রঙ্গিলা বন্ধুরে....... i_mahmud2008@yahoo.com
মনু নদীতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি স্মৃতির স্মৃতিচিহ্ন
প্রায় দেড় মাসেও মডেল কন্যা স্মৃতিকে
উদ্ধার করা যায়নি
ইসমাইল মাহমুদ, মৌলভীবাজার থেকে
মৌলভীবাজার তথা সিলেট বিভাগে বর্তমান সময়ের আলোচিত ঘটনা মডেল কন্যা সাইফ বিনতে স্মৃতি’র নিরুদ্দেশ রহস্য এখনো উদঘাটিত হয়নি। কথিত দূর্ঘটনার প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও এখনো স্মৃতিকে জীবিত অথবা মৃত উদ্ধার করা যায়নি। মনু নদীতে তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি স্মৃতির কোন স্মৃতিচিহ্ন। এ নিরুদ্দেশ ঘটনা নিয়ে মৌলভীবাজার জেলার সর্বত্র এখনো চলছে আলোচনার ঝড়। সাধারণ মানুষের বদ্ধমূল ধারনা মনু নদীতে নিমজ্জিত স্মৃতি ও তার বন্ধুদের বহনকারী প্রাইভেট গাড়িতে স্মৃতি ছিলো না।
তাকে হয়তো অন্যত্র পাচার অথবা হত্যা করে ফেলে আসা হয়েছে এমন ধারনাও করছেন অনেকেই। এমনকি স্মৃতির মা মলি আক্তার আমেনা এবং বাবা কে. এম. সাইফ আফজালও ধারনা করছেন, সেই দুর্ঘটনার আগেই স্মৃতিকে সিলেট শহর বা তার কাছাকাছি এলাকা থেকে অপহরন করে লুকিয়ে রাখে তারেক ও তার সহযোগীরা। পরে এ ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই সড়ক দুর্ঘটনার নাটকটি সাজানো হয়েছে। তাদের দাবি, মৌলভীবাজার মনু নদীর ১৫/২০ ফুট উঁচু বাঁধ ডিঙ্গিয়ে স্মৃতিদের বহনকারী প্রাইভেট কারটি মনু নদীতে নিমজ্জিত হবার পর স্মৃতির সফরসঙ্গী ৫ সহযাত্রী গাড়ির দরজা খুলে নিরাপদে বেড়িয়ে আসলেও শুধুমাত্র স্মৃতি নিরুদ্দেশ থাকা রহস্যজনক। তাছাড়া স্মৃতি ছোটবেলা থেকে একজন দক্ষ সাতারুও।
মনু নদীর পানির স্্েরাতও বেশি ছিলো না। দুর্ঘটনার সময় যদি স্মৃতি আসলেই গাড়িতে থাকত তাহলে সে সাঁতরে তীরে উঠতে পারত। মডেল কন্যা স্মৃতি মৌলভীবাজার এসে নদী গর্ভে তলিয়ে গেছে, না তাকে ভারতে পাচার করা হয়েছে? নাকি মডেল স্মৃতির ভ্রাতা সিনহাকে বিষ্কুটের সাথে চেতনা নাশক ঔষধ খাইয়ে সিলেট থেকে আসার পথে স্মৃতিকে বিক্রি করা হয়েছে? এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্মৃতির পরিবার, স্বজন ও মৌলভীবাজারবাসীর মনে। স্মৃতির নিরুদ্দেশ ঘটনা নিয়ে গত প্রায় দেড় মাস যাবতই মৌলভীবাজারের সর্বত্র চলছে তোলপাড়। রহস্যময় স্মৃতি নিরুদ্দেশ ঘটনা নিয়ে সাপ্তাহিক ২০০০-এর এ প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনটি রচনা করেছেন আমাদের মৌলভীবাজার সংবাদদাতা ইসমাইল মাহমুদ।
ছবি চৌধুরী ভাস্কর হোম।
¬¬
কিভাবে ঘটেছিল দূর্ঘটনা?
