সমাজে ওরা খুব অবহেলিত, সভ্য মানুষরা ওদের বলে হিজড়া । হিজড়া শব্দটি এসেছে আরবী হিজরত বা হিজরী শব্দ থেকে যার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন বা মাইগ্রেট বা ট্রান্সজেন্ডার। ট্রান্সজেন্ডার বলতে এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থাকে বুঝায় যা দৈহিক বা জেনিটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোন শ্রেণীতে পড়ে না । ইংরেজিতে হিজড়ার প্রতিশব্দ হিসেবে ইউনাক শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যার অর্থ নপুংসক বা খোজা । বাংলা অভিধানে বলা হয়েছে হিজড়া শব্দটির আগমন হয়েছে হিন্দি থেকে ।
সংস্কৃত ভাষায় নপুংসক শব্দটি পাওয়া যায় । প্রকৃতপে হিজড়া শব্দটি অশোভন মনে হলেও বাংলাতে হিজড়া বোঝানোর জন্য কোনও শোভন শব্দ পাওয়া যায়নি । সাধারণ অর্থে হিজড়ার অভিধানিক অর্থ বলতে আমরা বুঝি একই দেহে নারী ও পুরুষের চিহ্নযুক্ত মানুষ । যারা সন্তান উৎপাদনে অম । হিজড়া শব্দটি মুলত পুরুষ বাচক ।
যার স্ত্রী বাচক শব্দ হিজড়ানি হতে পারে । তবে হিজড়ার স্ত্রী বাচক শব্দটি একেবারেই কাল্পনিক । শারীরিক ভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিক ভাবে নারী বৈশীষ্ট্য এর অধীকারী হিজড়াদের বলা হয় অকুয়া । পৃথিবীতে কখন থেকে হিজড়াদের আবির্ভাব হয়েছে তা সঠিক জানা যায়নি। তবে নৃতত্ত্ববিদদের মতে, যখন থেকে পৃথিবীতে মানব জাতির আবির্ভাব তখন থেকেই হিজড়ার আবির্ভাব ।
বিশ্বে প্রতি ১৫ হাজার নবজাতকের মধ্যে অন্তত একজন (ইন্টারসেক্স ডি¯অর্ডার) এ রোগে আক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করছে। অনেক পিতামাতা লোকলজ্জা ও সামাজিকতার ভয়ে এসব শিশুকে ঘরে বন্দি করে রাখছে। এমনকি নির্মম হত্যাকাণ্ডেরও শিকার হতে হয়েছে এসব নি®পাপ শিশুকে। শিশু অবস্থায় লিঙ্গ সমস্যা বুঝতে না পারলেও একটু বড় হতেই বুঝতে পারে সৃষ্টিকর্তা পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে তাদের গড়েনি। ধীরে ধীরে সমাজ থেকে ছিটকে পড়তে থাকে তারা।
ঠাঁই হয় কোনো হিজড়াপল্লীতে। তারপর শুরু হয় মানবেতর জীবন। জীবন ধারণের তাগিদে ভিাবৃত্তি বা প্রতারণাসহ নানান ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয় এসব মানুষ। কবি ও সাহিত্যিকদের কলমেও আরেক উপেতি হচ্ছে হিজড়া স¤প্রদায়। তাদের সুখ-দুঃখ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি।
হিজড়া হওয়ার কারণে তাদের কে কেউ চাকরিতে নেয় না, কেউ ঘরভাড়া দিতে আগ্রহী হয় না । ভোটার তালিকায় তারা কেউ ছেলে বা মেয়ে হিসেবে ভোটার হয়েছেন । চলমান জন্মনিবন্ধন কার্যক্রমেও তাদের হিজড়া হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ নেই । চরম অভাব অনটনে তারা দিনাতিপাত করছে । হিজড়া বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানো কোন
শিশুর যদি পরিনত বয়সে যাওয়ার আগে চিকিৎসা করা হয় তাহলে বেশীভাগ েেত্রই তাকে সুস্থ করা সম্ভব ।
আমাদের দেশের হিজড়াদের অবস্থা
