আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ ফাঁস!

......আছি আরকি...

ফাঁস মুহাম্মদ তাশফিক সামি মাঘ মাসের শীতের রাত। ভাত খেয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। অবশ্য স্বেচ্ছায় বেরোইনি, বড় ভাইয়াই জোর করে বের করে দিল। সবে খাওয়ার পর একটা গল্পের বই পড়ব, এমন সময় এসে মাতবরি চালে বললো, ‘বেড়াতে এসে সারাদিন শুয়ে বসে কাটালে তো শিকড় গজিয়ে যাবে রে, যা যা, বাইরে থেকে একবার ঘুরে আয় গে। ’ মতলবখানা বুঝলাম ঠিকই, কিন্তু কিছু বলার ক্ষমতা নেই।

অগত্যা আর কী করি, জ্যাকেটের চেইন গলা পর্যন্ত তুলে দিয়ে গুটি গুটি পা ফেলে বের হলাম। হু হু বাতাস বইছে সমানে। বাইরে তাকিয়ে দেখি, কোথাও কেউ নেই। মনে ভাইয়ার উপর রাগ হয়েছিল, তাই ঠিক করলাম, আজ ঘন্টাখানিকের আগে ফিরবো না। এ ভেবে হাঁটা শুরু দিলাম।

একথা সেকথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছি আর উদাস মনে গ্রামের নৈশ প্রকৃতি দেখছি। বড়সড় গোলগাল একটা চাঁদ উঠেছে আজ, মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। মাঝে মাঝেই পশ্চিমের ঘন অন্ধকার ঝোপ থেকে কী যেন ডেকে ডেকে উঠছে করুণ সুরে। বিলাপের মত শোনাচ্ছে ডাকটা। যেন কেউ মারা গেছে ওর।

বিষাদে ছেয়ে গেল মনটা, মাথা নিচু করে হাঁটতে লাগলাম। এভাবে কতক্ষণ হেঁটেছি খেয়াল করিনি। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম, আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে অনেকদূর এসে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। নির্বুদ্ধিতার জন্য মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করলাম। আচমকা এমন আজব পরিস্থিতিতে পড়ে বেশ ভড়কে গেছি।

চোখ তুলে দেখি, সামনে একটা শ্যাওলায় ছাওয়া অন্ধকার নোংরা দিঘি। তার পাড়ে বিশাল এক বটগাছ ভূতের মত দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোন আওয়াজ নেই, একটা পোকাও ডাকছে না কোথাও, একদম নিশ্চুপ চারদিক। দিঘিটাকে মনে হচ্ছে অতল এক গহবর। যেন চুপচাপ অপেক্ষা করছে শিকারের।

এমন আশ্চর্য নীরবতায় গা শিরশির করে উঠলো আমার, খুব অস্বাভাবিক লাগলো ব্যাপারটা। তড়িঘড়ি ফিরবার জন্য পা বাড়াচ্ছি, এমন সময় কে যেন বিকট হেঁড়ে গলায় হাঁ হাঁ করে হেসে উঠে বললো, ‘কী রে জাফর না কী? এত রাতে কই পালাস তুই? আয় কাছে আয়। ’ আচমকা এমন উত্তেজনায় বুকের রক্ত ছিলকে উঠলো আমার, কিছুটা ভয়ে, কিছুটা বিস্ময়ে। কন্ঠটা রতনের মনে হল যেন? এত রাতে, এইখানে, কেন ও? আমার কানের ভুল নয়তো? শব্দের উৎসের খোঁজে ইতিউতি তাকালাম। কাউকে দেখতে পেলাম না।

হঠাৎ বটগাছটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। কী যেন একটা কথা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ল না। মনে হল, এর সাথে যেন রতনের কোন সম্পর্ক আছে। এমন সময় আবার আমাকে ভয়ানক চমকে দিয়ে ডেকে উঠলো সেই কন্ঠ, ‘আরে বোকা, আমি রতন। বটগাছের দিকে তাকালেই দেখতে পাবি।