স্মৃতির ভ্রমণসঙ্গীদের জবানীতে জানা যায়, ১৮ অক্টোবর বিকেল ৫ টায় স্মৃতিদের বহনকারী প্রাইভেট কার (নং ঢাকা মেট্রো-খ ১১-৫৯৪৩) সিলেট থেকে মৌলভীবাজারের উদ্দেশ্যে আসার পথে শেরপুর-মৌলভীবাজার সড়কের সদর উপজেলার বালিকান্দি খেঁয়াঘাট সংলগ্ন এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ১৫/২০ ফুট উঁচু বাঁধের উপর দিয়ে মনু নদীতে পড়ে যায়। গাড়িটি পানির নীচে তলিয়ে যাবার মুহুর্তে গাড়ির চালক শামিম মিয়া, সৈকত, মডেল কন্যা স্মৃতির ভাই সিনহা ও তারেক গাড়ির দরজা খোলে বের হতে পারলেও মডেল কন্যা স্মৃতি পানির তলদেশে হারিয়ে যান। দূর্ঘটনার কিছুক্ষন পর বালু বহনকারী একটি নৌকার মাঝি নদী থেকে স্মৃতির কথিত ধর্ম ভাই ফরহাদ বিন তানভির নামক আরোও একজনকে উদ্ধার করে।
কিন্তু মডেল কন্যা স্মৃতিকে জীবিত অথবা মৃত উদ্ধার করা যায়নি। এ বৎসর এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন-এ প্লাস প্রাপ্ত মডেল কন্যা স্মৃতি এখনো রহস্যজনক কারনে নিখোঁজ রয়েছেন।
সবাই আছে, স্মৃতি নেই-
দূর্ঘটনার পর তারেক ও সৈকতের বক্তব্য থেকে জানা যায়, দুর্ঘটনার সময় স্মৃতি, তারেক ও সৈকত পেছনের সিটে বসেছিল। সামনের ড্রাইভিং সিটে ছিল তানভীর। পাশের সিটে বসা ছিল চালক শামীম।
তার কোলে বসা ছিল স্মৃতির ছোট ভাই সিনহা। মৌলভীবাজার ফায়ার ব্রিগেড এর ষ্টেশন অফিসার কৃষ্ণ কুমল দেব সাপ্তাহিক-২০০০ কে জানান, দূর্ঘটনার পর পরই মনু নদীতে ব্যাপক তল্লাশী চালানো হয়। রাতে গাড়ি উদ্ধার করা হলেও কোন মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। এমনকি ঢাকা থেকে ডুবুরী দল এনেও তল্লাশী চালানো হয়। তিন দিন ডুবুরী দল, মৌলভীবাজার ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ও এলাকাবাসী বহু প্রচেষ্টা চালালেও কোন মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
দূর্ঘটনার সাথে সাথে নদী থেকে উদ্ধারকৃত আহত দু’জনকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, সিনহা ও তানভীরকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। ঘটনার পরদিন স্মৃতির ভ্রমণসঙ্গী তারেক ও সৈকত সাপ্তাহিক-২০০০ কে জানায়, দূর্ঘটনা কবলিত গাড়ি থেকে আমরা কিভাবে বের হয়েছি তা নিজেও জানি না। তারেক জানায়, স্মৃতি গাড়ির পেছনের সিটে তার কাঁধে হেলান দিয়ে গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলো।
পেছনের সিটে বাম পাশে স্মৃতি মাঝখানে তারেক ও ডান পাশে সৈকত বসেছিল। দরজার পাশে থেকেও স্মৃতি বেরোতে পারলো না কিন্তু মাঝখানে বসা তারেক স্মৃতিকে টপকে কিভাবে বের হলো এ প্রশ্ন করলে তারেক নিরুত্তর থাকে।
গাড়ি উদ্ধার ও ব্যাগ নিয়ে নাটক!