আমাদের দেশের ন্যায় বৈষম্যমূলক হিজড়া সমাজ ব্যবস্থা পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই । অন্যান্য দেশের হিজড়ারা তাদের পরিবারের সঙ্গেই বসবাস করেন। শারীরিক সমস্যার কারণে সবাই তাদেরকে উত্যক্ত করে হিংসাÍক করে তুলছে । হিজড়া হতে কখনো হিজড়া জন্মগ্রহণ করতে পারেনা । আমাদের যে কারো পরিবারেই হিজড়া সন্তান জন্মগ্রহণ করতে পারে ।
তারা কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় বলে অনেকেই দোকানে দোকানে টাকা চাঁদা নিয়ে জীবন-যাপন করের আবার অনেকেই বাঁচার জন্য যৌন কাজের সঙ্গে লিপ্ত হয় । তবে যদি ওদের কাজের সুযোগ দেয়া হয় তারা তাদের অনেকেই যৌন পেশা থেকে ফেরত আসবে বলেছে । বাংলাদেশে এক লাখেরও বেশি হিজড়া আছে । একজন হিজড়ার কাছে তার রক্তের স¤পর্ক বড় নয় । তার কাছে গুরুই সব ।
দলে ভিড়ে সে গ্রহণ করে বয়স্ক হিজড়ার শিষ্যত্ব । তাকে শ্রদ্ধা করে গুরু বলে । কারণ দলভুক্ত হয়ে থাকতে হলে তাকে গুরুর শিষ্য হতেই হবে ।
কিছু সত্য একটা ঘটনাঃ
(১)অমলা ছিল ভারতের একজন । সে হিজড়া হলেও ছিল অপূর্ব সুন্দরী স্বাভাবিকভাবে তাকে কেউ বুঝতে পারত না এবং সে স্বাভাবিক ভাবেই চলাফেরা করতে পারত ।
এভাবেই একদিন সে গ্রামের একটি বিয়েতে যায় সেখানে তাকে দেখে গ্রমের এক যুবক যার নাম কার্তিক । সে তাকে পরবর্তীতে বিয়ে করতে চায় কিন্তু অমলা তার সমস্যার জন্য কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না । তবে কার্তিকও নাছোড়বান্দা পিছু হটবার পাত্র সে নয় । শেষ পর্যন্ত আর কোন উপায় না দেখে অসলা এ ব্যাপারটি তাকে জানায় । সে জানার পরও তাকে বিয়ের ব্যাপারে পিছু হটে না তার যুক্তি শারীরিক এর চাইতে মনের ভালবাসা অনেক বড় তাই সে তাকে বিযে করবেই ।
এরপর অমলার পরিবারের সহযোগীতায় বিয়ে হয় কিন্তু কার্তিক সমাজ ও তার পরিবার থেকে বিতাড়িত হয় । তাদের বিযের পর বেশকিছুদিন গেলে কার্তিক একদিন পত্রিকা দেখে জানতে পাওে এরকম একটি শিশু চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়েছে এটা জানতে পেরে সে অমলাকেও সেখানে নিযে যেতে চায় । অমলা যেতে না চাইলও কার্তিকের জোরাজুরিতে সে হার মানে । সেই ডাক্তার অমলাকে দেখে জানায় এই বয়সে এটা চিকিৎসার মাধ্যমে সফল হওয়া অসম্ভব । কিন্তু কার্তিক এর আবেগ এর কাছে হার মেনে ডাক্তার তার সমস্যাটি দেখে এবং দেখার পর ডাক্তার অমলার অপারেশনের উদ্দ্যেগ নয় ।
অস্ত্রোপচার এর পর অমলা একজন স¤পূর্ণ নারীতে পরিনত হয় এবং পরবর্তীতে সে সন্তানের জন্মও দেয় । এ ব্যাপারে সেই ডাক্তারের অভিমত আসলে অমলার ব্যাপারটি তিনি কার্তিকের অনুরোধে দেখেন এবং দেখার পরই সে খেয়াল করে আসলে অমলার ত্র“টিটি খুবই সামান্য এবং তারমধ্য নারী বৈশিষ্ট্য প্রকট ভাবে বিদ্যমান তাই সে অস্ত্রোপচার করেন। তবে কার্তিক মনে করেন তার
ভালবার্সা জন্যই সৃষ্টিকর্তা তাকে পুরস্কৃত করেছেন ।
(২) আমেরিকাতে জর্জ নামে একটি ছেলের জন্মের ১৫ মাস পর থেকেই শারীরিক পরিবর্তন ল্য করা গেল এবং ধীরে ধীওে সে বালক থেকে বালিকা হয়ে গেল । পরিবার থেকে সবাই তাকে বোঝাল যে, তার পুরুষাঙ্গটা সৃষ্টিকর্তার একটা ভুল ছিল তাই সে ভুলটাকে শুদ্ধ করে তাকে পুনরায় নারী বানিয়ে দিয়েছে এতে লজ্জা বা দু:খ পাওয়ার কিছু নেই ।
