নিজেকে নিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা, এখোনো করে যাচ্ছি . . .
ছেলেদুটোর তাকিয়ে সহজেই অনুমান করা যায় ওদের বয়সটা, আমার থেকে তো বেশী নয়ই, কতই বা হবে ! বড়জোড় তেইশ কি চব্বিশ। হাতের তালুর ভাগ্য রেখাগুলো এখনও অমলিন, অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও যতটুকুন বোঝা যাচ্ছিলো, তাতেই দেখার চেষ্টা। কতটা দূর্ভাগ্য ওরা, ভাগ্য রেখাতেও ওদের ভ্রুক্ষেপ নেই।
“ওই মিয়া তাড়াতাড়ি করেন, যা আছে দিয়া দ্যান, বেশী কথা বাড়ায়েন না, মানুষ জমে গ্যালে কিন্তু সমস্যা হইবে” - এক উপুষে বলা কথাগুলোর মাঝে কিছুটা যতি চিহ্ন টেনে থামাতে চাইলে, পাশের ছেলেটার সতর্ক চাহনি আর অস্বস্তিকর উশখুশ করা থেকেই বুঝতে পারি, খুব একটা স্বস্তিতে কাজটি তারা করতে পারছেনা। চোখে-মুখেও সে কথা - কোথাও ভয়-আশংকা, আবার তড়িঘড়ি; কিন্তু যারা এ লাইনে প্রফেশনাল, তাদের তো এমনটা হবার কথা না! অভিজ্ঞতাটা আমার বেশ আগের - কারণ ছিনতাইকারীদের কবলে পড়া - এটাই প্রথম নয়।
‘দ্যাখো তোমরা সব নাও, ঠিক আছে, কিন্তু আমার মোবাইল টা ... ওটাতে অনেক..’ / “দ্যাখেন আপনে কিন্তু বেশী প্যাচাল পারতাছেন, বেশী কথা কন ক্যান ! মোবাইলটা এদিকে দ্যান ..” - ওদের হাতের ছোড়াটা যেভাবে অসংলগ্ন ছিলো, অপ্রস্তুত হাতে কখন যে তা ব্যবহার হয়ে যায় সে ভয়ও কাজ করছিলো; এক ঝাপটায় হাত থেকে কেড়ে নিতে চাইলো মোবাইলটা ‘আচ্ছা ঠিক আছে; নাও, কিন্তু নেবার আগে আমাকে একটা কল করতেই হবে .. সে সুযোগটুকুও দাও, প্লিজ’ - সত্যি বোধ হয় ছেলেদুটো এবার বিপদে ফেলে দিলাম, দুজনের তাকাতাকিতে আর অস্পষ্ট সিদ্ধান্তে আরো একবার স্পষ্ট হোলো তারা এ লাইনে কতটা আনস্মার্ট! “যা করবেন তাড়াতাড়ি করেন .... সময় নাই আমাদের” ওদের দূর্বলতার সুযোগকে আরো একবার হাতছাড়া করতে চাইলাম না। ওদের দুজনের একজন তুমি আরেকজন আপনি করে বলছিলো।
‘বাবা, বলো .. হুমম... না না ! .. আমি ঠিক আছি বাবা ... তুমি বলো ... না কোন সমস্যা নাই, জ্বী বাবা ... পথে .. আসছি ... নামগুলো বলো... তাড়াতাড়ি ...’ / “ওই মিয়া আপনারে না তাড়াতাড়ি কইতে কইলাম? রাখেন ?” এক ঝাপটায় আবারো কেড়ে নিতে চাইলো মোবাইল-টা। ‘কথা তো শেষই হয়নি .. তিনি অসুস্থ ...’