দূর্ঘটনার পর ওইদিন রাত আনুমানিক ১০ ঘটিকার সময় মৌলভীবাজার ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা স্থানীয় জনতার সহায়তায় মনু নদী থেকে দূর্ঘটনা কবলিত প্রাইভেট কারটি উদ্ধার করে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গাড়ির ভেতর থেকে দু’টি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। স্মৃতির মায়ের কাছে একটি ব্যাগ দেয়া হয়েছে।
ওই ব্যাগের সঙ্গে স্মৃতির মোবাইল ফোন সেট, আয়না-চিরুনি, সাজগোজের নানা সরঞ্জামাদি স্মৃতির মাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। মোবাইলের মেমোরি কার্ড ও সিমকার্ড তদন্তের স্বার্থে থানা পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়। অন্য ব্যাগের ব্যাপারে স্মৃতির মাকে কোন কিছুই জানানো হয়নি। ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, উদ্ধারকৃত দু’টি ব্যাগেই মেয়েদের পোশাক-আশাক ছিল। ভ্যানিটি ব্যাগটি স্মৃতির মাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
অন্য ব্যাগে স্মৃতির কামিজ-সেমিজ, অর্ন্তবাস থাকলেও তারিকুল ইসলাম তারেক দাবি করেন ব্যাগটি তার। তারেকের ব্যাগে থাকা স্মৃতির জামা-কাপড় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা রহস্য। মৌলভীবাজার মডেল থানার একজন ঊর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওই ব্যাগে ঘটনার অনেক ক্লু পাওয়া যেতে পারে। এ জন্যই গাড়ি দুর্ঘটনা মামলার তদন্তকারী অফিসার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) মোঃ হারুনুর রশিদ ব্যাগটি তার হেফাজতে রেখেছেন।
মামলা দায়ের
দূর্ঘনার ব্যাপারে ২০ অক্টোবর মৌলভীবাজার মডেল থানার এস,আই আবুল হাসিম বাদি হয়ে গাড়ি চালক শামিমকে আসামী করে বাঃ দঃ বিঃ আইনের ২৭৯/৩৩৮(ক) ধারায় মামলা দায়ের করেন।
মামলা নং ১৯। শামিমের বক্তব্য অনুযায়ী দূর্ঘটনার সময় গাড়ি ড্রাইভ করেছিল স্মৃতির ধর্মীয় ভাই তানভীর। এ কারণে তারভীরকে আসামী করে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছিল। শামিম ও তানভীর আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে যায়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মৌলভীবাজার মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর শাহ হারুনুর রশীদ এ ঘটনাকে একটি নিচক দূঘটনা বলে মন্তব্য করে বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে অতিরঞ্জিত করে তুলা হচ্ছে।
তবে তিনি স্বীকার করেন, স্মৃতির লাশ এখনো না পাওয়ায় সন্ধেহ ঘনীভূত হচ্ছে।
তারেক-সৈকত কোথায়?
