করণিক: আখতার২৩৯
গুরুত্ব
জনপদে বেড়িয়ে নিজেকে জানার উপদেশ দিয়ে
দায়িত্বমুক্ত বিশ্বগুরু বিশ্রাম নিতে আশ্রমে ফিরে যান।
শিষ্যদের মধ্যে একজন ছিলো অনুগত,
সে গুরুর উপদেশে নিজেকে জানার চেষ্টা করলো।
নিজের জন্মক্ষণ সহ পিতা মাতার নাম, ঠিকানা, বংশ পরিচয়
জানতে চাইলে সে যেন গুরুকে নির্ভুলভাবে জানাতে পারে
এমন ভাবে মনে রাখলো।
তবে, অন্যান্য শিষ্যরা যারা গুরুর উপদেশ শুনেও
নিজেদেরকে জানার চেষ্টা করেনি,
তাদেরই মজলিসের দাওয়াতের খাওয়া খেয়ে
গুরু ফিরছেন তাঁর আশ্রমে,
তা’ যখন দেখলো অনুগত শিষ্যটি, ধন্যবাদ পাওয়ার লোভে
নিজেকে কতখানি জেনেছে সে
সবিনয়ে তা’ প্রকাশ করলো গুরুর কাছে গিয়ে।
গুরু বিরক্ত হ’য়ে বললেন,
-“দেখলে তোমাকে একজন মানুষের মতোই মনে হয়
অথচ একটা জংলী জানোয়ারের চে’ও অধম!
কাল ক্ষয় না-ক’রে মানুষ হবার চেষ্টা করো,
আমার সময়ের মূল্য আছে,
যাও, নিজেকে জানো, এখনি আমাকে ফিরতে হবে আশ্রমে।
”
অপদস্থ শিষ্যটি অপমানবোধ নিয়েও অনুগত থেকে থেকে
গুরুর উপদেশে আবারো নিজেকে জানার চেষ্টা চালালো।
কোন্ ক্ষেত্রে নিজের কতখানি দক্ষতা আছে,
--তা’ জানতে পারাকেই নিজেকে জানতে পারা ভেবে
সে একটা তালিকা সাজালো।
একনিষ্ঠ শ্রমের মাধ্যমে
তাত্ত্বিক জ্ঞানার্জনে, দর্শনে, বিজ্ঞান চর্চায়, কারিগরি শিক্ষায়,
সৃষ্টির সূত্র সন্ধানে, পরিচালনায়, সম্পাদন কর্মে,
ধ্র“বতা পরিবর্তনশীলতা ইত্যাদি ইত্যাদি,
--সর্বোপরি সাধারণ জ্ঞানে
যেখানে যেভাবে তার দক্ষতাকে প্রমাণ করেছিলো,
--সেগুলোকে গুছিয়ে ঐ তালিকাটা ভরালো।
জনপদে বেড়িয়ে নিজেকে জানার উপদেশ দিয়ে
দায়মুক্ত বিশ্বগুরু বিশ্রাম নিতে আশ্রমে ফিরে যান।
যারা গুরুর উপদেশ শোনে, কিন্তু বুঝতে না-পেরে
অথবা সময় সুযোগের অভাবে
নিজেদেরকে জানার চেষ্টা করে না
তাদেরই দেওয়া পোশাক-পরিচ্ছদে সজ্জিত
বিশ্বগুরু যখন সামনে দাঁড়ালেন,
অনুগত শিষ্যটি ভাবলো,
--যদি কখনো দেওয়ার সুযোগ পেতাম,
অথবা তিনি নিজে যেকোনো মূল্যমানের গুরুদক্ষিণা
অন্যদের মতো আমারও কাছ থেকে যদি নিতেন দয়া ক’রে,
--আমিও ধন্য হতাম।
--নিজের দক্ষতার তালিকাবহনকারী শিষ্যটি,
আত্মবিশ্বাসের সাথে হারানো সৎসাহস ফিরেছিলো যার,
গুরুকে দাওয়াত দিয়ে সাথে নিয়ে গেলো নিজের ঠিকানায়।
শিষ্যটি তার দক্ষতার সনদগুলো মেলে ধরলো গুরুর সামনে।
দেখতে দেখতে গুরু বললেন,
--শুনছি, ছড়িয়েছে নাকি ইদানিং তোমার অনেক নাম-ডাক,
এগুলোই তাহলে সেগুলোর প্রমাণ নিশ্চয়?
