তা আর সামনের দিকে আগায় না। এখানে দুপাশে ভাগ হয়ে দুই দিকে চলে গেছে রাস্তাটা। আমি বাম দিকে মোড় নেই। পিছে ফেলে আসি নির্জন রাস্তাটা, যেটা হয়ত মানুষের লোভের কারণে ভাঙা হবে খোড়া হবে, ম্যানহোলের ঢাঁকনা চুরি হবে, কিছুই ঠিক করা হবে না আর বহুদিন।
শুধু একটা জিনিসই আমার সাথে আগায়।
গোল একটা চাঁদ। আরও কিছু সাথে থাকে। একটা আশরিরী অনুভব সাথে পিয়ানোর টুংটাং আওয়াজ। কখনও সারাটা মাথা জুড়ে কখনও চারপাশে। সুন্দর মৃদু একোটা সুর, অথচ কত যন্ত্রণা দেয়।
মাত্র প্রথম রাত, অথচ আজই যেন কুঁকড়ে গেছি আমি। আসলে অনেক আগেই এই রহস্যের সমাধান করেছিলাম আমি। সৃষ্টি যদি সৃষ্টিকর্তা থেকে দয়া পেয়ে থাকে, তাহলে সৃষ্টিকে শাস্তি দেবার জন্য দয়ালু সৃষ্টিকর্তার আগুনের গর্ত তৈরি করার কথা না। মানুষকে সম্ভবত সাজা ভোগ করার জন্য এখানেই ফেলে রেখে যাওয়া হয়, যেই খেলাঘরের যেকোন ধরণের অবস্থার জন্য সে নিজেই দায়ী। আজীবন ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে নিজেদের কুকর্ম আর নিজের লজ্জায় কষ্টে বারবার লজ্জিত হতে হবে নিজেকেই।
এই শাস্তি নিশ্চয়ই অনন্তকালের মত হবে না।
আমি নিশ্চয়ই মরব, দ্বিতীয় বারের মত।
© আকাশ_পাগলা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।