‘প্লিজ! আরেকটা’ .... ‘জ্বী ভাইয়া .. বলছি .. ভালো ... ভাইয়া, আমি তো রাস্তায় এখন .. জ্বী .. ফিরছি .. ভাইয়া আমি তো বিপদে পড়ে ..’ / “ওই ধরতো শালারে, শালা বেশী বাইরা গ্যাছে, ওই মিয়া তুমি কারে কও ..” / ‘ভাই শোনো শোনো .. আমি তো তোমাদের কথা বলতে চাইনি .. আমার সমস্যার কথা, ..’
“রাখেন আপনার ফোন ! একটা কইয়া প্যাচাল শুরু করছে” / “ওই দেখতো, ওর পকেটে কি আছে ?” / ‘দাড়াও দিচ্ছি .. এই নাও ঘড়ি’ “মানিব্যাগে টাকা নাই ক্যান? রাখচোছ কোই, বাইর কর ?” / ‘এইটা কি ? চালাকি করো ? এক্কেবারে দিমু যখন - তখন বুঝবা’
‘আসলে, আমার বাবা খুব অসুস্থ, প্রতিদিন তাকে ওষুধ দিতেই হয়, আজই বেতন পেয়েছিলাম .. শেষের দু-দিনের দুটো ডোজ দিতে পারিনি, আজ না দিলে ... তোমরা তো টাকাগুলো নিয়ে যাবে, তাই ভাইজানকে ফোন দিলাম - ও যদি কিছু পারে ...’
“ওই, শালার সব ভালো করে চেক কর” / ‘হাত উচা করেন ... দেখি .. মোজার ভিতর কিছু নাই তো!’, “আপনার বাবার কি হইছে” / ‘তিনি প্যারালাইসিস, ব্রেন স্ট্রোক করছিলো ...’ / “কবে ?” / ‘এইতো বছর ছয়েক হতে চললো’ / “ছয় বছর? এখনো বেঁচে আছেন?”/ ‘হুমম’
ছেলেটা আচমকাই থেমে গ্যালো, “আমার বাবাটাও .... করছিলো .. কিন্তু .....” বাম হাতটা পকেট থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চোখের আড়ালে কিছু একটা লুকোতে চাইলো, পারলোনা, আবছা আলোতে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ চোখের জল যখন টি-শার্টে জলের ছোপ ফেলে দিলো, ওটা কি এত দ্রুত শোকাবে?
“ওই, হইছে সব ? নে চল …কিরে দাড়ায়ে আছিস ক্যান” / “দাড়া, মোবাইল-টা দে তো !” / “ক্যান কি করবি” / “আরে দে না !”
“ধরেন, মোবাইল-টা রাখেন, টাকা-টা আমাদের দরকার”
“নে চল”
প্রাণহীন মানুষের মতো কিছুটা সময় নিস্তব্ধ দাড়িয়ে থাকি। বিচারবোধ এবং ভাবনাগুলোকে এলোমেলো করে দেওয়া সেই অমানুষ ছিনতাইকারী ছেলেগুলো এবং তাদের ভেতরে বাস করা পিতৃস্নেহের অমূল্য ভালবাসা, কোনটাকেই অগ্রাহ্য সম্ভব নয়।
ওদের হেটে চলা চেয়ে থাকি ... যতদূর না মিলিয়ে যায় ল্যাম্পপোষ্ট থেকে অদূরে আলো-অন্ধাকারের ত্রিমুখী সড়কে। আজ হৃদয়ের হাতেগোণা হিসেবি কতকটা আবেগ সত্যি সত্যি ছিনতাই হয়ে গ্যালো, ছিনতাই করে নিলো ছিনতাইকারী সেই ছেলেদুটো। মানিব্যাগের পকেট-টা খালি, সামনের বুক পকেটটাও।
“কোন সমস্যা ?” / ‘না ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই’ - ট্রাফিক পুলিশের সন্দেহের চোখটাকে এড়িয়ে যেতে আরও একবার সত্যিটা ছিনতাই করি এবার আমি নিজেই।
এক অর্থে, আমিও একজন ছিনতাইকারী; হয় আবেগের নয়তবা সত্যের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।