সাপ্তাহিক কাগজ পত্রিকায় খালেদ মুহিউদ্দিনের "পুলশি আর গণমাধ্যমরে সৃষ্টি রসু খাঁ" শীর্ষক প্রতিবেদনটি ব্লগার বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করছি।
পুলশি আর গণমাধ্যমরে সৃষ্টি রসু খাঁ
খালেদ মুহিউদ্দীন
রসু খাঁ নামটি এখন মুখে মুখে। সিরিয়াল কিলার, ক্রমিক খুনি, ঠান্ডা মাথার ভাবলেশহীন খুনিÑএমন সব রোমহর্ষক নামে ডাকা হচ্ছে তাকে। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় রসু খাঁকে এ মুহর্তেই ওই সব বিশেষণে অভিহিত করা ন্যায়সংগত হচ্ছে না। কারণ অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই কোনো সিদ্ধাš জানানোর অধিকার আমাদের নেই।
অন্যদেরও থাকার কথা নয়। তাই এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদভাষ্যের সত্যতা যাচাই করতে চেয়ে আমরা বিশ্লেষণ করেছি রসু খাঁ-স¤ক্সর্কিত এযাবৎ প্রকাশিত সব কটি খবর। সবগুলো প্রধান পত্রিকাই রসু খাঁ-স¤ক্সর্কিত সংবাদগুলো প্রকাশ করেছে একই কায়দায়। অবশ্য প্রত্যেকের নিজস্ব মোড়ক এবং উপস্থাপনার স্বকীয়তাও ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু পাঠকের ধৈর্য আর পত্রিকার কলেবর মাথায় রেখে আমরা নমুনা হিসেবে বেছে নিয়েছি দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাটি।
দৈনিকটি এ মুহর্তে বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচারিত বলেই এই অগ্রাধিকারমলক ভুক্তি।
আমরা অবশ্য বলছি না যে, রসু খাঁ নির্দোষ। রসু খাঁ আর কথিত শিকারদের নিয়ে পুলিশি ভাষ্য আর গণমাধ্যমে তার অন্ধ অনুকরণ আর অসংগতিগুলো নির্দেশ করতেই এ নিবন্ধের অবতারণা।
রসু খাঁ গ্রেপ্তার হলেন কেন?
১২ অক্টোবর প্রকাশিত প্রথম আলোর খবর পড়ে জানা যায়, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার একটি মসজিদের বৈদ্যুতিক পাখা চুরি করার দায়ে রসু খাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওই থানার পুলিশের একটি বিশেষ দল টঙ্গীর নিরাসপাড়া অথবা নিরাশপাড়া অথবা মিরাশপাড়া (পত্রিকাটিতে তিনটি বানানই লেখা হয়েছে) থেকে রসু খাঁকে গ্রেপ্তার করে।
মসজিদের পাখাচোরকে ধরতে চাঁদপুর জেলা থেকে গাজীপুর জেলায় পুলিশের একটি বিশেষ দল পাঠানো হলো। বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক বটে। কে বলে, দেশে আইনের শাসন নেই! আমরা এত দিন ধরে শুনে আসছিলাম, লোক আর অর্থবলের অভাবে অনেক গুরুতর অপরাধীরও অনুসন্ধান করতে পারছে না পুলিশ। এখন দেখছি, মামুলি ফ্যানচোর ধরতেই পুলিশ অন্য জেলা থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
পরদিন অর্থাৎ ১৩ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত শীর্ষ সংবাদে বলা হয়, একটি মোবাইল ফোনের সিমকার্ডের সত্র ধরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
‘যেভাবে খুনির সন্ধান মিলে’ শীর্ষক উপশিরোনামে একটি দৃশ্যকল্পেরও অবতারণা হয়, যেখানে পুলিশের বিশেষ তৎপরতায় রসুর গ্রেপ্তারের বর্ণনা দেওয়া হয়। পাঠকের মনে এই ধারণা দেওয়া হয় যে, পুলিশ রসু খাঁকেই খুঁজছিল এবং বি¯র কাঠখড় পুড়িয়ে আর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে! ওই প্রতিবেদনে পাখা চুরির সঙ্গে রসু খাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতার কথা বলাই হয়নি। ১৫ অক্টোবর এসে একই পত্রিকায় আবার লেখা হয়, ‘৭ অক্টোবর একটি চুরির ঘটনায় রসুকে গাজীপুরের টঙ্গীর নিরাশপাড়া থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ’
প্রেমের প্রতিশোধ নিতে কেন এত দেরি?