জর্জের জন্য চিকিৎসা এমনকি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল । সে এখন নাম পাল্টেছে, পোশাক পাল্টেছে, এখন পুরোপুরি একজন নারী । আমাদের দেশেও চিকিৎসার সুযোগ পেলে অনেকেই নারী বা পুরুষ হিসেবে জীবন-যাপন করতে পারত।
কিছু কুসংস্কার
হিজড়া হওয়ার কারণ স¤পর্কে নানা কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে । কেউ এটাকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ বলে, কেউ বলে পিতামাতার দোষ কিংবা প্রকৃতির খেয়াল ।
কথিত আছে যখন কারো হিজড়ে বাচ্চা হয় তখন তা যদি হিজড়েরা জানতে পারে তবে তারা ওৎ পেতে থাকে তাকে নিজেদের দলে ভেড়ানোর জন্য। একসময় ঠিকই তাকে হিজড়াদের দলে নিযে যায় । আরো একটা কথা প্রচলিত আছে যদি না নিতে পারে তাহলে তারা দলবদ্ধভাবে এসে হাতেতালি বাজাতে থাকে যা তারা সবসময়ই বাজায় আর এ হাতেতালিতে নাকি কি এক অমোঘ আকর্ষন আছে যা শুনে অন্য হিজড়ারা আর ঠিক থাকতে পারেনা সেও এসে তাদের এই হাতেতালিতে যোগ দেয় যদিও এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নাই । (দণি এশিয়া) হিজড়ারা বেশীর ভাগ মুসলিম হলেও তারা হিন্দুদের এই পুজাটি করে যার মাধ্যমে তারা ভগবানের সাথে নিজের বিযে দেয় এরপর সারাদিন তারা সংসার সংসার খেলে । ওদের বিশ্বাস কোনও শিষ্য যদি তার শাড়ির আঁচল গুরুর মাথায় ছুঁয়ে দেয় তবে সেই শিষ্যও গুরু হয়ে যেতে পারবে।
গুরু তার শিষ্যদের সব কিছুর হর্তাকর্তা। অন্যায়, অবিচার, বিরোধের বিচারক। তার আদেশ, নিষেধ শিষ্যদের অবশ্যই মান্য । প্র্রত্যেক হিজড়াকে কবর দেয়া হয় তারা যে বিছানায় থাকে তার নিচে এটাই তাদের রীতি (তবে বর্তমানে স্থান সংকুলানের জন্য তাদের অন্যত্রও কবর দেয়া হয়) । ‘ তাদেও কবর দেয়ার নিয়মটি খুব অদ্ভুত তাদের কবরে প্রথমে ঢালা হয় লবন তারপর লাশ তারপর দেয়া হয় ফুল তারপর আবার লবন ।
এটার মূল কারন হল তাদের বিশ্বাষ এভাবে কবর দিলে তাদের আগের সকল পাপ ধুয়ে পরবর্তী জনমে তারা পূর্ণ নারী বা পুরূষ হিসেবে জন্ম গ্রহন করতে পারবে ।
হিজড়ারাও ভালবাসে
হিজড়াদের জীবনেও সাধারণ মানুষের মত প্রেম-ভালোবাসার ব্যাপারগুলো আসে । এর পরিনতি হিসাবে বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় । একই লিঙ্গের দু’জন অথচ ঘর বাঁধার স্বপ্ন । আবার অনেকেই নিজের গণ্ডির বাইরে অন্য পুরুষের সঙ্গে স¤র্পক গড়ে ।
তবে সে বিয়ে বেশি দিন টিকে থাকে না । তাদেও কামনা-বাসনা আছে, নেই ইচ্ছা পূরণের ত্রে। তাদের জীবনের একটা হচ্ছে এক গভীর গোপন র্ট্যাজেডি। জীবনের প্রয়োজনে, আর্থিক প্রয়োজনে কেউ কেউ সমর্পিত হয় সুস্থ মানুষগুলোর বিকৃত রুচির কাছে। ব্যবহৃত হয় ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসাবে।
পুরুষের কাছে নিজেকে নারী হিসাবে উপস্থাপন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এ কারণে সমাজের সাধারণ নারী পুরুষের ওপর প্তি থাকে সারাণ। নিজেদের যেহেতু মেয়ে মনে করে, সেহেতু একজন হিজড়া একজন পুরুষকেই তার জীবনসঙ্গী হিসাবে দেখতে চায়। কেউ কেউ পুরুষদের সঙ্গে সেক্স পার্টনার হিসাবে দিনের পর দিন বসবাস করে।
হিজড়াদের বিচার ব্যাবস্থা
হিজড়াদের রয়েছে নিজস্ব বিচার ব্যাবস্থা।
