www.choturmatrik.com/blogs/আকাশ-অম্বর
‘ধুর্! শা...লা! মর্! মর্!’ – গোড়ালির নিচে থ্যাঁতলানো বেশ বড়সড় এক কেঁচোর দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে একদলা থুথু ফেললো হারান মাঝি। ‘হালার দিলো মেঝাজটা বিলা কইরা! কইত্থেইকা যে বাইরায় এইগুলান্!’ ঝড়-বাদলার দিন। কাল রাত হতেই একনাগাড়ে কি যে বৃষ্টি, কি যে বৃষ্টি! এখনও থামার নাম নাই। আজ ভোর হতেই অন্ধকার। সূর্য উঠ্ছে কিনা সেটা বোঝার সাধ্য কার? ‘আন্ধার! আন্ধার! নিকস্ কাইলা আন্ধার!’ পায়ের নিচেও আন্ধার জম্ছে।
আরও গাঢ় আন্ধার। কিন্তু এই আন্ধারেও থ্যাঁতলানো-থেবড়ানো দলাপাকানো উচ্ছিটাংশগুলো ঠিকই টের পাচ্ছে হারান মাঝি। স্যাঁতস্যাঁতে শেওলা পরা গাছের গুড়িতে গোড়ালি ঘষতে ঘষতে হঠাৎ গা ঘিন্ঘিনিয়ে উঠে তার। অপরাধবোধ? কিসের অপরাধবোধ! ‘বিষ্টি অইলেই বাইরাইতে অইবো? মাঙ্গের পুতেরা!’ আর যাই হোক, সকালের উথাল-পাথাল ক্রোধের কিছুটা উপশম কি হলো ঐ অদৃশ্যমান প্রলেপে? ‘ঠাঠা পর্ল নাহি! ধ্যুত্ নাহ্! আহ্লাদের প্যাট্ ডাক্তাছে!’ হ্যাঁ, পেটতো ডাকবেই। তার আর কি দোষ? ‘মাগীরে আইজ রাইতেই শ্যাষ করুম্।
’ মুঠোয় ধরা প্রাণপ্রিয় মুলি বাঁশের কোঁচটাতে কিঞ্চিত শক্ত হলো আঙুল। ‘মাগীয়ে কয় ভাত নাইক্যা......ক্যান, কাইল রাইতে মনে অয় নাই? বাইত আইলে আর তর সয় না! খান্কি কুনহান্কার!’ তেলতেলে কালচে শরীরে ক্রোধ উপ্চে পরলেও ঠোঁটের কোনায় কাম-তৃপ্ত মৃদু হাসি হারান মাঝির।
এই তো কিছুক্ষণ আগেই ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভিজে চুপ্সে হয়ে সে দাঁড়িয়েছে এই আমগাছটার তলে। প্লাবন! প্লাবন! বড়জোর দুই ক্রোশ হাঁটাপথ তার ঐ ভাঙ্গা মাটির ঘর থেকে, আর তারপর সরকার বাড়ির ঐ সিংহ-দরজা পার হয়ে আধা-ক্রোশ সামনের ঐ চিরচেনা জলপাই গাছটি ঘেঁষে বাঁক নেয়া পথের পরেই সে সম্মুখীন হয়েছিলো এক প্রমত্ত প্লাবনের হুংকারের। গুরুগম্ভীর, কিন্তু নিজের অস্তিত্ব বলিষ্ঠভাবে জানান দিতে অতিউৎসাহী ঐ মেঘমল্লাদের রাতভর অবিরাম তর্জন-গর্জন একবিন্ধুও দমাতে পারেনি মেঠোপথের দুইপাশের দুই দীঘির প্রাণচাঞ্চল্য।
