বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
এই লেখাটা জীবনানন্দ দাশকে দিয়ে শুরু করা যায়। নিচের চারটে লাইন কবির রুপসীবাংলার।
চারিদিকে শান্ত বাতি, ভিজে গন্ধ, মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;-
এশিরিয়া ধুলো আজ, বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
হ্যাঁ। এশিরিয়া আজ ধুলো হয়ে আছে। তবু আমরা দেখতে চাই সেই ধুলোর ভিতরে আমাদের জন্য জানবার কিছু আছে কিনা। তার আগে একটা কথা। আমরা মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ইতিহাসসংক্রান্ত ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।
কাজেই প্রাচীন এশিরিয়া সভ্যতা প্রাচীন মেসোপটেমিয় সভ্যতার অর্ন্তগত না বলে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ইতিহাসের অর্ন্তগত বলাই সঙ্গত বলে আমি মনে করি। যেমন পাহাড়ে বাস করার সুবাদে একজন মানুষকে পাহাড়ি বলা কি অসঙ্গত নয়? কিংবা বাংলার সভ্যতা ও সংস্কৃতি কি কেবলই ব-দ্বীপের সভ্যতা ও সংস্কৃতি?
এশিরিয় সৈন্য
প্রাচীন এশিরিয়া সভ্যতাকে আমরা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা না বললেও মেসোপটেমিয়া শব্দটি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারনা থাকা জরুরি। মেসোপটেমিয়া শব্দটি গ্রিক শব্দ এবং এর অর্থ: নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল। নদী দুটি হচ্ছে ইরাকের দজলা (তাইগ্রিস) ও ফোরাত (ইউফ্রেতিস)। তাইগ্রিস ও ফোরাত ইউফ্রেতিস-এর ঐ মধ্যবর্তী অঞ্চলটিই প্রাচীন সভ্যতার জন্মভূমি ও লীলাভূমি।
মধ্যপ্রাচ্য আজ সাম্রাজ্যবাদীদের থাবার গ্রাসে নিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে। এখন সময় হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উজ্জ্বল অতীত সম্বন্ধে আলোকপাত করা এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ইতিহাসসংক্রান্ত ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসা। মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ইতিহাসসংক্রান্ত ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাখান করে বলব প্রাচীন এশিরিয় সভ্যতা মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন সভ্যতা কেবলি প্রাচীন মেসোপটেমিয়া নয়। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা বললে মধ্যপ্রাচ্যের নিজস্ব অর্জন প্রকাশ পায় না, মনে হয় ঐ অঞ্চলের পুরো অর্জন গ্রিকদের। যে কারণে সুজলা সুফলা শষ্য শ্যমলা সোনার বাংলা কেবলি ব-দ্বীপ নয়!
প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্য; এশিরিয়া
অনেক কটা প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মধ্য প্রাচ্যে; যার মধ্যে তৃতীয় উল্লেখযোগ্য সভ্যতা ছিল এশিরিয়া সভ্যতা এবং প্রথম দুটি সভ্যতা হল যথাক্রমে সুমেরিয় সভ্যতা ও ব্যাবিলনিয়া সভ্যতা।
নৃতত্ত্ব ধর্ম লোকাচারে এবং জীবনধারার দিক থেকে সুমের না-হলেও ব্যাবিলনিয় সভ্যতার সঙ্গে এশিরিয়া ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে; যে কারণে এ দুটো সভ্যতা বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে পৃথক করাই মুশকিল। তারপরেও প্রাচীন এশিরিয়া সভ্যতা পৃথক ও স্বতন্ত্র একটি সভ্যতা। এশিরিয় জনগনের ঈশ্বর এর নাম ছিল আশহুর। আশহুর থেকেই এশিরিয়া শব্দটির উদ্ভব। এশিরিয়া শব্দটি লাতিন।
অনিন্দ্য এশিরিয় শিল্প
