লিখে সময় কাটাবার যখন দরকার হয়, তখন লেখার মত একটা বর্ণও মাথায় আসতে চায় না। অথচ ঠিক এই মুহূরতেই অন্তত দেড় ঘণ্টা কাটানোর মত কিছু একটা মথায় আসা খুব বেশি জরুরী। ১১ তলার ছাদে বসে আছি, পুরনো কলামটার আড়ালে। সেটাকে আরেক ধাপ উঁচু করার জন্য শাটার বাঁধা হয়েছে, লোহার পাইপ দিয়ে ঠেকা দেয়া, মাথার ঠিক উপরে। যেরকম ওজনদার পাইপ, মাথায় পড়লে পাতাল না হলেও হাসপাতাল নিশ্চিত।
মাথায় পড়ার কোন কারণ অবশ্য নেই, বেশ ভালভাবে ঠেকা দেয়া, কিন্তু এর আগেও একবার এরকমই বাঁধাছাদা একটা পাইপ হঠাৎই দড়ি ছিঁড়ে মাথা বরাবর এসে পড়েছিল। হেলমেটটা খুলে সবে হাতে নিয়েছিলাম কপালের ঘাম মুছতে, হঠাৎ কি একটা উপর থেকে ধেয়ে আসতে দেখলাম, আর কিছু বোঝার আগেই মাথার ঠিক উপরে আড় করে বাঁধা দু'টো রডে লেগে পাইপটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। উপরওয়ালার কৃপায় বাংলা সিনেমার নায়কের মত "আমি কোথায়?" বলে চোখ খুলতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু পায়ের কাঁপুনি থামতে লেগেছিল পুরো তিন মিনিট।
যাকগে, মনে হয় খেই হারিয়ে ফেলেছি, কি যেন শুরু করতে গিয়েছিলাম আর বুড়ো মানুষের মত কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলাম! একবার একজন বলেছিল আমি নাকি কখনোই মূল কথা থেকে সরিনা, ঘুরেফিরে আসি, আজকাল কথাটা খুব ভুল মনে হয়। কেবলই ভুলে যাই আর সরে যাই।
এই তো সেদিন, কার একটা বই কিনবো বলে বের হলাম, এরপর দোকানে গিয়ে গেলাম ভুলে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে লেখকের নামটা যা-ও মনে পড়লো, বইটার নাম আর মনেই এলোনা। কাকে যেন টাকা দেব বলে বের হয়েছি বাসা থেকে, গন্তব্যে পৌঁছে মনে পড়লো, পকেটের রুমালটাও এনেছি, মায় ভাঙতি দু'টাকাও, কিন্তু আসল টাকাটাই আনা হয়নি।
অথচ এমনটা হয় না, এমনটা হবার কথাও ছিল না। স্মৃতি আমার বরাবরই ভাল কাজ করে, ভুলি না কিছু।
আনন্দের আর বন্ধুত্বের স্মৃতি মনে থাকে, তারচেয়েও বেশি মনে থাকে দুঃস্বপ্নের আর অপমানের স্মৃতি। ৭ বছর বয়সে মেনিনজাইটিস হয়ে মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ফিরে আসার কথা মনে আছে, টানা ১০ দিন যমে-মানুষে টানাটানি। মনে আছে পাশের কেবিনের বাচ্চাটার কথাও, লিউকোমিয়া হয়েছিল, ২ কেবিনের মাঝের পর্দা দিয়ে কথা বলতো, আমি সে যাত্রা ফিরে এলেও তার আর ফেরা হয়নি কখনো। আবার যমরাজকে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম কলেজে থাকতে, যেদিন মাঝরাস্তায় বেবিট্যাক্সির ধাক্কায় সাইকেল ঠেকে ছিটকে পড়েছিলাম। চারপাশের বাস-ট্রাকগুলো সেবার কিভাবে আমাকে এড়িয়ে গেল সেটা বোধহয় একমাত্র উপরওয়ালাই ভাল বলতে পারবেন।
আবার সেদিনকার কথাও খুব স্পষ্ট মনে আছে, এয়ারপোর্ট রোডে বাস থেকে নামতেই আরেকটা বাস তেড়ে এল, লাফিয়ে পিছাতে গিয়ে নিজের বাসটার সামনেই পড়েছিলাম, ড্রাইভারের প্রতিক্রিয়া খুব দ্রুত না হলে এতদিনে অন্য কোন জগতে হিসাবের খাতা খুলতে হতো।
এতসব অভিজ্ঞতা মানুষকে সাহসী করে তোলার কথা, আমাকে আরো ভীতু বানিয়ে দিয়েছে। সেজন্যই এই ভুলো রোগ কিনা কে জানে, হয়তো এজন্যই ছিনতাইকারী ধরলে বিনাবাক্যব্যয়ে সেলফোনটা আর পকেটের টাকাগুলো দিয়ে দিই আর বাসায় ফিরে নির্বিকারে ঘটনাটা ভুলে যেতে চাই। এজন্যই অন্ধ দুর্নীতির দেশে থেকেও উপরওয়ালার সুকীর্তি ভুলে গিয়ে বিষ খেয়ে বিষ হজম করি আর গর্জনের বদলে মিউ মিউ করি। শালার পেটের দায় আর জানের মায়া, মানুষকে গোলাম বানাতে বেশি কিছু লাগে না!