তুইও উঠে আয় উপরে। ’ উপরে তাকিয়ে দেখি, বটগাছটার ডালে বসে আছে ও। লম্বা সরু পা দুটো মৃদু মৃদু দোলাচ্ছে। বাপরে, জ্বীন-ভূত না তো? কেমন অস্বস্তি লেগে উঠলো আমার, একটু ইতস্তত করে ঘোরগ্রস্তের মত হেঁটে গেলাম গাছের গোড়ায়। আমার পায়ের চাপে গাছের নিচে জমে থাকা শুকনো ঝরা পাতা মচমচ করে উঠলো।

নোংরা হয়ে আছে গাছটা, লম্বা কালো ঝুরি বেরিয়ে আছে জায়গায় জায়গায়। রতনের দিকে তাকিয়ে গাছের উচ্চতা দেখে একটা শুকনো ঢোক গিললাম। বহুদিন শহরে থাকায় গাছে চড়ায় তেমন পারদর্শী নই আমি, জুতো খুলে রেখে কসরত করে উঠতে লাগলাম। দু’একবার আনাড়িপনার কারণে পড়ে যাবার উপক্রম হলো, তবে শেষমেষ কষ্টে-সৃষ্টে উঠে পড়লাম। কালু নাল খ্যাংরা কাঠির মত কালো রগ ফুলে থাকা হাত দুটো দিয়ে টেনে আমাকে ওর পাশে বসালো।

কোনমতে ডালে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে ভাবলাম, ব্যাটার চিমসে শরীরে এত জোর এলো কোত্থেকে? আর কুৎসিত একটা গন্ধ কেমন ধাক্কা দিচ্ছে নাকে.....কী যেন একটা কথা মনে খচখচ করতে লাগল......। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দুইজনই। টের পেলাম, রতন আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে হল, ওর চোখ জোড়া যেন বিড়ালের মত জ্বলছে! আরেকবার ঢোক গিললাম আমি। হঠাৎ নিরবতা ভেঙ্গে রতন খ্যান খ্যানে গলায় বলে উঠলো, ‘কী রে, কী ভাবছিস অত?’ বিড়বিড়িয়ে বললাম, ‘না, কিছু না...।

তা তোর খবর কী?’ রতন আমার উপর থেকে চোখ একটুও না সরিয়ে বললো, কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে, ‘আর খবর! রাতের পর রাত বসে আছি এখানে, তোর মত কারো অপেক্ষায়, এইতো...। ’ ওর কথা শুনে বিষম খটকা লাগলো আমার, ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘কী সব আবোল তাবোল বলছিস তুই?’ মনে মনে অবশ্য একটু ভয় পাচ্ছি, রতনটা পাগল-টাগল হয়ে যায়নি তো? কী একটা কথা মনে পড়তে চাইছে তখন থেকে...। কোথাও খুব বড় একটা গোলমাল হয়ে গেছে মনে হল আমার। হঠাৎ হি হি করে হেসে উঠলো রতন, অপ্রকৃতিস্থের মত, মুখের ভিতর কুচকুচে কালো মাড়ির নিচে নোংরা লালচে দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে! ভয়াবহ কুৎসিত গন্ধটা নাকে ধাক্কা দিল আবার। গন্ধটা ওর মুখ থেকেই আসছে, বুঝতে পারলাম হঠাৎ।

মেরুদন্ড বেয়ে হিমশীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। জ্বুলজ্বুলে দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও। ভয় পেয়েছি আমি, ভীষণ ভয় পেয়েছি! কথাটা এতক্ষণে মনে পড়েছে আমার। তিন মাস আগে ঢাকায় থাকতে রমিয চাচার মুখে শুনেছিলাম খবরটা- রতন গাছে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে! তাহলে...। ‘বুঝতে বড় দেরি করে ফেললি তুই।

’ খলখল করে হেসে উঠে বললো রতন, যেন আমি কী ভাবছি সব বুঝে ফেলেছে। আতঙ্কে স্থবির হয়ে আছি আমি, বিস্ফোরিত চোখে দেখলাম গাছের কোটর থেকে একটা শুকনো কালচে রক্তমাখা ফাঁস বের করে আমার গলায় পরিয়ে দিল ও!!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।