যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
গত পরশু হঠাৎ একটি মেইল পেলাম। মেইলের বিষয়বস্তুঃ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী ছাত্র দেলওয়ার হুসেন যুক্তরাজ্য-নিবাসী কথিত যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনউদ্দিনকে নিয়ে গার্ডিয়ানে একটি লেখা পোস্ট করেন। "Prosecute Bangladesh's war criminals" নামে। আর্টিকেলটি প্রকাশের পর পরই চৌধুরী মুঈনউদ্দিন লেখক এবং গার্ডিয়ানের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করার হুমকি দেয়। এই হুমকি পাবার পর পরই পত্রিকাটি ১৩ অক্টোবর সেই আর্টিকেলে মুঈনউদ্দিন পর্বটুকু মুছে দেয়, যা ব্রিটেনের বাঙালিদের বিস্মিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আখ্যায়িত একটি জোট যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দেশের শাসনভার হাতে নিয়েছে, যখন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আয়োজন চলছে, যখন আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার কার্যক্রম নতুন করে জোরেশোরে শুরু হয়েছে ঠিক সেই সময়ে কোন অদৃশ্য শক্তি বলে চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের মত লোক তার বিরুদ্ধে পুরোনো অভিযোগ নতুন করে লেখার কারণে মামলা করার ধৃষ্ঠতা দেখায়? কোন আন্তর্জাতিক কূটচক্রে ব্রিটেনের মত সর্বমতের দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র "মামলার ভয়ে" রিজয়েন্ডার দেয় সেটি বুঝতে অসুবিধা হলে একাত্তরে ঈঙ্গ-মার্কিন ভূমিকার স্মৃতিচারণ করে নিতে হবে। এর সাথে আরো যোগ করে নিতে হবে আমাদের আইনমন্ত্রির কথা। তিনি কিছুদিন আগেও বলেছেন-"যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কোন আন্তর্জাতিক চাপ নেই"! বাস্তবে আমরা কি দেখছি?
গত দু'দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে মেইল চালাচালির পর আজ ভাবছিলাম একটা পোস্ট দেব। তার আগে আমরা ক'জন "মুক্তাঙ্গন নির্মাণ ব্লগ" এ মুক্তাঙ্গন এডমিন এর পক্ষ থেকে একটি পোস্ট দিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বাঙালি ছাত্র দেলওয়ার হুসেন এর সাথে সংহতি প্রকাশ করা করি। ইতিমধ্যে এই সংহতি পোস্ট বিভিন্ন ব্লগ, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদিতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সামহোয়ারইন ব্লগ এর পাঠকদের জন্য এখানেও হুবহু পোস্ট করা হলো।
______________________________________________
সংহতি পোস্টঃ
গার্ডিয়ানে দেলওয়ার হুসেইনের নিবন্ধে যুদ্ধাপরাধী চক্রের কালো থাবা, রুখে দাঁড়ান
লিখেছেন: মুক্তাঙ্গন | ১৫ অক্টোবর ২০০৯, বৃহস্পতিবার
বাংলাদেশ যখন প্রত্যাশা করছে, ২০০৮-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকার তাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে, বিদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী যুদ্ধাপরাধীদেরও দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবে, ঠিক তখনই একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধাপরাধী চক্র আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, এ-ধরণের বিচারপ্রক্রিয়াকে ঠেকানোর জন্যে এবং বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত তথ্যায়ন প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করার জন্যে তারা যথেষ্ট সংঘবদ্ধ।
উল্লেখ্য, গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাকের ব্রিটেন সফর নিয়ে এই ব্লগেই এ মাসের পাঁচ তারিখে একটি পোস্ট লিখেছিলেন অবিশ্রুত এহুদ বারাকের ব্রাইটন মিশন : ব্রিটেন কি যুদ্ধাপরাধীদের ভূস্বর্গ? শিরোনামে। প্রসঙ্গত তিনি লিখেছিলেন,
ব্রিটেন যে যুদ্ধাপরাধীদের ভূস্বর্গে পরিণত হয়েছে, এই ক্ষোভ এর আগেও প্রকাশ পেয়েছে অন্যান্য দেশের বিভিন্ন নাগরিকদের মন্তব্য থেকে। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের কারও কারও নিরাপদ বাসস্থান এখন এই ব্রিটেন।
এই ব্রিটেনে বসেই গোলাম আযম পরিচালনা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন।
মুক্তাঙ্গনে এই পোস্ট প্রকাশের দু-দিন পর ৭ অক্টোবর তারিখে গার্ডিয়ান পত্রিকায় যুক্তরাজ্য-নিবাসী কথিত যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনউদ্দিনকে নিয়ে লেখেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশী ছাত্র দেলোয়ার হুসেন।
তাঁর লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘প্রসিকিউট বাংলাদেশ’স ওয়ার ক্রিমিনালস’, যাতে প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে, ব্রিটেনে আশ্রয়গ্রহণকারী বাংলাদেশের (কথিত) যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনউদ্দিনসহ বিভিন্ন জনের কথাও। চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের যুদ্ধকালীন ভূমিকা সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই জানি। গণহত্যাসম্পর্কিত একটি ওয়েবসাইটেও তার সম্পর্কে তথ্যপত্র রয়েছে, যাতে সুস্পষ্ট যে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
এমনকি ব্রিটেনে আশ্রয় নেয়ার পরও তিনি যে-ভূমিকা রেখে চলেছেন, তা অতীতের রাজনৈতিক আদর্শেরই জের। গার্ডিয়ানে লেখাটি প্রকাশ পাওয়ার পর চৌধুরী মুঈনউদ্দিন তা ধামাচাপা দেয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠেন এবং শেষ পর্যন্ত খানিকটা সফলও হয়েছেন বলা চলে। কেননা আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার হুমকির মুখে গার্ডিয়ান কর্তৃপক্ষ তাদের ওয়েবসাইটের মূল লেখাটিতে পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এ প্রসঙ্গে গার্ডিয়ান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন
On 13 October this article was changed following a legal complaint.
এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার, যুদ্ধাপরাধী চক্র খুবই সংঘবদ্ধ এবং তারা ব্রিটেনের একটি প্রধান সারির পত্রিকার ওপর সাময়িক কিংবা সুদূরপ্রসারীভাবে চাপ তৈরি করতে সক্ষম। গণতান্ত্রিকতা ও বাকস্বাধীনতা চর্চার সুযোগ গ্রহণ করে যুদ্ধাপরাধীরা এখন এখানে গণতান্ত্রিক আইনী পদ্ধতিতে ঐতিহাসিক ও প্রতিষ্ঠিত সত্যকেও পাল্টে ফেলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
কয়েকদিন আগে আমরা দেখেছি, ব্রিটেন থেকে ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী এহুদ বারাককে সদর্পে ঘুরে যেতে; আর এখন দেখতে পাচ্ছি, বছরের পর বছর ধরে এখানে বসবাসকারী এক যুদ্ধাপরাধীকে তার অপরাধ ঢাকার অপচেষ্টা চালাতে। আমাদের জানা মতে, চৌধুরী মুঈনউদ্দিনের পক্ষ থেকে লেখক এবং গার্ডিয়ান পত্রিকার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা রুজু করার চেষ্টা চলছে। যদিও এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, মুঈনউদ্দিনরা কি সত্যি সত্যিই মামলা করতে চায় নাকি মামলার ভয় দেখিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা মানুষদের কণ্ঠরোধ করতে চায়।
এটি বলার অবকাশ রাখে না, এই পরিস্থিতি আমরা মেনে নিতে রাজি নই। এও বলার অপেক্ষা রাখে না, আমরা দেলওয়ার হুসেইনের পাশে আছি।
তার প্রতি আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। আমরা দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই, সঠিক তথ্যই তিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর নিবন্ধটিতে। গার্ডিয়ান-এর লিগ্যাল টিম তাদের অবস্থান থেকে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় রাখার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলেও আমরা আশা করছি। এ ছাড়াও আইনী সহায়তা কেন্দ্রীভূত করা যায় কি না সেটি চিন্তা করতে হবে বিভিন্ন দিক থেকে। ইতিহাসের প্রকৃত সত্যকে আমরা আপোষহীনভাবে তুলে ধরব, প্রকাশ করব এবং এ জন্যে যে-কোনও ধরণের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে আমরা একটুও কুণ্ঠিত নই, দ্বিধান্বিত নই।
আমরা সকলের প্রতি আহ্বান রাখব, আমাদের এই প্রতিবাদ ও সংহতিজ্ঞাপক লেখাটি সবখানে ছড়িয়ে দিতে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বিভিন্নজনের সামর্থ্য অনুযায়ী আরও অজস্র প্রতিবাদগাথা রচনা করতে। আমরা সকলের প্রতি আহ্বান রাখব, যুদ্ধাপরাধীদের মুখোশ খুলে দেয়ার জন্যে আবারও সবাইকে কলম ধরতে, পাঠচক্র ও আলোচনা সভার মাধ্যমে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য তুলে ধরে সবাইকে সংঘবদ্ধ করতে; যাতে এই যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায়। আমাদের পূর্ব-প্রজন্ম গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন করে গেছেন; তাদের উত্তরসূরি হিসেবে আমাদের হাত একটুও কাঁপবে না এইসব যুদ্ধাপরাধীদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে শাস্তি দিতে, বরং আমরা আরও শাণিত ও সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তই নেব অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে।
আমরা জানি, ইতিহাস আমাদের পক্ষে, জনগণও আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। আমরা ইতিহাস এবং জনগণের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
_______________________________________________
এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু লিঙ্কঃ
১। Fact Sheet on Chowdhury Mueen-Uddin
২। The Guardian Gagged by Chowdhury Mueen-Uddin of the MCB
৩। The Guardian Has Received ANOTHER Libel Threat
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।