অনুগত শিষ্যটি যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চায়,
তবুও মাথা তুলে বললো সে,
--আপনার যে শিষ্যটি আপনার আদেশে
ভুয়ো জাত্যভিমান পরিত্যাগ ক’রে নিজেকে জেনেছে,
নিজের দক্ষতাগুলো খুঁজে খুঁজে পেয়েছে,
সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে দক্ষতায় সহযাত্রীদেরকে টপকে গ্যাছে,
ফলাফলে জুটেছে এতো এতো ধন ও মান,
--এ সবকিছু আপনারই অনুদান,
আজ ফিরিয়ে দিয়ে আমি ঋণমুক্ত হ’তে চাই,
--আমি ধন্য হবো আপনি দয়া ক’রে যদি সব নিয়ে যান।
গুরু হাসলেন তাচ্ছিল্যমাখা হাসি।
শিষ্যটি মাথা নোয়ালো,
--পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
আপনি আস্থা রাখতে পারেন,
--আমার ওপর নির্ভর ক’রে যাচাই করুন আমি ধন্য হই।
বিশ্বগুরু তাকে বাজে বক্ বক্ থামানোর আদেশ দিয়ে বললেন,
-একটা গাধাও যদি হ’তে পারতে তো পরখ ক’রে দেখা যেতো
কতখানি বোঝা তোমাকে দিয়ে টানানো যায়;
তোমার চে’ বেশি আছে
একটা পোষা কুকুরেরও একনিষ্ঠ পাহারাদারির দক্ষতা;
একটা বলদও তোমার চেয়ে দক্ষতর, অথচ তা’ জানো না,
এখানেই প্রমাণিত, --এখনো কত গভীর তোমার অজ্ঞতা!
আমি বলি, কাল ক্ষয় না-ক’রে মানুষ হবার চেষ্টা করো।
আমি বলি, নিজেকে জানো।
--আর একটা তালিকায় নিজের অদক্ষতাগুলো
খুঁজে খুঁজে সাজিয়ে দেখাতে পারলে
তোমার উপর কতখানি আস্থা রেখে নির্ভর করা যায়
তা’ আমরা নিশ্চিতভাবে বুঝে নেবো;
প্রমাণ দিয়ে বোঝাতে হবে না, --নিজেরাই বুঝে নেবো।
মানুষ হ’তে পারলে, -জানি গুরুদক্ষিণা তুমি নিজে দিতে পারবে না;
দিতেও বলি না, --নিজেই চেয়ে নিয়ে ধন্য হবো;
তবে এখনি আমাকে ফিরতে হবে আশ্রমে।
জনপদে বেড়িয়ে নিজেকে জানার উপদেশ দিয়ে
দায়িত্বমুক্ত বিশ্বগুরু বিশ্রাম নিতে আশ্রমে ফিরে যান।
অনুগত ব্যর্থ শিষ্যটি অবশেষে গুরুর অদেশে
‘নিজেকে জানা’র অর্থ বুঝতে পেরে
নতুন তালিকা ভরাতে সকল কর্মক্ষেত্রেই খোঁজে নিজের অদক্ষতা;
--তার প্রমাণিত দক্ষতাগুলোর ভেতরেই
যেসব অদক্ষতার প্রমাণ বেরিয়ে আসে,
--সেগুলোকে সংশোধন করতে করতে
যতই নির্ভুলতার দিকে এগিয়ে যায়,
অনুগত শিষ্যটি অবাক হ’য়ে ততই ভাবতে থাকে,
--ধকল যতই সহ্য করছি কেবল অস্তিত্বকেই করছি জয়,
না-জানা কর্মকাণ্ডে দেইনি আমার দক্ষতার পরিচয়;
--এখনো অনস্তিত্বের সঙ্গে মোকাবেলার পাইনি অবকাশ!
না-জানি পাবো কি না, এ্যাতো নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস!
-কীভাবে মানুষ হবো! --যেখানে আমি আজও অজ্ঞ ক্রীতদাস!
--তার উপর নিজেকে যে জানবো গুরুর আদেশে!
কোথায় কখন পাবো সুযোগ বা সময়! এ-ধারার ব্যস্ত পরিবেশে!
জনপদে বেড়িয়ে নিজেকে জানার উপদেশ দিয়ে
দায়মুক্ত বিশ্বগুরু বিশ্রাম নিতে আশ্রমে ফিরে যান।
নির্ঘাত অপদস্থ হওয়ার প্রস্তুতি আর সৎসাহস নিয়ে
গুরুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সমর্পিত শিষ্যটি
প্রকাশ করলো তার সত্য স্বীকারোক্তি,
-ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছি আমি, তবু ক্ষমা চাই
মহামান্য বিশ্বগুরু, --আমি আজও নিজেকে জানতে পারিনি,
আমার অদক্ষতার তালিকার বিশালত্ব আঁচ ক’রে
ওদিকে না-গিয়ে বরং আত্মসংশোধনে ব্যস্ত হ’তে বাধ্য হয়েছি।
--এতকাল অপদস্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো
অথচ বিপরীতটাই ঘটেছে,
--পাওয়ার বিনিময়ে যা’ কিছু দিয়েছি আমি
প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখ্ছি আমার অদক্ষতার ছাপ!
