আমি অবাক চোখে বিশ্ব দেখি, দৃশ্য সাজাই চোখের তারায়......
শাকিল ফারুক
সিরাজ স্যার কাসে ঢোকামাত্রই ক্লাসের সব গুনগুনানি থেমে গেল। সবাই উঠে দাঁড়লো। একজন বাদে। সেই একজন হচ্ছে বল্টু। স্যার ক্লাসে ঢোকার আগে থেকেই সে ভীষণ মনোযোগ সহকারে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল বাইরে।
স্কুলের মাঠের দিকে। মাঠে একটা গরুর বাছুর লাফালাফি করছে। সেটাকে দেখছিল, আর বল্টু ভাবছিলো, আহা, গরুর কী শান্তি! কোন স্কুল নেই। পড়ালেখা নেই। সারাদিন মাঠে- ঘাটে ঘোরাঘুরি।
কী আনন্দ! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে বল্টুর মনে হলো মানুষ না হয়ে ওই গরু হওয়াই ভালো ছিলো। তাহলে মাঠে- ঘাটে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো যেত। আর স্কুলে আসতে হতো না। মানুষ না হয়ে গরু হবার ভাবনায় মত্ত থাকায় কখন স্যার কাসে এসেছেন, কখন সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে, সে খবরই পায় নি বল্টু। কিন্তু স্যার ঠিকই খবর পেলেন, মানে দেখে ফেললেন যে বল্টু দাঁড়ায় নি।
সিরাজ স্যার তার বিখ্যাত (অথবা কুখ্যাত) বেতটা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন বল্টুর বেঞ্চের পাশে। পুরো কাস নীরব। সবার চোখ বল্টুর দিকে। সিরাজ স্যার গম্ভীর গলার জিজ্ঞেস করলেন, এ্যাই বাইরে কী দেখছিস?
স্যারের কথা বল্টুর কানেই গেল না। সে মুগ্ধ চোখে গরুর বাছুড়ের দিকেই চেয়ে রইলো।
স্যার প্রশ্নের জবাব না পেয়ে দারুণ রেগে উঠলেন। হাতের বেত দিয়ে জোরে বাড়ি দিলেন বেঞ্চে আর বললেন, আমার কথা কানে ঢোকে না? জবাব দিচ্ছিস না কেন? আমার সাথে বেয়াদবি! জানসি না আমি কে?
স্যারের গর্জন আর বেতের বাড়ি শুনে চমক ভাঙলো বল্টুর। সে ঘুরেই স্যারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। স্যার রক্তচোখে ওর দিকে চেয়েই রইলেন, স্যারের প্রশ্ন বোঝে নি বল্টু। চোখ ইশারায় সে পাশের বেঞ্চের নজরুলের কাছে জানতে চাইল ব্যাপার কী? নজরুল ঠোঁট নেড়ে নিঃশব্দে জিজ্ঞেস করলো, বাইরে কী দেখছিলি?
বল্টু ভাবলো স্যার বুঝি তাকে জিজ্ঞেস করেছেন বাইরে কী দেখছিলি।
বল্টু চটপট উত্তর দিল, গরুর বাছুর।
বল্টুর জবাব শুনে স্যার মনে করলেন বল্টু তাকে `গরুর বাছুড়' বলেছে। স্যার একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আর হাতের বেত দিয়ে বল্টুকে দিলেন ইচ্ছেমতো মার। মার খেয়ে বল্টু আর্তনাদ করবে কী একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল।
সে ভেবে পেল না স্যার তাকে কেন মারলেন! বাইরে তাকিয়ে সে গরুর বাচুড় দেখছিলো। গরুর বাছুড় দেখা কী কোন অপরাধের মধ্যে পরে? ভেবে পেলো না সে।
স্যার বল্টুকে পিটিয়েই ক্ষান্ত হলেন না। সেই সাথে বিচার দিলেন হেডমাস্টারের কাছে। পরের কাশে হেড মাষ্টার ডাকালেন বল্টুকে।
বল্টু ভয়ে ভয়ে গেল হেড মাস্টারের রুমে। হেডমাস্টার বল্টুর দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে বললেন, তুমি নাকি সিরাজ স্যারকে অপমান করেছো?
