আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদরে কোচংি ‘বানজ্যি’

‘কোচিং বানিজ্য বন্ধ নীতিমালা ২০১২’ অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চলাকালীন শিক্ষকের নির্ধারিত ক্লাসের বাইরে বা এর পূর্বে অথবা পরে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে/বাইরে কোন স্থানে পাঠদান করাকে কোচিং বলা হয়। এ নীতিমালার ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিং বানিজ্যের সাথে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছেন ; যা পরিবারের উপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে এবং এ ব্যয় নির্বাহে অভিভাবকগণ হিমশিম খাচ্ছেন। এছাড়া অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে মনোযোগী না হয়ে কোচিং এ বেশি সময় ব্যয় করছেন। এক্ষেত্রে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। ’ জ্বি, কথাগুলো নিখাদ সত্য হিসেবেই ধরে নিলাম এবং শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির যৌক্তিক দাবী পূরণ হোক না হোক, এ নীতিমালা আমাদের সবারই মানা উচিত।

আমরা জানি, কোচিং ‘বানিজ্য’ বন্ধের এ আদেশ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে আসেনি, এসেছে অভিভাবক ফোরামের আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত থেকে। শিক্ষা মন্ত্রনালয় আদালতের আদেশের প্রতি সম্মান জানিয়ে ‘কোচিং বানিজ্য বন্ধ নীতিমালা ২০১২’ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীতে, কোচিং বানিজ্য বন্ধ নীতিমালার সংশোধনীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকদের কোচিং ও প্রাইভেট পড়ানো একেবারে নিষিদ্ধ করা হয়নি, কেবলমাত্র কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এক কথায়, শিক্ষার্থীর অভিভাবকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান করে বিশেষ ক্লাস নেওয়ার বিধান রয়েছে। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত নন এমন শিক্ষক কোচিং ও প্রাইভেট আগের মতো নির্ভয়েই চালিয়ে যেতে পারবেন।

তাই নীতিমালার ফাঁক ফোকরে কোচিং বানিজ্য বন্ধ হয় না। গত বছর ২১ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ নিজেই বলেছেন, ‘হুট করে এই মুহুর্তে প্রাইভেট কোচিং বন্ধ করা যাবে না কারণ এটি অনেক গভীরে ঢুকে গেছে। তাছাড়া শিক্ষকগণ ক্লাসে পুরো পাঠ শেষ করেন না। অতএব, এই মুহুর্তে প্রাইভেট কোচিং বন্ধ করে দিলে ছাত্রছাত্রী বা পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার উপর একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। ’ প্ল্যান বাংলাদেশ এর রিসার্চ কোঅর্ডিনেটরের মতে, ‘পড়ালেখার মতো সম্পৃক্ত বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত উপাদান বা কার্যপ্রক্রিয়াকে জবরদস্তি বা আইন করে বন্ধ করা যায় না, করা উচিতও নয়।

প্রাইভেট কিংবা কোচিং এর মূল কারণ খুঁজে বের না করে এটা বন্ধে যত কার্যক্রমই গ্রহণ করা হোক, নানা ফরম্যাটে তা বহাল থাকবে। ’ আমাদের শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে যাওয়ার যৌক্তিক কিছু কারণও রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, আমাদের শিক্ষার্থীর একাডেমিক পড়াশোনায় সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যেই মূলত কোচিং সেন্টারের জন্ম। অনেকের মতে এটি একটি বানিজ্যিক উদ্যোগ যেখানে অর্থের বিনিময়ে পড়া তৈরী করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার পাশাপাশি শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারও আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে অনেক সময় কিনতে বাধ্য করা হয়।

কেন এমন হয়? অভিযোগ আছে, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে পারেনি। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সাথে সমানতালে এগিয়ে থাকার মতো যোগ্য করে তাদের তুলতে পারেনি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তাই শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে কোচিং সেন্টারের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ধনী শ্রেণির অভিভাবকরা চান, তাদের ছেলেমেয়েরা অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকুক। তাই পয়সা খরচ করে তারা অনেকেই ছেলেমেয়েদেরকে কোচিং সেন্টারে পাঠান।