ক্রমিক খুনের কারণ হিসেবে রসু বলেছিলেন, প্রেমে ব্যর্থতা আর অপমানের জ্বালাই তাকে এ রকম একজন নৃশংস খুনিতে রূপাšর করেছিল। কিন্তু সেই ব্যর্থতা কবেকার? ১২ অক্টোবর প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শুরুতেই কাব্য করে বলা হয়, ‘১৫ বছর আগে প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রেমকেই বেছে নিয়েছেন খুনের নেশা পরণের হাতিয়ার হিসেবে।
’ একই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এখন থেকে ১১ বছর আগে রসু প্রথম বিয়ে করেন মনু নামের একজনকে। রসুর বর্তমান ¯ী রীনাও (একই প্রতিবেদনে তাকেও প্রথম ¯ী বলা হয়েছে, দুজন প্রথম ¯ীর বিষয়টি মুদ্রণবিভ্রাট হতেও পারে!) জানান, তাদের বিয়ে হয় ১০ বছর আগে।
কিন্তু ১৫ বছর আগের ঘটনার প্রতিশোধ নিতে এত দেরি করলেন কেন রসু? স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন এসেছিল সাংবাদিকদের মাথাতেও। এ কারণেই হয়তো ১৪ অক্টোবর ২০০৯ সালে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়, ‘বাচ্চারা বড় হওয়ার জন্য খুনের প্রতিজ্ঞা পরণে ১২ বছর অপেক্ষা রসুর!’ শিরোনামে। কিন্তু প্রতিজ্ঞার সময় রসু বিয়ে করেননি, তার ঔরসে জš§ নেয়নি কোনো সšান।
যারা জš§ায়ইনি তাদের বড় হয়ে উঠবার জন্য প্রতিজ্ঞা পরণ ১২ বছর পিছিয়ে দিলেন রসু!
এদিকে রীনার সঙ্গে রসু খাঁর ১০ বছর আগে বিয়ে হলেও ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রতিবেদনে রসুর তিন সšানের বয়স বলা হয় ১৪, ১২ এবং আট। এটা কেমন করে হলোÑএই প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন ‘কেমনে তুমি এত কিছু করলা’ শীর্ষক শিরোনামের রচয়িতা। এ প্রতিবেদকের কলমে উঠে এসেছে রীনার কথা, যেখানে তিনি বলছেন, ‘বিয়ের সালটি ঠিক বলতে পারেননি রীনা। তবে তা ১৬-১৭ বছর আগের ঘটনা বলে তিনি জানান। ’ ধারাবাহিকভাবে যারা রসু খাঁর ঘটনা পড়ে গেছেন, তারা কোনটা সত্য বলে ধরে নেবেন?
রসুর শ্যালক মান্নানের ¯ীকে খুন করেছে কে?
১২ অক্টোবর প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, স্বীকারোক্তিমলক জবানবন্দিতে রসু বলেছেন, ‘২০০৭ সালের প্রথম দিকে তিনি তার শ্যালক মান্নানের ¯ী রীনাকে হত্যা করেন।
রীনার বাড়ি হাতিয়ায়। ’ ঠিক পরদিনই ‘অন্যের জন্যও খুন করেছেন রসু’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘আদালতের জবানবন্দিতে রসু জানান প্রায় তিন বছর আগের কথা। তার শ্যালক মান্নানের ¯ী সাহিদার সঙ্গে মান্নানের বনিবনা হচ্ছিল না। সাহিদার বাড়ি বরিশালে। মান্নান কৌশলে ¯ীকে ফরিদগঞ্জের পুরাতন রা¯ার মোড়ে খালপাড়ে নিয়ে যান।
রসু দাঁড়িয়ে থাকেন আর মান্নান তাকে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেন। রসু খাঁ দাবি করেন, এটা দেখে তিনি শিখে নেন এবং এরপর একাই অনেককে খুন করেন। আমাদের প্রশ্ন হলো, শ্যালক মান্নানের ¯ীর নাম রীনা না সাহিদা? তার বাড়ি হাতিয়া নাকি বরিশাল? তাকে রসু খাঁ খুন করেন নাকি তার স্বামী মান্নান? ১৭ অক্টোবর পুলিশ রসু খাঁকে নিয়ে ঘটনাস্থল দেখতে গেলে রসু আরেকজন শাহিদার বর্ণনা দেন। যাকে আনা হয়েছিল ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে। এ সময় শাহিদার পরনে ছিল বোরকা।
রসু তাকে বিস্কুট, কলা ও রুটি খেতে দিয়েছিলেন।
ক্রসফায়ারের ভয়
রসু খাঁ-সংক্রাš সংবাদ প্রকাশের প্রথম দিন থেকেই চলে আসছে ক্রসফায়ার প্রসঙ্গ। ১২ অক্টোবরের প্রতিবেদনেও দেখা যাচ্ছে, রসু দাবি জানাচ্ছেন যে তাকে যেন ক্রসফায়ারে না দেওয়া হয়। এর পরদিন পুলিশও সাংবাদিকদের জানায়, ক্রসফায়ারের ভয় দেখাতেই একের পর এক খুনের কথা স্বীকার করেছেন তিনি। ক্রসফায়ারের ভয় দেখালে গোটা ত্রিশেক খুন আর পঞ্চাশটি ধর্ষণের কথা কে কেউ স্বীকার করবে।
সত্যিই কী বিচিত্র এ দেশ! মৃত্যুভয় দেখিয়ে একজনের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হচ্ছে, আবার তা বলাও হচ্ছে সবি¯ারে।
মৃত্যুভয়ে ভীত রসু খাঁর আÍহত্যার চেষ্টা!
