আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিকার

বা

শিকার ভোর; আকাশের রঙ ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল; চারিদিকে পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ। একটি তারা এখনো আকাশে রয়েছে; পাড়াগাঁর বাসরঘরে সবচেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো; কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে মুক্তা আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিল হাজার হাজার বছর আগে এক রাতে তেমনি- তেমনি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনো। হিমের রাতে শরীর 'উম্' রাখবার জন্য দেশোয়ালীরা সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে- মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন; শুকনো অশ্বথ পাতা দুমড়ে এখনো আগুন জ্বলছে তাদের; সূর্যের আলোয় তার রঙ কুঙ্কুমের মতো নেই আর; হয়ে গেছে রোগা শালিকের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো। সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকে বন ও আকাশ ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে। ভোর; সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে ঘুরে সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিল।

এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে; কচি বাতাবি লেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে; নদীর তীè শীতল ঢেউয়ে সে নামল- ঘুমহীন কান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা আবেগ দেওয়ার জন্য অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য; এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতো জেগে উঠে সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য। একটা অদ্ভুত শব্দ। নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মত লাল। আগুন জ্বলল আবার-উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরী হয়ে এল। নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় বসে অনেক পুরোনো শিশিরভেজা গল্প; সিগারেটের ধোঁয়া; টেরিকাটা কয়েকটি মানুষের মাথা; এলোমেলো কয়েকটা বন্দুক-হিম-নি:স্পন্দ নিরপরাধ ঘূম।

অন্ধকার গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার; তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম-পউষের রাতে- কোনদিন আর জাগব না জেনে কোনোদিন জাগব না আমি-কোনদিন জাগব না আর- হে নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, তুমি দিনের আলো নও, উদ্যম নও, স্বপ্ন নও, হৃদয়ে যে মৃত্যু শান্তি ও স্থিরতা রয়েছে রয়েছে যে অগাধ ঘুম সে আস্বাদ নষ্ট করবার মতো শেলতীব্রতা তোমার নেই, তুমি প্রদাহ প্রবহমান যন্ত্রণা নও- জানো না কি চাঁদ, নীল কস্তুরী আভার চাঁদ, জানো নাকি নিশীথ, আমি অনেক দিন- অনেক অনেক দিন অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে হঠাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে বুঝতে পেরেছি আবার; ভয পেয়েছি, পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা; দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে উঠে মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছে; আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়-আক্রোশে ভরে গিয়েছে; সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবীর যেন কোটি কোটি শূয়োরের আর্তনাদে উৎসব শুরু করেছে। হায়, উৎসব! হৃদয়ের অবিরল অন্ধকারের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে আবার ঘুমোতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে আবার ঘুমাতে চেয়েছি আমি, অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি। কোনদিন মানুষ ছিলাম না আমি। হে নর, হে নারী, তোমাদের পৃথিবীকে চিনিনি কোনদিন; আমি অন্য কোনো নত্রের জীব নই।

যেখানে স্পন্দন , সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম, চিন্তা, কাজ, সেখানেই সূর্য, পৃথিবী, বৃহস্পতি, কালপুরুষ, অনন্ত আকাশগ্রন্থি, শত শত শূকরের চিৎকার সেখানে, শত শত শূকরীর প্রসববেদনার আড়ম্বর; এই সব ভয়াবহ আরতি! গভীর অন্ধারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত; আমাকে কেন জাগাতে চাও? হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি, হে হিম হাওয়া, আমাকে জাগাতে চাও কেন। অরব অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠব না আর; তাকিয়ে দেখব না নির্জন বিমিশ্র চাঁদ বৈতরণীর থেকে অর্ধেক ছায়া গুটিয়ে নিয়েছি কীর্তিনাশার দিকে। ধানসিড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়ে থাকব-ধীরে-পউষের রাতে- কোনদিন আর জাগব না জেনে- কোনোদিন জাগব না আমি-কোনদিন জাগব না আর।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।