বরং নিরঙ্কুশ সেই অঝোর-ধারা প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলেছে তাদের আবদার। আর তাই এক মহা-মুক্তির কামনায় তারা এখন নিজেদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক স্থূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবদ্ধ। এবং তার সহিত আশেপাশের বাদবাকি নিরীহ ঐ শস্যক্ষেত্র, সদা-শান্ত ঐ উঁচু ডিবিটা, গোবেচারা ঐসব পুকুর-ডোবা-নালা আর বোকা ঐ সরু খালটাও এক জলময়-ঔপনিবেশিকতার আক্রোশে পতিত। দুই দীঘির সেই আগ্রাসন এখন ছল্কে-ছল্কে এগিয়ে আসছে এই আম্রকাননের দিকেই। উথাল-পাথাল ক্রোধের আরেক অন্তর্হিত-জোয়ার সত্ত্বেও চারপাশ পর্যবেক্ষণপূর্বক এই মোটামুটি উঁচু গাছের গুড়িটাকেই তাই ক্ষণিকের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে হারান মাঝি; শীতল মস্তিষ্কে।
শান্ত নির্ভীক চিত্তে। প্রমত্ত সাগর দেখা আছে তার। কতবারই না ছোবল দিতে ফেনিয়ে আসা উন্মত্ত ডেউগুলোকে এই হাতেই কতল করেছে সে! কতবার! বজ্র-কঠিন সে হাত! কি নির্মমই না ছিলো সেই মুণ্ডপাত! আর হত্যার পর ফিনকি দিয়ে বের হওয়া সেই সাদাটে ফেনা-রক্ত দেখে কি ভয়ংকরই না ছিলো তার সেই অট্টহাসি! পশু ছিলো সে। ছিলো এক প্রমত্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ দানব। ঐ মায়াবী উন্মত্ত সাগরই তাকে বাধ্য করেছিলো হয়তো।
মায়াবী উন্মত্ত সাগর! – হঠাৎ আনমনা হয় মাঝি। আহ্! আজ হতে কতদিন? আজ হতে কতদিন আগে এক নিঝুম সন্ধ্যালগ্নে উজানগাঙ্গের হাটবার শেষে রহিম ব্যাপারীর সুপারির দোকানের কঞ্চির বেড়ার ফাঁক দিয়ে কার চোখে সে দেখেছিলো ঐ প্রমত্ত মায়াবী উন্মত্ত সাগরেরই এক প্রতিরূপ? তার প্রতিচ্ছায়া? তার আকুল হাতছানি? ঢাউস সাইজের এক মাছ শিকারের ফেনায়িত কাহিনীতে যখন তার সাঙ্গপাঙ্গরা মশগুল, তখন হারান মাঝির শক্ত পাথুরে বক্ষ-হৃদয়ে কুলকুল করে বইতে শুরু করেছিলো আরেক ফেনিল উন্মত্ত স্রোতধারা। নিরব-নিশ্চুপ ঐ রমণীয় দেহবল্লরীর বাঁকে বাঁকে সে শুনতে পাচ্ছিলো কি ভয়ানক কোলাহল। লতার মতন কোমল ঐ অঙ্গুলী, অপার রহস্যময় সেই গ্রীবা আর উষ্ণ ঠোঁটের সেই উত্তপ্ত আঁচে রীতিমত ঘর্মক্লান্ত মাঝির চওড়া শক্ত-সমর্থ পেশীবহুল দেহখানি। ধীর-লম্বা শ্বাস-প্রশ্বাসের চক্রে আবদ্ধ হারান মাঝি তাই মত্ত হয়েছিলো এক মহা-স্থূল তৃপ্তিকর কিছুর আস্বাদনে।
ঝিম্ঝিম্ মস্তিষ্কে। জুলজুল চোখে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সেই রমণীয় ঢুলুঢুলু দৃষ্টির তাচ্ছিল্য-হাসির দ্যোতনা তার চিরচেনা প্রবল প্রমত্ত উন্মাতাল সেই সাগরকে করে তুলেছিলো মহা-অচেনা, মহা-অনাকাঙ্ক্ষিত এক বস্তু। এ কি ভয়ানক আহ্বান! এ কি ভীষণ মাদকতা! মহাসমুদ্রও তো তার শিরায় শিরায় তুলতে পারেনি এত কাঁপন। এত রসের জোয়ার!