হিজড়ারা নিজস্ব সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে চলায় কঠোর। হিজড়াদের শাসন পদ্ধতি ভিন্ন প্রকৃতির।
রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় একজন করে সর্দার থাকে। তারা সাধারণ হিজড়াদের নিয়ন্ত্রণ করে। জানা যায়, রাজধানীতে পাঁচ গুরুর আওতায় প্রায় পনের হাজার হিজড়া রয়েছে।
সর্দারের বা গুরুর আদেশ ছাড়া কোনও দোকানে কিংবা কারও কাছে হাত পেতে টাকা চাইতে পারবে না। গুরুই শিষ্যদের এলাকা ভাগ করে দেয়। প্রতিটি গুরুর অধীনে ৮/১০টি দল থাকে। একটি দলে ৫/৬ জন থাকে। প্রতিদিন সকালে গুরুর সঙ্গে দেখা করে দিক-নির্দেশনা শুনে প্রতিটি দল টাকা তোলার জন্য বের হয়ে পড়ে।
বিকাল পর্যন্ত যে টাকা তোলা হয়। প্রতিটি দল ওই টাকা সর্দারের সামনে এনে রেখে দেয়। গুরু ওই টাকার অর্ধেক নিয়ে বাকি টাকা শিষ্যরা ভাগ করে নেয়। প্রতি সপ্তাহে হিজড়াদের সালিশি বৈঠক হয়। ১৫/২০ সদস্যের সালিশি বৈঠকে গুরুর নির্দেশ অমান্যকারী হিজড়াদের কঠোর শাস্তি পর্যন্ত
দেওয়া হয়।
বেত দিয়ে পেটানোসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য টাকা তোলার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। জরিমানা হয় অপরাধের ধরন অনুযায়ী ৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। দন্ডিত হিজড়াকে তার নির্ধারিত এলাকা থেকে তুলে এই টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ শাস্তি হিজড়ারা মাথা পেতে মেনে নেয় এবং কোনও ধরনের প্রতিবাদ পর্যন্ত করে না। বিচারকার্য স¤পাদন করেন গুরুমা ।
বছরে একবার এদের সমাজের অভ্যন্তরীন বড় ধরনের বিচার এখানে স¤পন্ন হয় । সব ধরনের অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি আর্থিক জরিমানা । হিজড়ারা যুগ যুগ ধরে তাদের এই বিচার ব্যাবস্থা মেনে আসছে পরম আস্থায় ।
যেভাবে পরিবার ছাড়ে
নিজের জন্মের জন্য দায়ী না হলেও সমাজ মনে করে হিজড়ারা অভিশপ্ত। সমাজ তো দূরের কথা ভাই-বোন, বাবা-মা, আÍীয়স্বজনরাও তাদের ফালতু ভাবে।
সবাই তাদের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকায়, কানাকানি, হাসি-তামাশার পাত্র হয়ে দাঁড়ায়। গালি দেয় হিজড়া বলে। একজন হিজড়া ব্যক্তিগতভাবে যেমন প্রতিষ্ঠা পায় না, তেমনি কোনও প্রতিষ্ঠা পায় না সমাজ, সরকারের কাছ থেকেও। এই সমাজের মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি এমন যে হিজড়া বলে শিশুটিকে কোনও স্কুলে ভর্তি করা যাবে না। তার সঙ্গে নিজের সন্তানদের খেলতে দেওয়া যাবে না।
এমনকি পরিবারের লোকজন হিজড়া সন্তান হওয়ার লজ্জা ঘোচাতে হিজড়া সন্তানটিকে ছেলে সাজাবার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা আর কতদিন। তার শরীর,
মন তো হিজড়ার মতো আচরণ করে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, লোকলজ্জা, কুসংস্কারের কারণে ওই হিজড়া সন্তানটির আর পড়াশোনা হয় না। সে শৈশবে তার ইচ্ছাগুলো পূরণ না করতে পেরে একসময় সুযোগ বুঝে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে।
মিশে যায় এদের মতো কোনও হিজড়ার দলে। তারপর বাড়ি বাড়ি নাচ-গান করে মানুষের কাছে হাত পেতে পেটের ুধা নিবারণ করে। চিরদিনের মতো এই পরিবার তার আদরের সন্তানটিকে হারিয়ে ফেলে।
