দ্রুত বার্তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আজকাল মিডিয়া বা গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই এর ভূমিকা আরো বেশি প্রভাবশালী এবং আরো বেশি বিস্তৃত হচ্ছে। মানুষের জীবনে যোগাযোগ সরঞ্জামাদির প্রভাব এতো বেশি যে বলা যায় মিডিয়ার উপস্থিতি ছাড়া মানব জীবন এখন প্রায় অচল। রেডিও-টেলিভিশন আবিষ্কার ও তার উন্নয়নের ফলে এবং ইন্টারনেটের আবির্ভাবের ফলে মিডিয়ার প্রভাব ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আর আজকাল তো স্যাটেলাইটের কল্যাণে শব্দ এবং ছবি বিশ্বের সুদূর প্রান্তেও পৌঁছে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমের এই উন্নতিতে ধর্মীয় মনীষীরাও এর মাধ্যমে দ্বীন প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করার কথা ভাবছেন। কেননা নবী-রাসূলগণের প্রধান দায়িত্বই ছিল দ্বীন ও আধ্যাত্মিকতা প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা দেওয়া। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবশ্য একটি প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়ায়,তা হলো যোগাযোগের মাধ্যমগুলো যেভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মূল্যবাধের প্রচার করছে কিংবা যতোটা দক্ষতার সাথে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রির প্রচার চালাচ্ছে,ততোটা দক্ষতার সাথে কি এই মাধ্যমে দ্বীনের প্রচারকাজ চালানো সম্ভব?
ঠিক এই প্রশ্নটিকে সামনে রেখেই গত ২৬ ও ২৭ শে অক্টোবর ইরানের তেহরান ও কোমে 'ধর্ম ও মিডিয়া' শীর্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই সম্মেলনে যেসব ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব অংশ নিয়েছেন তাঁরা ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে মিডিয়ার গ্রহণযোগ্যতা ও সামর্থ এবং এ পথে বিদ্যমান বাধাগুলো নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন। এ রকম একটি সম্মেলন আয়োজনের পেছনে উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মীয় সংস্কৃতি বিশেষ করে ইসলামের সাথে বিশ্ববাসীকে পরিচয় করানো।
বস্তুতান্ত্রিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে আজ ধর্মীয় শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। পাশ্চাত্যে আধ্যাত্মিকতার অনুপস্থিতি সেখানকার সমাজকে নিষ্ফল করে তুলেছে এবং বিচিত্র রকমের অবক্ষয় ও নৈতিকতাহীনতা পশ্চিমা সমাজে জেঁকে বসেছে। ধর্ম ও গণমাধ্যম শীর্ষক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীগণ মনে করেন যে গণমাধ্যমের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে যদি ধর্মের সঠিক প্রচারনা চালানো হয় তাহলে ধর্মের উচ্চতর বার্তাগুলোর প্রভাব দ্বিগুণ বেড়ে যাবে এবং বহু মানুষ আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয় দিক-নির্দেশনা থেকে উপকৃত হবে।
ধর্ম ও মিডিয়া শীর্ষক সম্মেলনের সচিব হুজ্জাতুল ইসলাম হাদি সাদেকি গণমাধ্যমের শক্তির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেনঃ'গণমাধ্যম এখন নরম শক্তির (কুদরাতে নার্ম) অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কূটনীতি,রাজনীতি এবং অর্থনীতির ওপর তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
আসলে গণমাধ্যম যে-কোনো সমাজেরই গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে বিবেচিত। গণমাধ্যমের শক্তিকে তাই দ্বীনের প্রচারের কাজে ব্যবহার করা জরুরি। ' এই সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হুজ্জাতুল ইসলাম হুজ্জাতুল্লা বায়াত। তিনি সেমিনারে উপস্থাপিত তাঁর প্রবন্ধে ইসলামকে একটি যোগাযোগের ধর্ম বলে উল্লেখ করে বলেছেন,আল্লাহর মহান বাণী জনগণের কাছে পৌঁছানোর জন্যে গণমাধ্যমের সবোর্চ্চ ব্যবহার করতে হবে।
ধর্ম প্রচারের জন্যে গণমাধ্যমকে কাজে লাগানো কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যাবে পশ্চিমাদের গণমাধ্যম ব্যবহারের মাত্রা বিবেচনা করে।
পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের আধিপত্যবাদী লক্ষ্য অর্জনের জন্যে ব্যাপকভাবে এই গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে থাকে। এমনিতেই পাশ্চাত্যে গণমাধ্যমের প্রভাব ব্যাপক,তারা তাই গণমাধ্যমকে প্রচারণার কাজেও ব্যবহার করে। এইসব গণমাধ্যমের অধিকাংশই শক্তিশালী এবং সম্পদের অধিকারীদের হাতে। তারাও তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির কাজে এই প্রচার মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে। তবে তাদের গণমাধ্যমগুলোর প্রধান লক্ষ্যই হলো বস্তুবাদ, বেলেল্লাপনা,সহিংসতাসহ বিচিত্র রকম নৈতিক অবক্ষয়ের বিস্তার ঘটানো।
অথচ এই গণমাধ্যমটিকেই যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয় তাহলে মানুষকে আধ্যাত্মিকতার দিকে,নীতি-নৈতিকতার দিকে তথা আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট করা যায়।