এক্ষেত্রে ছেলেমেয়ের পেছনে বিনিয়োগটিকে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ মনে করা হয়। কেউবা যায় অন্যদের দেখাদেখি। প্রবাসে থাকা অভিভাবকরা অনেক ক্ষেত্রে না বুঝেই ছেলেমেয়েদেরকে কোচিং সেন্টারে পাঠিয়ে দেন। শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটিও এক্ষেত্রে কিছুটা দায়ী। কারণ আমাদের শিক্ষার্থীদের অনেকেই কেবলমাত্র পরীক্ষা বৈতরণী পার হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে।

তাছাড়া, বিভিন্ন কারণে সঠিকভাবে স্কুলের পড়া যথাযথভাবে শেষ হয় না। শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধারণক্ষমতার বাইরে হওয়াতে দূর্বল শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের পাঠ সঠিকভাবে বুঝতে পারে না। তাই স্কুলে তার অনুপস্থিতির হার ক্রমশ বাড়ে এবং কোচিং সেন্টারে উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়। অভিযোগ আছে, কোচিং এ গেলে ফলাফল ভাল হওয়ার পাশাপাশি আমাদের ছেলে-মেয়েরা সহজে মেলামেশায়ও জড়িয়ে পড়ে। কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা কৌশলে তা এড়িয়ে চলেন পাছে শিক্ষার্থী কমে।

তারপরও সরকার বাইরের কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করতে রাজী নয়। কারণ তাতে অন্ততঃ কিছু বেকারের কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রশিক্ষণহীন বেকারদের কোচিং বানিজ্যে কিছু ভুল হোক সমস্যা নেই, কিছু চর্চা তো অন্তত হচ্ছে এই হচ্ছে সরকারের স্বান্তনা। কোচিং সেন্টারগুলোতে পড়াশোনার মান কেমন থাকে, এ প্রসংগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের প্রফেসর মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি একদিন কোন এক কোচিং সেন্টারের পরিচালককে ইংরেজী ক্লাস নিতে দেখলাম। ঐ একটি ক্লাসেই তিনি শিক্ষার্থীদেরকে ৭টি ভুল ইংরেজী শিখিয়েছেন।

’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা ভাল হয় না বলে শিক্ষার্থীরা কোচিং এ যায়, অন্যদিকে কোচিং সেন্টারে প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকনামধারী ছাত্র দ্বারা মানসম্মত শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসৃত হয়না। ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচীর প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও ইংরেজীর অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘অনেক স্কুল কলেজের শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়েছেন কোচিং সেন্টারগুলোতে। তাঁদের প্রতিষ্ঠানে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন ইংরেজী শেখাতে, এখানে আসছেন ব্যবসা জমাতে, ইংরেজী শেখাতে নয়। ’ কোথায় যাবে আমাদের সন্তানেরা সন্তানেরা? প্রাইভেট কিংবা কোচিং কি শুধু আমাদের দেশেই আছে? না। যুক্তরাজ্যের এডুকেশন কনসালটেন্ট মিস্টার কিথ টেইলরের সাথে আলোচনায় জেনেছি, তাদের দেশেও প্রাইভেট, কোচিং হয় তবে তা আমাদের দেশের মতো অতো ব্যাপক হারে কোনভাবেই নয়।

পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজন হলে ঠিকই তারা প্রাইভেট পড়েন এবং শিক্ষকদের ঐ কাজের অতিরিক্ত সম্মানী সরকারীভাবেই দেওয়া হয়। কখনোই কোন অভিভাবককে প্রাইভেটের জন্য আলাদা টাকা গুনতে হয় না। আমরা জানি, এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি মাধ্যমিক শিক্ষা। কোচিং করেই হোক আর দরিদ্র শিক্ষকদের নিরলস পরিশ্রমের ফলেই হোক আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর ভাল ফলাফল করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতি বছরই নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে।