রাখিবন্ধন
একজন হিজড়ার কাছে তার রক্তের স¤পর্ক বড় নয়। তার কাছে গুরুই সব।
দলে ভিড়ে সে গ্রহণ করে বয়স্ক হিজড়ার শিষ্যত্ব। তাকে শ্রদ্ধা করে গুরু বলে। কারণ দলভুক্ত হয়ে থাকতে হলে তাকে গুরুও শিষ্য হতেই হবে। এই গুরুকে কেউ কেউ নানি, দাদি বলেও ডাকে। তিনিই তখন শিষ্যদের সব।
শিষ্য হওয়ার সময় গুরু তার কাপড়ের আঁচল শিষ্যের মাথায় ¯পর্শ করে দেয় মন্ত্রজপের মাধ্যমে। এবং সাধারণ ছেলের পোশাকগুলো খুলে পরিয়ে দেয় নতুন শাড়ি। সেই শাড়ি পরতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত। এসব নিয়মের পর থেকেই হয়ে যায় ‘রাখি বন্ধন’। রাখি বন্ধনের ব্যাপারটি হিজড়াদের কাছে খুবই পবিত্র।
এই রাখি বন্ধন অনুষ্ঠান নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে উৎসবের মতো।
হিজড়াদের জীবনযাপন
এই অস্বাভাবিক হিজড়া মানুষদের জীবনাচরণ যেমন কৌতূহল উদ্দীপক তেমনি তাদের
মনমানসিকতাও অস্বাভাবিক। এরা যেহেতু নিজেদের নারী মনে করে, সেহেতু নিজেকে সুন্দরী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে মৃত্যু পর্যন্ত। হিজড়ারা সাধারণত বস্তি বা নোংরা এলাকায় বসবাস করে। কারণ সাধারণ বাড়ি মালিকরা তাদেরকে বাসা ভাড়া দিতে চায় না।
ফলে দালালের মাধ্যমে বস্তি এলাকায় কম খরচে ১/২ টি রুম ভাড়া নিয়ে কয়েকজন মিলে একত্রে থাকে। হিজড়ারা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নবজাতক কোলে নিয়ে নাচ গান করে আর বাজারের দোকানপাট থেকে তোলা উঠিয়ে যা আয় করে তার অর্ধেক পান হিজড়া গুরু। আর বাকি টাকা শিষ্যরা ভাগ করে নেয়। দৈনন্দিন খাবারের বাজারও তোলা থেকেই ওঠানো হয়। নিজেদের রান্না নিজেরাই করে।
সকালে গুরুকে সালাম করে দিকনির্দেশনা নিয়ে শুরু হয় ওদের কর্মযজ্ঞ। যা আয় হয় তা দিয়ে কসমেটিকস ক্রয় করে আর ব্যাংকে জমা রাখে। প্রায় হিজড়ার ব্যাংকে সঞ্চয় রয়েছে। এরা চাকচিক্যময় শাড়ি গহনা আর সাজগোজ পছন্দ করে। তবে সাধারণ মানুষের লজ্জা, রুচি ও সৌজন্যবোধ থাকে।
কিন্তু হিজড়াদের মধ্যে এসব আশা করা অবান্তর। কারণ শারীরিক দিক দিয়ে অঙ্গহীন হওয়ায় তাদের মনে প্রচন্ডভাবে দুঃখ কষ্ট ােভ থাকে। ফলে লজ্জাহীনতাই তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে অশ্লীলতা, উৎপাত, ব্যভিচারের ঘটনাও শোনা যায়।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে হিজড়া
হিজড়া হওয়ার কারণ স¤পর্কে নানা কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে।
কেউ এটাকে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ বলে, কেউ বলে পিতামাতার দোষ কিংবা প্রকৃতির খেয়াল। কিন’ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে মাতৃগর্ভে একটি শিশুর পূর্ণতা পেতে ২৮০ দিন সময়ের প্রয়োজন। এক্স এক্স প্যাটার্ন ডিম্বাণু বর্ধিত হয়ে জন্ম দেয় নারী শিশুর। আর এক্স-ওয়াই প্যাটার্ন জন্ম দেয় পুরুষ শিশুর। ভ্রƒণের পূর্ণতা প্রাপ্তির একটি স্তরে ক্রোমোজম প্যাটার্নের প্রভাবে পুরুষ শিশুর মধ্যে অন্ডকোষ এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়।