আজ যে দেশগুলি ইরান ইরাক তুরস্ক ও সিরিয়া, সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগের প্রাচীন এশিরিয় সাম্রাজ্যটি এসব রাষ্ট্রেই ছড়িয়ে ছিল। এশিরিয়ার উত্তর ও পুবে ছিল টরাস ও জাগরস পর্বতমালা। পশ্চিমে আর দক্ষিণে বিশাল চুনাপাথরের নিচু উপত্যকা। দুটি প্রধান নদী দজলা (তাইগ্রিস) ও ফোরাত (ইউফ্রেতিস) বয়ে যাচ্ছিল এশিরিয় সাম্রাজ্যের বুক চিরে। জাব নামে আরও একটি নদীও ছিল।
এসব নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছিল আশহুর নিনেভ আরবেল নিমরুদ ও আররাপখা প্রভৃতি নগরসমূহ । এশিরিয় সাম্রাজ্যের দক্ষিণের কাঁকরবিছানো সমতলে জমা হত দজলা নদীর পলি । আরও দক্ষিণে অনাবৃষ্টি ছিল, ছিল সেচ জলের নিদারুন অভাব; তা সত্ত্বেও সেসব উষর ভূমি চাষযোগ্য করে তুলেছিল পরিশ্রমী এশিরিয় কৃষক।
ঐতিহাসিকগন মনে করেন ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে দজলা-ফোরাত অববাহিকায় লোক বসতি শুরু হয়। ক্রমান্বয়ে আরও অভিবাসী লক্ষ করা যায়।
যাদের বেশির ভাগই ছিল সেমিটিক । তো, কারা সেমেটিক? নুহ নবীর তিন ছেলের এক ছেলের নাম ছিল শেম। সেমিটিক বলতে প্রাথমিক ভাবে বোঝানো হয় মধ্যপ্রাচ্যের শেমের বংশধর এবং পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা পরিবার।
যাহোক। ঐতিহাসিকদের ধারনা অনুযায়ী এশিরিয়া সভ্যতার উদ্ভবকাল ২৪০০ খ্রিস্টপূর্ব।
ঐ সময়ে এশিরিয় জনগন পশুপালন কৃষি মৃৎশিল্প আগুনের নিয়ন্ত্রণ ও ধাতু গলানোর কাজে হয়ে ওঠে দক্ষ । দজলা-ফোরাত অববাহিকার শষ্যক্ষেত্রগুলি হয়ে উঠেছিল পরিপূর্ন রুপে স্বর্ণালী । আর সে কৃষির উদবৃত্ত থেকেউ গড়ে উঠতে থাকে আশহুর নিনেভ আরবেল নিমরুদ ও আররাপখা প্রভৃতি নগরসমূহ । নগরে কারুশিল্প ও লেখনির বিকাশ হয়। এসব ক্ষেত্রে অবশ্য পূর্বসূরি সুমেরিয়দের অবদান ছিল।
এশিরিয়; কবেকার পুরনো ছায়া। আর তার মায়া ...
এশিরিয়া সভ্যতার ভিত্তি ছিল কৃষি। কৃষির জন্য অপরিহার্য ছিল পানি । তো এশিরিয় কৃষক পানি পেত কোথায়? এশিরিয়া সাম্রাজ্যে পানির উৎস ছিল মূলত তাইগ্রিস নদী ও উত্তর ও পুবের টরাস ও জাগরস পর্বতমালার শীর্ষের বরফ গলা জল। এশিরিয় জনগনের বেশির ভাগই বাস করত গ্রামে ।
আর, সেচব্যবস্থা ছিল বেশ উন্নতমানের । সাম্রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পেলে আকরিক খনি ও অরণ্যাণী হয়ে ওঠে সম্পদের উৎস । নগরে ছিল মূলত বানিজ্য ও কারুশিল্পের কেন্দ্র ; বাড়িঘর তৈরি হত কাদার তৈরি ইটে। কখনও কখনও পাথরের। দালানগুলি কখনওই একতালার বেশি হত না।
বাড়ির ছাদটি হত সমতল। বাড়িগুলি হত ছোট আকারের। তবে প্রাসাদ ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের কথা আলাদা। এশিরিয়া সভ্যতা ঠিক দাসতান্ত্রিক না হলেও অর্থনীতিতে দাসদের অবদান ছিল। সংগঠন ও যুদ্ধবিদ্যায় গভীর বুৎপত্তি অর্জন করেছিল।
খনি ও অরণ্য সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণই ছিল এর অন্যতম কারণ ।
আশহুর নগরটি ছিল এশিরিয়া সাম্রাজ্যের প্রথম রাজধানী।
আশহুর গেট। মধ্যপ্রাচ্য আজ সাম্রাজ্যবাদীদের থাবার গ্রাসে নিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে। এখন সময় হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের উজ্জ্বল অতীত সম্বন্ধে আলোকপাত করা এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ইতিহাসসংক্রান্ত ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসা।
প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ দিকে প্রথম লোক বসতি গড়ে উঠছিল আশহুর নগরের আশেপাশে। আশহুর-এর অবস্থান তাইগ্রিস নদীর পশ্চিম তীরে এবং পরবর্তী রাজধানী নিনেভ-এর দক্ষিণে। বর্তমানে শারকাত নামে ইরাকের গ্রাম আশহুর বলে শনাক্ত করা হয়েছে।
আশহুর নগর;শিল্পীর চোখে