ভুলে যাওয়ার জন্য এই ১১ তলার ছাদটা মন্দ না, একে তো মাটি থেকে এত উপরে, তার ওপর প্রায় ঝড়ো বাতাস ভাবনাগুলোকেও কেমন উড়িয়ে নিতে চায়।
নিচে তাকালে ইচ্ছে হয় উড়ে চলে যাই, সিঁড়ি দিয়ে নামা বড় কষ্ট। সেদিন বসেছিলাম এয়ারপোর্টের দিকটায়, দানবীয় বিমানগুলোর ওড়াওড়ি দেখতে, আজ বসেছি উল্টোদিকে। দৃশ্যগুলো পাল্টে গেছে অনেকটা, একটা জায়গায় মিল আছে শুধু,
দূরের প্রান্তে সব ধোঁয়া ধোঁয়া। কুয়াশা নয়, ধুলো আর ধূসর রঙের নিষ্প্রাণ শহর। গাড়ির আওয়াজ কম এখানটায়, কিন্তু রানওয়েতে অবিরাম ওঠানামা করা বিমানের গর্জন আর বিমানবাহিনীর ফাইটারগুলোর অবিশ্রান্ত ওড়াওড়ি রীতিমত যুদ্ধাবস্থার পূর্বাভাস দেয়।
ব্যাটাদের কোন মহড়া চলছে মনে হয় আজকাল, উড়ানখেলা দেখতে মন্দ লাগে না, চিৎকাত হয়ে উড়ে উড়ে বেশ একখানা রঙ্গ। তবে
সার্কাস দেখানো ছাড়া এই মান্ধাতা আমলের ফাইটার পুষে দেশের কি সুরক্ষা হয় বলা মুশকিল, নেপাল-ভূটান-মালদ্বীপের মত কয়েকটা দেশ বাদে মোটামুটি সব দেশের বিমানই আরেকটু জাতের বলে বোধ করি।
৪ নম্বর সেক্টরের এদিকটায় একটা খেলার মাঠ আছে, ভূমিদস্যু আর সরকারের হাত এড়িয়ে কইমাছের জান নিয়ে বেঁচে যাওয়া কয়েকটা মাঠের একটা। গোলপোস্ট আছে দু'টো, তবে ছেলেপিলের সেটাকে স্টাম্প বানিয়ে ক্রিকেট খেলার দিকে উৎসাহই বেশি, দেশের ফুটবলের দুর্দশা দেখতে বেশিদূর যেতে হয়না। ছেলেগুলোকে দেখে স্মৃতিকাতরতা আর ঈর্ষার যুগপৎ আক্রমণে আক্রান্ত হই, আবারো উড়ে গিয়ে ওদের মাঝে নামতে ইচ্ছে করে।
সবার আগে, বিকেলেরও বেশ আগে, ভরদুপুরও বলা যায়, মাঠে আসে একটা ছেলে, দুইটা ছেলে। মাথার ওপরে তখন কাকের আনাগোনা, ভয়ে থাকি কখন প্রাকৃতিক বোমাবর্ষণ শুরু হয়। ডানা ঝাপটে ছাদে জমা পানিতে কাকভেজা হয় দাঁড়কাকেরা আর ঠোঁট দিয়ে সেই পানিই ঠুকরে খায়, আশপাশে আরো ২-১টা পাখির সন্ধানে তাকিয়েও কিছু পাইনা। কাকের মত আবর্জনাখোর না হলে মনে হয় অত ওপরতলায় ওঠা যায় না। ওদিকে দূরের দুই ছাদে দুই তরুণ-তরুণীর মুখোমুখি দাঁড়ানো দেখে সেই গল্পটা মনে পড়ে যায়, সেই যে, পাশের বাসার ছেলেটা সকাল থেকে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে থাকতো ছাদে, মেয়েটা থাকতো জানালায়, আর ভরদুপুরে কোন মহিলা, ছেলেটার মা-ই হবে, হুংকার দিয়ে বলতো-- "আরে দুপুরের খাওয়াটা খায়া যা, তার পরে ডিউটি দে!" বেচারারা, এত বড় শহরেও প্রেম করার জায়গার