অন্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজন। পরবর্তী স্তরগুলোতে পুরুষ শিশুর যৌনাঙ্গ এন্ড্রোজেন এবং স্ত্রী শিশুর যৌনাঙ্গ এস্ট্রোজনের প্রভাবে তৈরি হয়। ভ্রƒণের বিকাশকালে এই সমতা নানাভাবে বিঘিœত হতে পারে। প্রথমত ভ্রƒণ নিষিক্তকরণ এবং বিভাজনের ফলে কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সূচনা হতে পারে। যেমন
এক্স-ওয়াই ওয়াই অথবা এক্স এক্স, ওয়াই।
এক্স ওয়াই ওয়াই প্যাটার্নের শিশু দেখতে নারী শিশুর মতো। কিন্তু একটি এক্সের অভাবে এই প্যাটার্নের স্ত্রী শিশুর সব অঙ্গ পূর্ণতা পায় না। একে স্ত্রী হিজড়াও বলে। আবার এক্স এক্স ওয়াই প্যাটার্নে যদিও শিশু দেখতে পুরুষের মতো কিন্তু একটি বাড়তি মেয়েলি ক্রোমোজম এক্সের জন্য তার পৌরুষ প্রকাশে বিঘিœত হয়। একে পুরুষ হিজড়াও বলে।
প্রকৃতির খেয়ালে হোক আর অভিশাপেই হোক এই হিজড়া ঘোচাবার উপায় এখন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রওশন আরা বলেন, আমরা একেবারে পরিণত বয়সে হিজড়াদের হাতে পাই। তখন এদের চিকিৎসা করতে সমস্যা হয়। হিজড়া শিশুটিকে তার অভিভাবক
যদি ৪/৫ বছর বয়সে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসে তাহলে এই শিশুটি অন্তত রাস্তায় নামতে পারেনা। অপারেশনের পর সে স্বাভাবিক মানুষের মতো পড়াশুনা করে জীবন যাপন করতে পারে।
সে হয়তো সন্তান ধারণ করতে পারবে না। আসলে তাকে এমন একটা পর্যায়ে আমরা হাতে পাই যেখানে সে পরিবারের বাইরে চলে যায়। তবে সচ্ছল পরিবারের সন্তানগুলো বাইরে কম যায়। নিুশ্রেণীগুলোই বাইরে যায়। তখন তার জীবনধারা স¤পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়।
না পারে নারী হতে না পারে পুরুষ হতে। তারা হোমোসেক্সে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
হিজড়াদের সংগঠন
হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছে কয়েকটি সংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন, সুস্থ জীবন, বাঁধন হিজড়া সংঘ, লাইট হাউস, দিনের আলো ইত্যাদি সংগঠন। কয়েকটি সংগঠনের কর্ণধারও হিজড়া।
তারা সমাজে চলার জন্য সামাজিক নিয়মকানুন, মানুষকে কোনও কিছুতে বাধ্য না করাসহ হিজড়া থেকেই সমাজে স্বাভাবিক জীবনযাপন, যৌন সচেতনতা ও নাচ-গান সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও তারা এখন এগিয়ে। এ প্রসঙ্গে হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছে লাইট হাউসের নির্বাহী পরিচালক মোঃ হারুন অর রশিদ বলেন, বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি সংগঠন হিজড়াদের নিয়ে কাজ করছে। তাদের কাজের পরিধিও ব্যাপক নয়। আমরা যারা এই গোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করি তারা শুধু একটা অংশ নিয়ে কাজ করি। সঙ্গত কারণেই পুরো বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে
পারি না।
এ জন্য টাকার প্রয়োজন। হিজড়াদের জন্য সরকারি/ বেসরকারিভাবে কোনও ফান্ড নেই। আমরা এদের নিয়ে কাজগুলো করে থাকি সেটা এইচআইভি/এইডস প্রোগ্রাম। এদের একটা বিরাট অংশ সমকামিতার সঙ্গে যুক্ত। এইচআইভি ভাইরাস থেকে দূরে রাখতে এবং সচেতন করতে আমরা এদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে প্রশিণ দিয়ে তাদের দিয়ে সচেতনতার বিষয়টি জানানো হচ্ছে।