মুসলমানদের সম্মান-মর্যাদা এবং ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষা করার জন্যেও গণমাধ্যমের ব্যবহার জরুরি। কোরআনে কারিম মুসলমানদের কাছে প্রত্যাশা করে তারা যেন সবোর্ত্তম সামরিক কৌশল ব্যবহার করে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে প্রস্তুতি নেয়। ধর্ম ও মিডিয়া শীর্ষক সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রবন্ধে জনাব বায়াত লিখেছেন,আগেকার যুগে নিরাপত্তার বিষয়টি কেবল সামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন গণমাধ্যম এবং মানব সমাজে তার বিচিত্র কর্মকাণ্ডের ফলে যুদ্ধ, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার মানেই পাল্টে গেছে।
প্রতিরক্ষা এবং আগ্রাসনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার এখন গণমাধ্যম। তাই যুগের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করে এবং সময়ের সাথে মিল রেখে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। পশ্চিমারা এখন কেবল মিডিয়ার সাহায্যে ইসলাম-বিরোধিতার কাজটি করে যাচ্ছে। তাদের এই প্রচারণাগত আগ্রাসন প্রতিরোধ করার জন্যে কিংবা উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্যে একই রকম অস্ত্র অর্থাৎ গণমাধ্যমের ভীষণ প্রয়োজন।
নিঃসন্দেহে গণমাধ্যমের শৈল্পিক ও যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিচিত্র অভিযোগের জবাব দেওয়া খুবই সহজ হবে।
তবে দ্বীনী গণমাধ্যমের বৈশিষ্ট্য কী হবে তা নির্ধারণ করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর এটি ছিল ধর্ম ও মিডিয়া শীর্ষক সেমিনারে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিত্বগণের অন্যতম চিন্তা-ভাবনার বিষয়। বক্তারা বলেছেন ধর্মীয় গণমাধ্যম হলো সেই মাধ্যম যা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে দর্শক-শ্রোতাকে ইসলামী নিয়মনীতি মেনে চলার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করে। আর এরকম গণমাধ্যম যে ধর্মীয় শিক্ষা, ভাবধারা ও বৈশিষ্ট্যের আলোকে গড়ে উঠবে-তাতে আর সন্দেহ কী! এরকমই একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে সেমিনারে বক্তারা আলোচনা করেছেন।
বিষয়টি হলো কুসংস্কার।
ইসলাম কুসংস্কারমূলক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে,তাই ইসলামী মিডিয়াকেও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে। ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার সচিব হাসান খুজাস্তে এ সম্পর্কে বলেছেন ধর্মীয় কোনো মিডিয়ার পক্ষে কোনো সমাজের লোকজনের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত হানা ঠিক নয়। তিনি বলেন মিডিয়ার দায়িত্ব হলো কু-সংস্কার বা অন্যায় ও ভ্রান্ত রীতি-আচারকে সংস্কার করা,সংশোধন করা এবং বিদেশী আধিপত্যবাদের সাথে সংশ্লিষ্টতার নেতিবাচক দিকগুলোকে তুলে ধরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর হাসান রাহিমপুর আযগাদি বলেছেন ধর্মীয় মিডিয়া তাকেই বলবো যা দেখা বা শোনা কিংবা ব্যবহারের পর দর্শক-শ্রোতার ধর্মীয় চিন্তাধারার স্তর অনেক বেড়ে যায়। এ ধরনের মিডিয়ার বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত সমালোচনা গ্রহণকারী,পরমত সহিষ্ণু, নমনীয় এবং শিষ্টাচারী।
সম্প্রচার সংস্থার গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক আলি রেযা পুয়া বলেছেন আন্তর্জাতিক তথ্য প্রবাহের চাবিকাঠি তথা গণমাধ্যমগুলো এখন রাজনীতিক এবং পুঁজিপতিদের হাতে। তাই এসব গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতার বালাই নেই। এরকম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো কোরেআনের দিকে ধাবিত হওয়া। ধর্মীয় মৌলিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত সূত্রকেই সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
তিনি কোরআনের আলোকে খবরের বস্তুনিষ্ঠতার কিছু মানদণ্ড তুলে ধরেন।
এগুলো হলো-সত্য ও বাস্তব হওয়া, প্রামাণ্য হওয়া, উপকারী বা কল্যাণকর হওয়া, মিথ্যা খবরের কথা ফাঁস করে দেওয়া,কুশিক্ষামূলক বিষয় পরিহার করা,শালীন শব্দমালা ব্যবহার করা,নীতি-নৈতিকতা ও সততা রক্ষা করা,অপরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করা এবং কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি। বিশিষ্ট গবেষক ও চিন্তাবিদ মুহাম্মাদ সালিমিও তাঁর উপস্থাপিত প্রবন্ধে লিখেছেন,ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী গণমাধ্যমগুলোর বিভ্রান্তিকর ও অসত্য প্রচারণার অসারতা প্রমাণ করার জন্যে ধর্মীয় গণমাধ্যমগুলোকে ধর্মাদশের্র গভীরে যেতে হবে। সঠিক ও যথার্থ তথ্য দিয়ে জনগণকে মিতব্যয়ী করে তোলা এবং সঞ্চয়ের মানসিকতা সৃষ্টি করাও এই শ্রেণীর গণমাধ্যমের একটি বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
প্রবন্ধকার বায়াত আরো যে বিষয়টির প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা হলো গণমাধ্যম ধর্মীয় আদর্শ প্রচারের জন্যে শিল্পমাধ্যমগুলোকে যথার্থভাবে কাজে লাগানো। বিশেষ করে ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার সবচেয়ে বড়ো পুজিঁই হলো শিল্পমাধ্যম।
তাই গণমাধ্যমে শিল্পের ব্যবহারের বিষয়টি খুবই জরুরি। ধর্মীয় চিন্তাচেতনা প্রচার-প্রসারের জন্যে আজ গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মানুষ এখন ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষার অভাব বোধ করছে তীব্রভাবে। আর বিশ্বব্যাপী তার অভাব পূরণ করার সর্বাধুনিক মাধ্যমই হলো মিডিয়া।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।