নিজেকে কবি বলে পরিচয় দিতে ভাল লাগে। ভালবাসি দেশকে।
আমাদের জাতীয় পতাকার ইতিহাস
ইউসূফ সালাহউদ্দীন আহমদ:
‘আমাদের সময়’ ১৭ নভেম্বর ২০০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা পদক: শিবনারায়ণ দাস ও আমাদের দায়ভার’ শীর্ষক লেখাটি পড়লাম। আমি লেখককে তার খণ্ডিত সত্য বক্তব্যের জন্য দোষারোপ করব না। তবে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিবনারায়ণ দাস, আমার প্রিয় শিবুদা এই লেখাটি প্রকাশের আগে দেখেননি সেটাই আশা করব।
কারণ তিনি যদি দেখতেন তাহলে নিশ্চয়ই বাংলাদেশের পতাকার ইতিহাস সম্পর্কে এই ভুল এবং একপেশে বক্তব্য ছাপাতে দিতেন না।
আসুন দেখি বাংলাদেশের পতাকা তৈরির প্রকৃত ইতিহাস কী? আশা করি শিবুদা এবং আরো যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা আমার সঙ্গে একমত হবেন।
১৯৬৯ সাল। ঢাকা সেনানিবাসের ১৪ পদাতিক বাহিনীর সদর দফতরে স্থাপিত ট্রাইবুনালে তখন বিচার চলছিল তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ আসামিদের। ’৬৯-এর চলমান ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি সামরিকচক্র যখন বুঝতে পারল এই মিথ্যা প্রহসনের মামলা আর চালিয়ে যেতে পারবে না তখনই তারা সামরিক ব্যারাকে বন্দি সার্জেন্ট জহুরুল হককে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে।
অজুহাত তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সেদিন ছিল ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি।
আমরা যারা সেদিন রাজপথে আন্দোলন করছিলাম এবং বুকের মাঝে এক স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করছিলাম তাদের কাছে সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যাকাণ্ড ছিল সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দামামা।
ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের তোড়ে ভেস্তে যায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পাতানো বিচারের খেলা। বাংলার সংগ্রামী জনতা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ছিনিয়ে আনে কারাগার থেকে।
পাকিস্তানি সেনা প্রশাসনের এ পরাজয়ের পটভূমিতে ক্ষমতার হাত-বদল হলো আর একবার। ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ আইয়ুব খানের স্থলাভিষিক্ত হলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। জারি করলেন ফের মার্শাল ল’। সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হলো।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ছিল একটি নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ১১ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করে। এ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের আড়ালে ছাত্রলীগের একটি হার্ডকোর গ্র“প সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শিবুদা, আমি ও আরো অনেকে এ গ্র“পে সক্রিয় ছিলাম। প্রয়াত কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত অন্য সময় লিখব।
ইয়াহিয়ার মার্শাল ল’ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বন্ধ করলেও ছাত্রলীগের এ হার্ডকোর গ্র“পের প্রস্তুতি থাকে অব্যাহত। সার্জেন্ট জহুরুল হকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিন স্মরণে আমরা গঠন করলাম ‘ফেব্র“য়ারি ১৫ বাহিনী’। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে পরিকল্পিত প্রথম সশস্ত্রবাহিনী।
১৯৬৯-এর শেষের দিকে ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। তদনুযায়ী ’৭০-এর জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করেন ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস ৭ জুন। ঐ দিন রেসকোর্স ময়দানে প্রথম নির্বাচনি সভার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম ঐ দিন পল্টন ময়দানে (রেসকোর্সে সভার আগে) কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে বাহিনী পতাকা (রেজিমেন্টাল কালার) গ্রহণ করে ‘ফেব্র“য়ারি ১৫ বাহিনী’ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করবে।
শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামোয় লালিত বিপুলসংখ্যক হার্ডকোর সদস্য তৈরি করা হলো ৭ জুন ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থেকে মিছিল করে পল্টন ময়দানে যাওয়ার জন্য।
এখন প্রশ্ন হলো কেমন হবে বাহিনী পতাকা। এই বাহিনীর সঙ্গে নেতৃস্থানীয় যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে আসম আব্দুর রব, কাজী আরেফ আহমেদ, শেখ শহিদুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি), হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, চিশতি শাহ্ হেলালুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ, শিবনারায়ণ দাস, আব্দুল্লাহ সানি, মইনুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম ফারুক, ফিরোজ শাহ্, খসরু ভাই (পুরো নাম মনে নেই) উল্লেখযোগ্য।
পতাকা তৈরি নিয়ে মিটিংয়ে বসলাম আমরা ইকবাল হলের ১০৮ নং কক্ষে। এ কক্ষটি বরাদ্দ ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আসম আব্দুর রবের নামে। কাজী আরেফ আহমেদের প্রস্তাব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হলো পতাকায় সবুজ জমিনের ওপর থাকবে একটি লাল বৃত্ত, আর লাল বৃত্তের মাঝে থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র।
সবুজ জমিন বাংলার চির সবুজের প্রতীক, লাল সূর্য রক্তে রাঙা হয়ে উঠবে স্বাধীনতার সূর্য আর জন্ম নেবে একটি নতুন দেশ। সোনালি আঁশের রঙে হবে তার পরিচয়। লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালি রঙ্গের মানচিত্র তারই প্রতীক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই কাজে নেমে পড়লাম। খসরু ভাই গেল তখন বলাকা সিনেমা হলের চারতলায় এক বিহারি দরজির দোকানে।
বড় এক টুকরা সবুজ কাপড়ের মাঝে সেলাই করে আনলেন লাল বৃত্তাকার সূর্যের প্রতীক। এখন হলো আরেক সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সিদ্ধান্ত হলো ওটা লাল বৃত্তের মাঝে রঙ দিয়ে আঁকা হবে। আঁকাআঁকিতে কুমিল্লার শিবুদার হাত ছিল ভালো।
তিনি বললেন ‘আমি বাপু পেইন্ট করতে পারব, তবে মানচিত্র আঁকতে আমি পারব না’। কী করা যায়? ঠিক করলাম হাসানুল হক ইনু আর আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ট্রেসিং পেপারে ট্রেস করে নিয়ে আসব। আমরা গেলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ্ হলে (বর্তমানে তিতুমীর হল)। উল্লেখ্য, আমি এবং ইনু ভাই উভয়েই তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জিন্নাহ্ হলে ৪০৮ নং কক্ষে থাকেন এনামুল হক (ইনু ভাইয়ের কাজিন)।
তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিলাম। ট্রেসিং পেপারে আঁকলাম পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। নিয়ে এলাম ইকবাল হলের ১০৮নং কক্ষে। বাকি সবাই সেখানে অপেক্ষা করছিল। শিবুদা তার নিপুণ হাতে ট্রেসিং পেপার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে।
তাতে দিলেন সোনালি রঙ। তৈরি হয়ে গেল ফেব্র“য়ারি ১৫ বাহিনীর পতাকা।
পরদিন অর্থাৎ ৭ জুন আমরা আসম আব্দুর রব ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে সুশৃঙ্খল মিছিল নিয়ে ইকবাল হল থেকে গেলাম পল্টন ময়দানে। সেখানে মঞ্চে দাঁড়ানো ‘বঙ্গবন্ধু ফেব্র“য়ারি ১৫ বাহিনী’র অভিবাদন গ্রহণ করলেন এবং বাহিনীর পক্ষে আসম আব্দুর রব ইকবাল হলের ১০৮ নং কক্ষে তৈরি পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে গ্রহণ করলেন আনুষ্ঠানিকভাবে। এই সেই পতাকা যা উড়ল বাংলার ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলার পতাকা হয়ে।
এই পতাকাটিই ১৯৭১ সালে ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে বিশাল ছাত্র জমায়েতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ পতাকা থেকে বাংলাদেশের মানচিত্রটি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আমি এখানে যাদের নাম উল্লেখ করেছি তাদের মাঝে যারা আজো বেঁচে আছেন তারা এই ইতিহাসের সাক্ষী।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।