বাজার দরের চে’ অনেক বেশি হারে মূল্য পেয়ে পেয়ে
গ্রহীতার কাছে আজও আমি ভীষণভাবে ঋণী;
--ভেবেছিলাম, গুরুদক্ষিণা চাইলে
আমার অদক্ষতার তালিকাটাই পৌঁছে দেবো গুরুর আশ্রমে।
অথচ দেখুন, আমার প্রকাশিত অযোগ্যতাগুলো সংশোধনের কাজে
আজ আমি এতই ব্যস্ত যে, তালিকাটা সাজাতেই পারিনি।
গুরু হাসলেন তৃপ্তিমাখা হাসি।
-গুরুর কাছে স্বীকার করতে এখানে তো বাধা নেই,
--এখনো নিজেকে জানতে শুরুই করতে পারিনি।
যেসকল গ্রহীতা আমার অদক্ষতাগুলোকে ক্ষমা করেছে
ওদের চাহিদা পূরণেই আমি ব্যস্ত এতকাল
এতটুকু শুধু জেনেছি যে আমি অক্ষম নরাধম।
আপনার নির্দেশে নিজেকে জানতে
আমার নিত্য বাড়ন্ত অদক্ষতার ঐ তালিকাটা সাজানো!
অসম্ভব লম্বা! যার শুরুটাই, -তালিকা সাজানোর অদক্ষতা!
--এখনো নিজেকে দ্যাখার অবকাশ জোটেনি, তবে আশা ছাড়িনি,
-ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতা নেই, তবুও ক্ষমা চাই
মহামান্য বিশ্বগুরু, --আমি আজও নিজেকে জান্তে পারিনি।
তৃপ্ত গুরু মহানন্দে শিষ্যকে জড়িয়ে ধ’রে বললেন,
--যা’ জেনেছো তা-ই যথেষ্ট, এর চে’ বেশি কেউ জানতে পারেনি,
--চলো, আজ আমি নেবো গুরুদক্ষিণা।
গুরুকে দেখা যায় শিষ্যের সাথে শিষ্যের ঠিকানায়।
--তোমার ঐ চাদরখানা ঐতিহ্যবাহী,
ইদানিং জড়াচ্ছো না দেহে, তা’ লক্ষ করেছি।
গুরুর চোখে তবে কিছুই এড়ায় না!
-নিমেষেই ভেবে নিয়ে শিষ্যটি বললো,
--গুরুর অজানা নয়, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ঐ চাদরখানা
যুগ যুগ ধ’রে আমার পূর্বপুরুষের অযোগ্যতার নিশানা বহনকারী।
শিষ্যের চাদরখানা নিজের দেহে জড়িয়ে নিয়ে গুরু বললেন,
-গুরুদক্ষিণা নিলাম, -আজ অন্য এক জনপদ থেকে শুন্ছি ডাক।
--অপদস্থ এ চাদরখানা তবে আমার সঙ্গেই যাক্;
যাবার আগে তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি আমার গুরুত্ব;
--এখন থেকে এই জনপদে
তোমার কোনো অনুগত শিষ্য গুরুত্ব পাওয়া পর্যন্ত
গুরু রূপে তোমাকেই জানবে সকলে।
আর জংলী অসত্য অহংকারে জন্তুর মতো উন্মত্তরা,
নিজেদের অদক্ষতা খুঁজে দেখবে না যারা,
তাদেরই দেওয়া গুরুদক্ষিণায়
তুমি খেয়ে প’রে সসম্মানে বাঁচবে সমকালে।
শিষ্যকে গুরুদায়িত্ব দিয়ে বিশ্বগুরু চ’লে যান আড়ালে।
যুগে যুগে অনুগত শিষ্যরাই অবশেষে গুরুত্ব পান।
জনপদে বেড়িয়ে নিজেকে জানার উপদেশ দিয়ে নিত্য কর্তব্য শেষে
সকল বিশ্বগুরু বিশ্রাম নিতে আশ্রমে ফিরে যান।
রঙ্গপুর ০১/০৬/২০০৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।