১৩ অক্টোবর প্রথম আলোয় বলা হয়েছিল, ‘তবে ঠান্ডা মাথায় একের পর এক খুন করে গেলেও ধরা পড়ার পর মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন রসু। মৃত্যুভয়েই সব খুনের কথা স্বীকার করেছিলেন তিনি। অথচ ১৬ অক্টোবর প্রকাশিত হলো একটি ভিন্ন সংবাদ। ‘ক্রমিক খুনি রসু খাঁ ফের তিন দিনের রিমান্ডে’ শীর্ষক সংবাদে ‘রসুর আত্মহত্যার চেষ্টা’ শীর্ষক উপশিরোনামে বলা হয়, ‘একাধিক বিশ্ব¯ সত্র জানায়, দুই দিনের রিমান্ডের শেষ দিন গত বুধবার রাত ১০টায় রসু ডায়রিয়াজনিত পেটের সমস্যার কথা বলে বারবার বাথরুমে যান।
ওই সময় থানার এসআই মীর কাশেম তাকে স্যালাইন এনে দেন। সে সময় ৩০ মিনিট বিদ্যুৎ ছিল না। পুলিশের কাছে বারবার বাথরুমে যাওয়ার বিষয়টি সন্দেহ হয়। একপর্যায়ে পুলিশ দেখে, রসু নিজের গায়ে পরিহিত শার্ট গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে পুলিশের অন্য একটি কক্ষে সার্বক্ষণিক নজরে নিয়ে যাওয়া হয়।
’ পাখা চুরির অভিযোগে আটক ব্যক্তিকে মৃত্যুভয় দেখিয়ে ১১ খুনের স্বীকারোক্তি আদায় করা হলো। কয়েক দিনের ব্যবধানে তিনিই আবার আত্মাহুতি দিতে চাইলেন!
রসুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া তরুণী রুমা!
১৪ অক্টোবর প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার তরুণী রুমা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে জানান, রসু খাঁ তাকে কুপিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। সে সময় রসু খাঁর বিরুদ্ধে রুমা মামলা করতে পারেননি। কারণ তার প্রকৃত পরিচয় রুমার জানা ছিল না। প্রকৃত পরিচয় না থাকলেও এ ঘটনায় কি পুলিশের খাতায় কোনো মামলাই ওঠেনি!
স¤ক্সাদকীয়: তদš সাপেক্ষে চরম অপরাধ
১৪ অক্টোবর প্রথম আলোয় একটি স¤ক্সাদকীয় প্রকাশিত হয়।
তাতে একটি কৌতূহলোদ্দীপক চরণ আছে, ‘তদš সাপেক্ষে এই চরম অপরাধের উপযুক্ত বিচার নিশ্চয়ই আদালত করবেন। ’ অপরাধ নিয়ে তদšের দাবির পাশাপাশি বলা হচ্ছে, এ অপরাধটি চরম। তালগাছ আমার ধরে নিয়েই বিচার করতে বলা হচ্ছে। স¤ক্সাদকীয়টির শিরোনামটিও আকর্ষণীয়, ‘রসু খাঁর নৃশংসতা, সমাজের টনক থাকলে তা এখনই নড়া উচিত। ’ রসুর নৃশংসতা স¤ক্সর্কে সর্বোচ্চ রায় দিয়ে আর কোন তদš বা উপযুক্ত বিচার করতে বলা হচ্ছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।