ঘটনার ব্যাপারে দায়েরকৃত মামলায় স্মৃতির ভ্রমণসঙ্গী তারেক ও তার সহযোগী সৈকতকে আসামী করা হয়নি। ফলে তারা অতি সহজেই পার পেয়ে যায়। স্মৃতির পরিবার ও স্বজনরা জানতে চায় তারেক ও সৈকত এখন কোথায়? স্মৃতির পরিবার ও স্বজনদের প্রশ্ন, স্মৃতি জীবিত না মৃত এ রহস্যের কোন কূলকিনারা না করেই পুলিশ তাদের ছেড়ে দিলো কেন? তাদের দাবি, স্মৃতির সাথে ভ্রমণে যাওয়া সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে স্মৃতি নিরুদ্দেশ রহস্যের আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, তারেক ও সৈকত দূর্ঘনাস্থল মৌলভীবাজার থেকে ঢাকায় ফিরে গিয়ে কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখছে না।
স্মৃতির পিতার বক্তব্য
স্মৃতির পিতা কে.এম. সাঈফ আফজাল বলেন, ‘ওরা পাচারকারী। আমার মেয়েকে কৌশলে অপহরণ করে পাচার করে দিয়েছে তানভীর, সৈকত, তারেকরা। আমি আমার কন্যা স্মৃতিকে সুস্থ্য অবস্থায় ওদের কাছ থেকে ফেরত চাই’। তিনি আরোও বলেন, ‘আমার বিশ্বাস স্মৃতি এখনো বেঁচে আছে। তারেক, তানভীর আর সৈকতকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।
স্মৃতির নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন কে.এম. সাঈফ আফজাল। তিনি বলেন, রহস্য উদঘাটনে পুলিশ তেমন তৎপর নয়। ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে স্মৃতি নিরুদ্দেশ ঘটনাটি। স্মৃতির বন্ধু সেজে আমার পরিবারের সাথে মিশে স্মৃতিকে ব্ল্যাকমেইল করে নিয়ে যায় সিলেটে। সেখানে আমার মেয়ের আপত্তিকর ছবি তুলেছে।
তিনি দাবি করেন সিলেট থেকে ফেরার পথে কৌশলে রাস্তা বদল করে এ দুর্ঘটনার নাটক সাজানো হয়েছে। কথিত এ দুর্ঘটনার সময় স্মৃতি গাড়িতে ছিল না বলে দাবি করেন তিনি। এছাড়া স্মৃতি নদীর পানিতে তলিয়ে গেলে অন্তত তার জুতা জুড়ো পানির উপরে ভেসে উঠতো। স্মৃতির পিতা বলেন, আমার বিশ্বাস হযরত শাহজালালের (রহ.) পবিত্র ভূমিতে কোন অপরাধীই অপরাধ করে গোপন রাখতে পারে না। তার দাবি, সিলেটে গিয়ে একটি চা বাগানে তানভীর, সৈকত, তারেক স্মৃতিকে জোর করে নিয়ে যায়।
সিলেট ভ্রমণের সময় স্মৃতি মারাত্বকভাবে অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিল। তারপরও তানভীর, সৈকত, তারেকরা তাকে রেহাই দেয়নি। জোর করে চা বাগানে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, আমি আমার একমাত্র ছেলে সিনহাকে সিলেট ভ্রমণের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। সিনহা জানিয়েছে, তাকে সৈকতরা সামনের সিটে তানভীরের কোলে বসিয়ে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল।
তাকে গাড়ির পেছনের সিটে তাকাতে দেয়া হয়নি। সিলেট হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজার শরীফের সন্নিকটে একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর সিনহা গাড়ির ভেতরে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
মৌলভীবাজার বাসীদের প্রতি স্মৃতির পিতার কৃতজ্ঞতা
মডেল কন্যা স্মৃতির পিতা কে. এম. সাঈফ আফজাল মৌলভীবাজারবাসীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কথিত এ গাড়ি দূর্ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন স্মৃতিকে খুঁজতে নিজেদের টাকা পয়সা ব্যয় করেছেন। নিজ উদ্যোগে জেনারেটর জ্বালিয়ে রাতের পর রাত মনু নদীতে নৌকা নিয়ে খুঁজেছেন।
অনেকেই তাকে সহমর্মিতা জানিয়ে তাদের বাড়িতে পুরো পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি সকলের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
ছবি : সিলেট ভ্রমণকালে বয়ফ্রেন্ডদের সাথে তোলা মডেল কন্যা স্মৃতির ছবি (ছবিগুলো মডেল কন্যা স্মৃতির ব্যক্তিগত মোবাইলের মেমোরি কার্ড থেকে সংগ্রহীত)
ইসমাইল মাহমুদ
মৌলভীবাজার
০১৭১৫-১৭১৯৫০
০১১৯৬১২৮৫১৩
তারিখ : ২৮/১১/২০০৯ইং
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।