তাই নেপথ্য নায়কদের কল্যাণে এবং কোচিং ‘বানিজ্য’ পুরোপুরি বন্ধে নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলোতে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ১। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের এ পেশার প্রতি আকৃষ্ট করুন। এ খাতে সরকারী বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারী বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে আইসিটি নির্ভর ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি দ্রুত করুন। শিক্ষকদের প্রাপ্ত প্রশিক্ষণ শ্রেণিকক্ষে সঠিকভাবে অনুসৃত হচ্ছে কি না তদারকি করুন।

২। আমাদের অনেকের বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত নিদ্দিষ্টতার অনেক বাইরে। ফ্যাসিলিটিজ নির্মিত একটি রুমে ১৮০ জনের ক্লাস নিলে শিক্ষক তা কিভাবে সামলাবেন। কি এমন শিক্ষা পাবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। সবাই তো আর ইংরেজী’র মাসুম বিল্লাহ কিংবা গণিতের রমিজ উদ্দিন স্যার না।

অনুমোদিত শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৬০ এর উর্ধ্বে গেলে শাস্তির ব্যবস্থা করুন। স্বীকৃতি নবায়নের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করুন। কাজ হবে। ৩। দেশের মাত্র ২৫-৩০ ভাগ শিক্ষক কোচিংপ্রবণ।

তাদের তালিকা তৈরী করে তাদের ক্লাসগুলো সপ্তাহে অন্তত একদিন পর্যবেক্ষণ করুন। ক্লাসের মান স্কুলের ক্লাস পর্যবেক্ষণ খাতায় লিখে দিয়ে আসুন। ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরী করে নিয়মিত আপলোড কিংবা প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিকট জমাদান প্রক্রিয়া তদারকি করুন। পরবর্তী সপ্তাহের ডিজিটাল কন্টেন্ট তৈরী করতে করতে প্রাইভেট পড়ানোর সময় এমনিতেই পাওয়া যাবে না। ৪।

শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া দূর্নীতিমুক্ত করে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসার সুযোগ তৈরী করুন। ‘আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী বেতন বৃদ্ধি হলে তাদের বেতন তো আমার বেতনের সমান হয়ে যাবে’ বেতন বৃদ্ধির সক্ষমতা থাকলে এমন সংকীর্ণ মানসিকতার কথা এলে তা যথাসম্ভব ইগনোর করুন। ৫। শিক্ষামন্ত্রী হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হলে শিক্ষকদের পক্ষে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা কঠিন হবে। তাই তিনি ঘোষনা দিয়েছিলেন, ‘শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বিশেষ এ বেতন স্কেল কার্যকরী হলে শিক্ষকদের বেতন ও ভাতার পরিমান অন্য সেক্টরের চেয়ে বেশি হবে। ’ আফসোস্! তা এখন আলোচনাতেও নেই। অথচ দারিদ্রতা ও নৈতিকতা যখন মুখোমুখি হয় তাতে অনেক সময় দারিদ্রের জয় এবং নৈতিকতার পরাজয় ঘটে। তাই আমাদের নবী (সাঃ) বলেছেন, ‘দারিদ্র মানুষকে কুফরীরর দিকে নিয়ে যায়। ’ ঈমাম আলী (রাঃ) বলেছেন, ‘দারিদ্র যদি মানুষ হতো তাহলে আমি তাকে হত্যা করতাম।

’ শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিন। মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ পেশায় আসবেন। কোচিং ‘বানিজ্য’ বিলুপ্ত হবে। এক কথায় আমাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সুবিধা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিন, সমাজের সর্বস্থরে শিক্ষকদের জন্য সত্যিকারের মর্যাদার পরিবেশ সৃষ্টি করুন। আমাদের চমৎকার সময়গুলো শিক্ষার্থীদের সৃজনীলতা বিকাশে ব্যয় হবে, অনন্য জাতি গড়ার কাজে আমাদের দায়বদ্ধতা আরও বৃদ্ধি পাবে, কোচিং ‘বানিজ্য’ পুরোপুরি বন্ধ হবে - কথা দিলাম।

তথ্যসূত্রঃ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, বাংলাদেশের শিক্ষা ও শিক্ষামূলক ব্লগ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.