বল্টু বললো, না স্যার।
বল্টুর জবাব শেষ হওয়া মাত্রই হেডমাস্টার খপ্ করে বল্টুর ডান কানটা ধরে মলে দিয়ে বললেন, মিথ্যুক যেন কোথাকার স্যারকে উল্টাপাল্টা কথা বলিস আবার মিথ্যা কথা বলিস, না? কাল স্কুলে আসার সময় বাবাকে সাথে করে নিয়ে আসবি নইলে স্কুলে আর তোকে রাখব না, বের করে দেব।
স্কুল ছুটির পর বল্টু পড়লো মহা ভাবনায়। কাসের সবাই তার দিকে তাকিয়ে হাসে।
কারণ কী কেউ বলে না। তবে বল্টু এই ব্যপার নিয়ে তেমন চিন্তা করলো না। সে চিন্তিত অন্য ব্যপার নিয়ে। বাবাকে গিয়ে যদি সে বলে, স্কুলে আসতে হবে। তাহলে বাবা জানতে চাইবেন কেন স্কুলে আসতে হবে।
তখন বল্টু কী বলবে? কারণ সে তো নিজেই বুঝতে পারছে না ঘটনা কী! তবে স্কুলে এলে বাবাকে যে তার সম্পর্কে খুব কোন কথা বলবে না এটা নিশ্চিত এবং কোন খারাপ কথা যদি বাবা শোনেন তাহলে খবরই আছে। এখন সে কী করতে পারে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বল্টু সিদ্ধান্ত নিল সে আর বাড়ি ফিরে যাবে না, আর কখনও স্কুলেও যাবে না। সে বনে চলে যাবে। সেখানে গিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাবে। উল্টো হয়ে গাছে ঝুলে ধ্যান করে জীবন পার করে দেবে, যেই ভাবা সেই কাজ।
বল্টু বাড়ির পথ ছেড়ে হাঁটা দিল বনের পথে।
বল্টুদের গ্রামের একেবারে শেষ মাথায় আছে একটা বিশাল বন। সে বনে থাকে নানা হিংস্র পশুপাখি। বনের অন্যপ্রান্তে আরেক গ্রাম। সেই গ্রামে হঠাৎ কোথা থেকে যেন এক মাংসাশী বাঘ এসে হাজির হয়েছে।
সারাদিন সে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে, আর রাত্রে এসে গ্রামের বাসিন্দাদের গরু ছাগল ধরে নিয়ে যায়। কেউ বাঘকে কিছু করতে পারছে না। সবাই ভয়ে তটস্থ।
সেই ভয়ের মধ্যে যেন রাফিক মুন্সির মাথায় মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা এসে পড়েছে। গতকাল তার দুই দুটো ষাঁড় ধরে নিয়ে গেছে মরার বাঘ।
আর আজ ফসলের েেত দেয়ার জন্য পানিতে বিষ গুলে রেখেছিলেন তিনি, কোথা থেকে এসে দুধেল গাভিটা সেই বিষ মেশানো পানি খেয়ে ফেললো এবং তারপর যা ঘটার তাই ঘটলো। বিষের বিষক্রিয়ায় মারা গেল গাভী। মাথায় হাত দিয়ে কতণ বিলাপ করল রাফিক মুন্সী। তারপর গাভীর মরাদেহ বাড়ির উঠোনে ফেলেই ঘরে গিয়ে ঢুকলো। কারণ সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
বাঘটার আসার সময় হয়েছে। কাল সকালে গরুর লাশের বন্দোবস্ত করা যাবে, আগে নিজে বেঁচে নেয়া যাক।
রাফিক মুন্সী ঘরে ঢোকার কিছুণ পরেই এসে উপস্থিত হলো বাঘ। দেখল উঠানে পড়ে আছে গরু। তাই আর হামতাম না করে সেটাকেই খাওয়া শুরু করল।
যখন অর্ধেক খাওয়া শেষ হল ঠিক তখনি বাঘের শরীরের ভেতর যেন কেমন এক যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। গরুর সারা শরীরে বিষ ছড়িয়ে গেছে। তাই বাঘ গরুর মাংস খেয়ে ফেলার কারণে তার ভেতরেও বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। সে খাওয়া বাদ দিয়ে দৌড়ে ঢুকলো বনের ভেতর। তারপর একটা গাছের নিচে স্থির হয়ে বসে থাকল।