‘মাগীরে হগ্গলে কইতো কামিনী...তা আর কইব না ক্যান!’
মনে পরে, প্রবল প্রমত্ত উন্মাতাল সেই কামিনী-জলের নেশায় একটু অগ্রসর হতেই হারান মাঝি টের পেয়েছিলো ঐ নেশার লোভে লোভাতুর সে একা নয় মোটেই।
লোলুপ দৃষ্টিধারী জন্তুরাও ঘিরে ধরছে চারপাশ। আর এই নেশা এমনই এক নেশা যা চিরচেনা মিত্রকেও কোরে তোলে প্রতিপক্ষ। হ্যাঁ, গাঁজার আসরের কল্কি নয় ইহা। ‘খান্কির পুলা...ওইডা কি তর এক্লার?’ – পূব-পাড়ার রমজানের অস্ফুট বাক্যে হারান মাঝি তাই বুঝে গিয়েছিলো তার কর্মণ্য।
আর তাই সে পালায়।
কি বুঝে অস্বীকৃতি জানায়নি কামিনী। মুখোশধারী জন্তুর চেয়ে লোমশ তেল কুচকুচে চারপেয়ে জন্তু অনেক স্বস্তিকর।
তারপরের কাহিনী কি হতে পারে? মানব-মানবীর প্রেম? যাপিত জীবন? জীবন-স্রোতের সহিত মিথোজীবিতা?
হ্যাঁ, প্রেম বটে। এই রকমই এক বৃষ্টি-বাদলার সময় কামিনী-ডেরা হতে মধ্যরাত্রিতে পলায়নপূর্বক দূরবর্তী ভাটি অঞ্চলে ঘর বান্ধে হারান মাঝি। পরোয়া করে নাই অনিশ্চিত জীবনের।
অকুল-পাথারের এক মাঝি নিজেরে গুটায়ে নিলো শাদা শামুকের কৃষ্ণকালো খোলসের মইধ্যে। অনিশ্চিত জীবন! হারানের ডানহাতের ফুলে উঠা বজ্র-পেশীর দিকে তাকিয়েই বুঝি আপত্তি জানায়নি কামিনী। ঐটাই তো ভরসা!
নাহ্, প্রেম ঠিকই আছে। নইলে এই অসহ্য যাপিত জীবন, প্রতিকূল জীবন-স্রোতের সাথে এই মিথোজীবিতা টিকে থাকেই বা কি করে! কিভাবেই বা উহা বেড়ে উঠে, লতিয়ে উঠে, হাওয়ায় দোল খায়? কিন্তু এ কেমন প্রেম? প্রেম কি কোরে তোলে স্বার্থপর? প্রেম কি এত স্থুলভাবে চাইতে পারে প্রেয়সীকে? আহ্! শীৎকার-শৃঙ্গারের যত স্থূল পন্থা! কিসের শ্রদ্ধাবোধ? কিসের সূক্ষ্ণতাবোধ? কিসের উচ্চমার্গীয় আত্মার বন্ধন? যে মাঝি প্রমত্ত সাগরের, যে মাঝি ফেনিয়ে আসা প্রবল ডেউগুলোকে কতল করতো পাশবিক উন্মত্ততায়, অট্টহাসিতে – সেই প্রতিহিংসাপরায়ণ দানব কিভাবে অবদমিত করে রাখবে তার জান্তব-যৌনতা? তার মনের ক্ষুধা? সে কি বশ মানতে পারে সূক্ষ্মতায়? তাকে কি মানায় যাপিত জীবনের লুতুপুতু চরিত্রে? উঁহু। তাকে তাই চালাতেই হয় মধ্যরাত্রির এক অবিশ্রান্ত, প্রতিহিংসাপরায়ণ, উন্মত্ত ও স্থূল সাগর-তরী।