রাজধানী ছাড়াও আশহুর ছিল এশিরিয়া সাম্রাজ্যের অন্যতম ধর্মীয় নগর। মনে থাকার কথা: এশিরিয় জনগনের ঈশ্বর এর নাম ছিল আশহুর।
আশহুর থেকেই লাতিন এশিরিয়া শব্দের উৎপত্তি। এশিরিয় দেবীর নাম ইশতার বা ইনানা। দেবদেবীর উপাসনার জন্য এশিরিয়ায় তৈরি হয়েছিল পিরামিডসদৃশ বিশালাকার জিগুরাট। জিগুরাট অবশ্য প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম তৈরি করেছিল সুমেরিয়রা।
ইশতার বা ইনানা
আমরা ৩০/৪০ বছরের ইতিহাস কূলকিনারা করতে পারি আর আমরা এখন শত শত বছরের এশিরিয় সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করছি।
অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে কোনও সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে রাজধানী স্থানান্তর ঘটে। কাজেই আশহুর থেকে এশিরিয় সাম্রাজ্যের রাজধানী সরে নিনেভে চলে গিয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০৫ থেকে ৬১২ অবধি নিনেভ ছিল রাজধানী। নিনেভের অবস্থান ছিল তাইগ্রিস নদীর পূর্বপ্রান্তে ও বর্তমান ইরাকের মশুলে। কাওসার নামে একটি নদী নিনেভের মাঝখান দিয়ে বয়ে দজলা নদীতে মিলেছিল ।
উদ্যান সড়ক চক বাগান আর ১৫টি দেয়ালসমৃদ্ধ তোরণ-সব মিলিয়ে নিনেভ ছিল সেকালের এক জমজমাট নগর।
মানচিত্রে নিনেভ
নিনেভ; শিল্পীর চোখে
নিনেভ
এশিরিয় সভ্যতার শাসনকাঠামোটির ধরন ছিল রাজতান্ত্রিক। সভাসদের কাছে রাজার জবাবদিহি করতে হত। রাজার মৃত্যু হলে ছেলেই রাজা হত। সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ন।
প্রদেশ শাসন করত প্রাদেশিক শাসনকর্তা, তারা কেন্দ্রে কর পৌঁছে দিত, যুদ্ধের জন্য সৈন্য সরবরাহ করত। ২য় সারগন ছিলেন এশিরিয় সভ্যতার বিখ্যাত এক শাসক। তার সময়ে এশিরিয়া ৭০টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল।
এই ডানাওয়ালা পশুটি এশিরিয়ার প্রতীক যেন!
পন্ডিতগন এশিরিয় সভ্যতাকে দু-ভাগে ভাগ করেছেন । (ক) পুরনো এশিরিয় সাম্রাজ্য।
ও (খ) নব্য এশিরিয়া সাম্রাজ্য। একজন অন্যতম এশিরিয় শাসক ছিলেন ৩য় তিঘলাথ পিলেসার । সময়কাল? ৭৪৫-৭২৭ খ্রিস্টপূর্ব । সম্রাট ৩য় তিঘলাথ পিলেসার ছিলেন নব্য এশিরিয় সাম্রাজ্যের স্থপতি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত একজন সামরিক নেতা।
তার শাসনামলেই এশিরিয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে সিরিয়া ফিলিস্তিন ও ব্যাবিলন সংযুক্ত হয়।
৩য় তিঘলাথ পিলেসার ।
আরেকজন শ্রেষ্ট এশিরিয় নৃপতি ছিলেন সম্রাট আশহুরবানিপাল (৬৬৯-৬২৭) তিনি নিনেভ নগরে বাস করতেন। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সাংস্কৃতিকমনা শাসক। সুমের ও আক্কাদিয় লিপি পড়তে জানতেন।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম ও আদি গ্রন্থাগারের স্থাপনের কৃতিত্ব তারই। মাটির ট্যাবলেট আকারে লক্ষ লক্ষ পুস্তক ছিল সে গ্রন্থাগারে। এমন কী বৈজ্ঞানিক। ধর্মীয় গ্রন্থ গিলগামেশ। লোক উপকথাও ছিল।
প্রাচীন সভ্যতায় আসিরিয়দের অবদান সাহিত্য। লেখা হত কাদার ওপর। পরে অবশ্য আরামিক লিপিতে চামড়ার ওপর লেখা হত । লেখার বিষয়বস্তু ছিল আইন, চিকিৎসাবিদ্যা ও ইতিহাস।
সম্রাট আশহুরবানিপাল।
ছিলেন সুশাসক। তার মৃত্যুর পরেই এশিরিয় সভ্যতা বিলীন হয়ে যায়।
এশিরিয়া সভ্যতা: ফটো গ্যালারি
মনে রাখতে হবে মেসোপটেমিয়া নয় মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন সভ্যতা ছিল এশিরিয়া সভ্যতা । মেসোপটেমিয়া বললে মধ্যপ্রাচ্যের কৃতিত্ব ঠিক বোঝা যায় না। গ্রিক শব্দটি কেবল বিভ্রম সৃষ্টি করে ...
প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্য
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।