আর ছোটাছুটির জোর পেল না। গাছের নিচে বসেই বাঘ মারা গেল।
বল্টু যখন বনে এসে ঢুকল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সব দিকে অন্ধকার নেমেছে। অন্য সময় হলে বল্টু ভয়ে একটা কিছু করেই ফেলত।
তবে এখন তার মনে জেদ। তাকে সন্ন্যাসী হতে হবে। সেই জেদ দিয়ে সে ভয়কে জয় করেছে। তাই বনে ঢুকে ভয় না পেয়ে সে চিন্তা করতে লাগলো এখন কী করা যায়! ভেবে টেবে সিদ্ধান্ত নিল সে গাছে উল্টো হয়ে ঝুলে থাকবে। গল্পের বইতে সে পড়েছে সাধুরা উল্টো হয়ে গাছে ঝোলে।
বল্টু মোটামুটি বড় আকারের একটা গাছ পচ্ছন্দ করে তাতে চড়ে বসল। তারপর একটা মোটা ডাল বেছে বের করে, বহু কসরতের মাধ্যমে তাতে উল্টো হয়ে ঝুলে পড়ল। ঝুলে পড়ার পরই তার চোখ গেল গাছের গোড়ার দিকে। আধো অন্ধকারে সে দেখল গাছের গোড়ায় একটা বাঘ বসে আছে। এতণ ভয় না পেলেও বাঘ দেখে ভয়ে বল্টুর আত্মরাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়।
ভয়ে সে কাঁপতে লাগল। আর সে কাঁপুনির চোটে ডাল ভেঙ্গে বল্টু পড়ল নিচে। পড়েই সে জ্ঞান হারালো।
বল্টুকে খুঁজে খুঁজে দিশেহারা ওর বাবা-মা। আর তাদের সাথে আরো অনেক খোঁজাখুঁজি শুরু করল।
বল্টুকে খুঁজতে খুঁজতে ক’জন বনে ঢুকে পড়ল। বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ তারা দেখতে পেল বিশাল এক বাঘ নিথর হয়ে আছে। তারপাশে একটা ভাঙা ডাল নিয়ে শুয়ে আছে বল্টু। তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো, হাত দিয়ে ধরে বুঝলো বাঘটা মৃত। তবে বল্টু জীবিত।
তা দেখে তারা বুঝে নিলো যে বল্টু এই ভাঙা ডাল দিয়ে পিটিয়েবাঘটাকে মেরেছে। বল্টুকে পাজাকালো করে সবাই মিলে গ্রামে নিয়ে এলো। সেই সাথে বাঘের মৃত দেহটাও। তারপর শুরু হলো কাহিনী। বাঘের মৃত দেহ দেখিয়ে সবাই বর্ণনা শুরু করলো বল্টুর শিকার কাহিনী।
বল্টু জ্ঞান ফেরার পর সবার মুখে ে
সই
শিকার কাহিনী শুনে সিনজেই শিউরে উঠলো আর মুখ টিপে হাসলোও।
যাই হোক যে এত বড় একটা বাঘ একা পিটিয়ে মারতে পারে সে তো কোন যে সে মানুষ হতে পারে না। তাই বল্টুকে সবাই একটু আলাদা চোখে দেখতে শুরু করলো। সবাই তাকে ভয় পেতে লাগলো, শ্রদ্ধা করতে লাগলো। বল্টুকে প্রায়ই আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষজন দেখতে আসে।
বল্টু ‘বাঘমারা পালোয়ান’ নামে পরিচিতি পেয়ে গেলো। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মানুষজন মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে একে অন্যকে ফিসফিসিয়ে বলে, ওই দেখ বাঘমারা পালোয়ান যায়। এই কথা শুনে বল্টু ভাব নিয়ে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। মনে মনে হাসে আর ভাবে গিয়েছিলাম সন্ন্যাসী হতে, হয়ে গেলাম পালোয়ান!
তবে আসল ঘটনা সে কাউকে বলে না। কারণ একটু আলাদা গূরত্ব পেতে কার না ভালো লাগে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।