হারান নামের মাঝি তাই সহ্য করে না যাবতীয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আচার-আচরণ। করতে পারে না। রগচটা আর অধৈর্যশীল সে তাই প্রশ্রয় দেয় না কামিনীর যাবতীয় আহ্লাদিত আচরণ। দিতে পারে না। সেই তো আত্মত্যাগী! সেই তো বিসর্জন দিয়েছে তার স্বাধীন-উন্মুক্ত-উদ্দাম সাগর-জীবন! কামিনীর বুকেই তাই সে নিরন্তর খুঁজে বেড়ায় সেই হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তসমষ্টি।
কামিনীকেই তাই অবতীর্ণ হতে হয় সেই উদ্দাম স্রোতস্বিনীর ভূমিকায়, হারান যেখানে শুধুই এক অতৃপ্ত-আত্মার উন্মত্ত মাঝি। তাই হায় লুটোপুটি খাওয়া রমণীয় সূক্ষ্ণতাবোধ! হায় প্লেটোনিক ভালবাসা! হায় অব্যক্ত নারী-অনুভূতির পরতে পরতে জমতে থাকা! তবে নিশীথের সেই উন্মত্ত ও স্থূল সাগর-তরীর অবিশ্রান্ত ছন্দিত ঐকতানই বুঝি যাবতীয় শূন্যতার ক্ষণিক উপশম।
এ হেন বাঁশঝাড়ে ছাওয়া হারান মাঝির ভাঙ্গা মাটির ঘরে নদী-সাগরের সঙ্গমে যখন জন্ম নিলো এক পলি-সমৃদ্ধ শিশু, কামিনীর ভেতরের শূন্যতা হতে জেগে উঠে এক হিমালয়-গঙ্গোত্রী সদৃশ মাতৃপ্রেম। তার ঔরস থেকে যে জন্ম নিতে পারে তারই আরেক প্রতিরূপ! তার নিঃসৃত ফোটায় যে প্রাণ-সঞ্চার হয় শুষ্ক মৃত্তিকায়! কামিনী অবাক্ হয়। কামিনী বিস্ময়াভিভূত হয়।
পরম মমতায় সে জড়িয়ে ধরে তার সন্তানকে। সৃষ্টিরহস্য কিঞ্চিত উন্মুক্ত তার কাছে এখন। সে বুঝে ফেলে তার বেঁচে থাকার উচ্চমার্গীয় উদ্দেশ্য। সে নিজের অজ্ঞাতেই এক লোমশ তেল কুচকুচে চারপেয়ে জন্তু হতে নিজের চারপাশে এক পার্থক্যসূচক-উল্লম্ব দেয়াল তুলে দেয়।
বিধি বাম! কিছুদিন যেতে না যেতেই পলিমাটির সেই শিশু রাত্রির দ্বিপ্রহরে কামিনীর কোলেই বিলীন হয়ে যায়।
ঢলে পরে মৃত্যুর কোলে। ভিটার পাশেই এক বাশগাছের তলায় সন্তানকে গোর দিয়ে শীতল মাটির দাওয়ায় আলুথালু চুলে বসে থাকা এককালের স্রোতস্বিনী কামিনীর চোখ হয়তো এড়িয়ে যায় ঘরের ভেতরে মরে থাকা দুটো ইঁদুরের অস্তিত্ব।
আর প্রবল ঝড়-বাদলার এক দিনে, এক আম্রকাননে, গোড়ালির নিচে থ্যাঁতলানো বেশ বড়সড় এক কেঁচোর দলাপাকানো থেবড়ানো উচ্ছিটাংশগুলোর ঘিন্ঘিন্ করা কিছু অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক পিশাচ তার অন্য হাতে ধরে রাখা ইন্দুর-মারার এক শূন্য শিশির গায়ে আলতো করে আঙ্গুল বুলাতে-বুলাতে আনমনা হয়ে কি যেন ভাবতে থাকে।
অপরাধবোধ? কিসের অপরাধবোধ!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।