আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়ন করছি।
'আল-মুকাদ্দিমা' শব্দের অর্থ যদিও বা ভূমিকা তথাপি এই আল-মুকাদ্দিমা আর সাধারন অর্থে যে ভূমিকা তার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে ।
ইবনে খলদুন তার ইতিহাসকে ৩টি গ্র্ন্থে ও ৭টি খন্ডে বিভক্ত করেছেন । এই ব্যাপক পরিকল্পনার ভূমিকায় তিনি ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব , ঐতিহাসিকদের ভ্রান্তি এর কারন ও ফলশ্রুতি এবং তার ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন । মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট ও তৎকালে প্রচলিত এম্ন কোন বিষয় নেই যা তিনি সংগ্রহ করেননি ।
এ কারনেই তার এই ব্যাপক সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ একদিকে গ্রন্থটিকে যেমন একটি বিশ্বকোষ জাতীয় রচনায় পরিণত করেছে , অন্যদিকে তেমনি এটি তার ভূমিকারই বিষয় বিস্তার বলে পরিগনিত হয়েছে ।
তার মতে,মানুষের শ্রম ও চিন্তার ফসল রূপেই সভ্যতা সংস্কৃতির বিচিত্র উপাদান গড়ে উঠেছে । প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরূপতা ও সহায়তাই মানুষকে এ সকল উপাদান সৃষ্টির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে । কারন কোন একক মানুষের পক্ষে যেহেতু জীবনের সামগ্রিক চাহিদা মিটিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয় , সেজন্যই মানুষ সেচ্ছায় সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করতে উৎসাহিত হয়েছে এবং পরস্পরের সহায়তায় জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে নিয়েছে । (পৃঃ৩৭)
সভ্যতা সংস্কৃতির বিনির্মাণে এভাবে সামাজিক শক্তি ও প্রকৃতির উপস্থিতিকে প্রাধান্য দেয়া স্বত্বেও ইবনে খলদুন অতীন্দ্রিয় শক্তিতে বিশ্বাস করেন ।
এরই ফলশ্রুতি হিসেবে তিনি একাত্তবাদের ধারনাকে অত্যান্ত বলিষ্ঠ আকারে উপস্থাপিত করেছেন এবং যাদু,ইন্দ্রজাল ইত্যাদি সম্প্রকিয় ধ্যানধারণা পোষনেও তিনি নিস্পৃহ নন ।
চিন্তাশক্তির বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া স্বত্বেও মানুষ যে প্রানিজগতেরই অধীন এবং এই বৈশিষ্টের কল্যাণেই যে তথাকথিত ধর্মহীন জাতিগুলির মধ্যেও সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে, এ তথ্যকেও তিনি তার যুক্তির সমর্থনে উল্লেখ করেছেন । (পৃঃ৩৮)।
আল-আসাবিয়াঃ
অতীন্দ্রিয় শক্তির বধান্যতায় মানুষ যখন তাদের চিন্তাশক্তির আকর্ষণে পরস্পরের সহায়তা লাভে এগিয়ে গেছে এবং সম্মিলিত প্রয়াসে পৃথিবীর বুকে অধিকার প্রতিস্ঠার চেষ্টা করেছে ,তখনই 'উমরান' বা সভ্যতার জন্ম হয়েছে । ইবনে খলদুন তার আল-মুকাদ্দিমায় আলোচিত এই নুতন বিষয়ের নামকরণে এ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ।
সহজ কথায় সভ্যতা সংস্কৃতি বলতে যা বুঝায় তা হল ,এই মানব সমাজেরই বিনিরমিত কীর্তিমালা । কিন্তু মানব সমাজ বা এই জনশক্তির প্রচেষ্টা স্বত্বেও উপরোক্ত কীর্তিমালা সর্বত্র সমানভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি । অনুরূপ বৈচিত্রের কারন হিসেবে প্রাকৃতিক প্রভাবের কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি । ইবনে খুলদুন এ প্রকার বহির্গত কারন ছাড়াও সমাজ শক্তির অন্তর্গত একটি কারণও অত্যান্ত সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করেছেন । এ কারণটিকে তিনি নাম দিয়েছেন 'আসাবিয়া' বা গোত্রপ্রীতি ।
এ প্রীতিশক্তি যে পরিমানে সঙ্ঘবদ্ধ ও সক্রিয় হয়েছে ,সভ্যতা বিনির্মাণে তার প্রভাবও হয়েছে ততোই স্থায়ি ও দর্শনীয় । বস্তুতঃ এই গোত্রপ্রীতি থেকেই মানুষের গোত্রবদ্ধ জীবনের বিকাশ এবং এটি মানুষের সমাজ বিকাশের প্রাথমিক স্তর । ইবনে খুলদুন একেই 'বদয়া' বা 'যাযাবরী' জীবন বলে আখ্যায়িত করেছেন ।
কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবকালে এবং পরবর্তী ইসলামী চিন্তাধারাতেও এই 'আসাবিয়া' বা 'গোত্রপ্রীতি'কে সুনজরে দেখা হয়নি । ইসলাম এই যাযাবরী গোত্রপ্রীতির বাধা অপসারিত করেই সমগ্র আরবকে এক ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করতে চেয়েছিল ।
(পৃঃ ৩৯)
সাম্রাজ্যের বয়সসীমা ঃ
ইবনে খুলদুন সাম্রাজ্যের বয়ঃসীমা নির্ধারণ করেছেন । তার মতে , যে কোন সাম্রাজ্য সজীব সক্রিয় অবস্থায় তিন পুরুষের অধিক টিকে থাকে না ,এরপরও তার স্থায়িত্ব অবক্ষয়ের অধীন জীবন্মৃত অবস্থার নামান্তর মাত্র । আধুনিক রাষ্ট্র বলতে যা বুঝায় ,আল-মুকাদ্দিমায় তার কোন সুস্পষ্ট উল্লাখ নেই । অনেক স্থলেই রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য একই পরিনতির অধীন ।
এভাবে ইবনে খুলদুনের মানুষ আদিম যাযাবর গোত্রজীবন থেকে যাত্রা শুরু করে পরিণামে নাগরিক সভ্যতার রূপকার হয়ে দাড়িয়েছে ।
তিনি বলেছেন,'যারা পরিশ্রমের দ্বারা জীবিকা অর্জনের সহজ পথ ত্যাগ করেছে তারাই এ সকল শ্রমবিমুখ শাস্ত্রাদির উপর নির্ভর করে প্রতারনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে । অবশ্য পরিনামে তারা নিজেরাই প্রতারিত হয়েছে । কারন সভ্যতার ভিত্তি প্রতারনা নয় পরিশ্রম । (পৃঃ৪১)। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।