বড় অভাব, শুধুই ভর্ৎসনা আর কৌতুহলের দৃষ্টির চাবুক।
মাঠের ছেলেদু'টো ঠুকঠাক করে, দল ভারি হতে থাকে। একজন-দু'জন করে গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলেপুলে মাঠে নামে, দল ভাগ করে। সজোরে হাঁকানো, ছুট, আর একটা ক্যাচ ধরে বিশ্বজয়ের উল্লাসে হাত ছোঁড়া, এত দূর থেকেও সম্মিলিত চিৎকারটা কল্পনা করে নিতে কষ্ট হয় না। কতদিন অমনভাবে বাতাসে হাত ছড়িয়ে লাফিয়ে উঠিনা? এক বছর? দুই বছর? তিন বা চার বছরও হতে পারে। স্কুলের ছুটির দিনগুলোতে দলবল নিয়ে সকাল ৯টায় মাঠ দখল, হালকা কুয়াশায় দল ভাগাভাগি, তারপর আনাড়ি পায়ে ভেজা ঘাসের উপর দৌড়ে আনাড়ি খেলা, মিসফিল্ডিংয়ের মহড়া।
দুপুরে ঘেমেঘুমে বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি শুকোবার আগেই ফুটবলটা নিয়ে একছুটে আবার মাঠে। অর্থহীন ছুটোছুটির জন্য তখনো কয়েকটা বড় মাঠ অবশিষ্ট ছিল, খুব মারকুটে ব্যাটসম্যান বা তাগড়া জোয়ান ফুটবলার না হলে বল মাঠ পার করে বাড়ির জানালা ভাঙা বড় সহজ ব্যাপার ছিল না। ফুটবল আর ক্রিকেটের মাঠগুলো আমাদের কৈশোরেই দখল করে নিয়েছিল কংক্রিটের দানবগুলো, তারপরেও ব্যাডমিন্টনের লাফঝাঁপ ছিল আমাদের শেষ ভরসা। এখন তো দানবদের সঙ্গীসাথীরা এসে শিশুদের মন-মগজকে মাঠসহ ঢুকিয়ে দিয়েছে কম্পিউটারের পর্দায়, আর আমাদের মত কতক অথর্ব অতীতচারীর কলমের ডগায়। আহা জীবন, সবকিছুই কেবলই হারিয়ে যায়!
তাই এই শেষ বিকেলে অতীতের ছায়া দেখে মনে মনে একটু সিনেমা বানাই, ঐ কংক্রিটের দৈত্যকুলের মাঝে একটুকরো সবুজ প্রহ্লাদ মেঠো জমি, তার মাঝে গাছের ছায়া ঘনায়।
গর্জনশীল শহরে চুঁই চুঁই করে ডাকতে থাকা ছোট্ট পাখিটাকে খুঁজে ফেরে ক্লান্ত তরুণের বৃদ্ধ চোখ। একটা বল, দুইটা বল, বড়, ছোট, এদিক, ওদিক, হাউজ দ্যাট? ক্যাচ, আউট, গোল, হুল্লোড়। দুষ্ট ছেলের দলের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। আযানের শেষে সূর্যডোবা আলোয় ধুলোপায়ে বাড়ি ফেরা বালকের মনে যখন বৃষ্টি নামে, এখানে তখন ১১ তলায় বিষণ্ন তরুণ চাতকের মত জল খোঁজে বাজপাখির চোখে।
এ শহর ছেড়ে একদিন পালাতে হবেই, নাগরিক মূলধন নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখার অনেকদিন তো হয়েই গেল, সবুজ খড়কুটোর মাঝে ছাই হয়ে ফিরে যাবার আশায় তাই নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকি মেঘের অরণ্যে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।