এছাড়া তাদের বিনামূল্যে কনডমসহ যাবতীয় সামগ্রী দিয়ে সচেতনতা করা হয়। তবে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ পেলে অবশ্যই আমরা এদের নিয়ে কাজ করব। সরকারের কর্মসূচি হিজড়াদের নিয়ে সরকারের কোনও কার্যক্রম নেই।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একটা সময় ছিল হিজড়াদের কেউ মানুষ হিসাবেই ধরত না। এখন তো অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
এখন তারা ভোটার হচ্ছে। ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনও প্রকল্প নেই এদের নিয়ে। পরিকল্পনা আছে এদের নিয়ে কিছু একটা করার, সেমিনারে-সভায় কথা উঠেছে এদের বিষয়ে।
ওদের দাবি
ওরা চায় সমাজে ওদের মানুষ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো ওরা সমাজের সঙ্গে, পরিবার পরিজনদের সঙ্গে বসবাস করতে চায়। ওরা দেশ ও দশের সেবা করতে চায়। চায় একটা সামাজিক, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ওরা হিজড়া নামেই স্বীকৃতি চায়। হিজড়াদের মধ্যে কেউ কেউ নানা প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে একটু-আধটু পড়াশোনা করেছে।
এরা বিভিন্ন এনজিওর হয়ে কাজও করছে। এদের মধ্যে কথা হিজড়া একজন। বাবা-মা যার নাম রেখেছিলেন ইভান মাহমুদ। তিনি কাজ করছেন নারীপ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে। কথা বলেন, ফার্স্ট ও সেকেন্ড জেন্ডার নারী ও পুরুষ আমরা ‘ থার্ড জেন্ডার’ চাই।
ওদের থার্ড জেন্ডার’ বলতে অসুবিধা কোথায়?
ওরা এইডস সচেতন
হিজড়াদের একটা বড় অংশ পতিতাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত। এরা সস্তা দামের পারফিউম দিয়ে দিনে রাতে পার্কে কিংবা জনবহুল জায়গাগুলোতে খদ্দেরের আশায় ঘুরে বেড়ায়। সামান্য কয়েক টাকার জন্য বিকৃত রুচির কিছু পুরুষের কয়েক মুহূর্তের শয্যাসঙ্গী হয়। ফলে এরা এইচআইভি/এইডস ঝুঁকিপূর্ণ।
এদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে এবং এইচআইভি ভাইরাস যাতে না ছড়ায় এ বিষয়ে সচেতন করতে কয়েকটি সংগঠন কাজে করছে।
ওরা এখন অনেক সচেতন।
শেষ কথাঃ আসুন ওদের মানুষ ভাবি
একবার চিন্তা করে দেখুন এই পৃথিবীতে ওরা জোর করে আসেনি । দুইজন মানব মানবীর চূড়ান্ত ভালোবাসার ফসল ওরা । যারা ওদের পৃথিবীতে এনেছিলো তারাই ওদের স্থান দেয়নি । কতটা দুঃখ কষ্ট আর বঞ্চনা সহ্য করে ওরা হাতে তালি দিয়ে যাচ্ছে, হয়তো আমাদের মানবতাবোধকে পরিহাস করে ।
আসুন ওদের মানুষ ভাবি, ওদের দুঃখ কষ্টগুলো লাঘব করার চেষ্টা করি, এ পৃথিবী থেকে ওদের পাওনা বুঝিয়ে দেই । মানুষ হিসাবে অবশ্যই হিজড়াদের জীবন-যাপনের ব্যবস্থা থাকা উচিত। কিন্তু বর্তমান সমাজে এরা
বাস করে খুবই অবহেলিতভাবে। সরকার যেখানে প্রতিবন্ধীদের কথা ভাবছে সেখানে মানবাধিকারের হিজড়ারা সমাজে থার্ড জেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি চায়। দিক চিন্তা করে হিজড়াদের জন্যও পুনর্বাসন কর্মসূচি ও তাদের থার্ড জেন্ডার হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।