আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আবজাব কথা-১

এডিট করুন

মস্কোর দমোদেদোভোতে রাত এগারটার দিকে এসে নামলাম। ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ খুজতে লাগলাম। ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইনের ঝামেলা শেষ করতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল। লাগেজ খুজতে গিয়ে আর লাগেজ পাই না। এক জায়গায় দেখি লাগেজ নামাচ্ছে।

কিন্তু সেটা অন্য শহর থেকে যে যাত্রীরা এসেছে তাদের লাগেজ। শেষতক এয়ারপোর্টের এক কর্মীর কাছ থেকে জানলাম লাগেজ না পেলে কোথায় খোজ নিতে হবে। গেলাম সেখান। দেখলাম আমার লাগেজ, হারানো লাগেজগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। বেচারা একা বড়ই কষ্ট পাচ্ছে এই বিজাতীয় জায়গায়।

তাড়াতাড়ী ওকে উদ্ধার করলাম। এইবার আসল ট্যাক্সীওয়ালারা। এখানে বেশীরভাগ উজবেকিস্তান, তুর্কেমানিস্তান, কাজাখাস্তানের লোকরা ট্যাক্সী চালায়। এক জন এক জন করে আমার সঙ্গ দিতে লাগল আর বলতে লাগল "তাক্সী নাদা, তাক্সী?" আমার উত্তর "নিয়েত"। তবুও আমার পিছু ছাড়েনা।

ক্রাইসিস মনে হয় এখনও কাটে নাই। প্রথমেই একটা সিম কার্ড কিনলাম। আমার সিম কার্ড মস্কোতে চলে না। সব শহরে চলে এমন একটা সিম কার্ড কিনলাম। আমার দুস্ত শুভ্রর আসার কথা এয়ারপোর্টে।

ও বলেছিল এয়ারপোর্টের দ্বিতীয় তলায় একটা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট আছে। সেখানে যেন আমি ওর জন্য অপেক্ষা করি। আমি চললাম আমার গাট্টি গোছকা নিয়ে উপরের তলায়। হঠাৎ পানির পিপাসা পাওয়ার একটা ভেন্ডর মেশিনের সামনে থামলাম। প্রথমে একশ রুবলের একটা নোট ভরে তিরিশ রুবলের একটা সেভেন আপের কৌটা কিনলাম।

ফেরত হিসেবে একগাদা পাচ রুবলের কয়েন দিল। পাচ রুবলের পাচটা কয়েন ঢুকালাম আরেক বোতল পানি কেনার জন্য। হঠাৎ মাঝপথে মেশিন বিকল। কপাল একেই বলে! ইচ্ছা করল মেশিনটা ধরে কতক্ষন ঝাকাই। পরে ভাবলাম থাক দরকার নাই।

পরে ভাবলাম ফোন করা যেতে পারে মেশিনের ব্যাপারে। কপাল আর কি! মোবাইলের চার্জ পুরো শেষ। মোবাইল পুরো বন্ধ হয়ে গেছে। কোনভাবেই চালু হচ্ছে না। ব্যাটারী বের করে কিছুক্ষণ ঘষলাম নিজের হাতের তালুতে যদি একটু কিছু হয়।

আমার করার কিছু ছিল না......... না গো......... দেখলাম মোবাইল চালু হল (যাক কাজ হইছে) ভাবলাম এই মেশিনের ব্যাটারে কল না দিয়া শুভ্ররে একটা কল দেই আগে। এইটা বেশী জরুরী। দিলাম কল। বলে "গ্রাহক অগম্য এলাকায় অবস্থিত"। আবার চার্জ শেষ।

চার্জার কোন ব্যাগে আছে কে জানে। বাবা মা লাগেজ গুছিয়ে দিয়েছে। আমি দেখিও নাই উনারা কোথায় কি রাখছেন। শুধু বলেছিলাম চার্জার মেইন লাগেজে দিয়ে দিতে। কে জানে কোন চিপায় পড়ে আছে চার্জার বাবাজী।

ভাবলাম দুই তলায় গিয়ে লাউঞ্জে বসে খোজা যাক হালকা পাতলা। দিলাম দুই তলায় পাড়ি। খুজে বের করলাম ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টটা। রেষ্টুরেন্টের সামনেই বসার লাউঞ্জ। একটু গুছিয়া বসলাম।

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। চার্জারটা খোজার চেষ্টা চালালাম। কিন্তু পেলাম না। বাসায় না জানি কি টেনশন করছে! আমি শুভ্রর অপেক্ষায় বসে আছি। বসে আছি বসে বসে আছি বসে আছি............... হারামজাদার কোন খবর নাই।

ঐদিকে আমার ঘুমে অবস্থা কাহিল। মানুষের সবচেয়ে বড় নিরীহ শারীরিক কষ্ট আমার মতে টয়লেট চেপে রাখা। এর পরেরটাই সম্ভবত ঘুম চেপে রাখা। এক মগ কফি কিনলাম, ব্লাক কফি। চিনি, দুধ, ক্রীম সব বর্জিত।

তারপরেও দেখি ঘুম বাবাজী যায় না। বিমানে আমার কোনকালেই ঘুম আসে না। টানা ২৪ ঘন্টার উপরে হয়ে গেছে না ঘুমিয়ে। তার উপরে এই ভ্রমণের ধকল। বসে আছি তবু আমার দুস্তের দেখা নাই।

হারামজাদার জন্য যে কষ্ট করে আমি বসে আছি এই কষ্টটা কোন রুপবতীর পিছনে খরচ করলে এতক্ষণে একটা প্রেমের মহাকাব্য হয়ে যেত। মনে আছে কিনা আপনাদের জানি না, একবার এক জাপানীজ মহিলা বাংলাদেশে এসে পড়েছিলেন তার স্বামী সন্তানের খোজে। সে কি প্রেম কাহিনী। এইসব জীবনের মহাকাব্য এখনও দেখা যায় বলেই হয়তো এখনও পৃথিবীটা সুন্দর। হারামির খবর নাই।

আমি নিশ্চিত আমার বাসায় ইতিমধ্যে গোলযোগ আরম্ভ হয়ে গেছে। আশঙ্কা পরে সত্যি হয়েছিল। মা সারারাত ভরে কেদে কেটে বুক ভাসিয়েছে। আমার মা পারলে আমাকে পেটের ভেতর ভরে রাখে। এখনও মায়ের হাতে খাই।

আসলে আমি আমার মায়ের শরীরের একটা অংশ। তাঁর শরীরের এই অংশটির প্রতি তার মাত্রাহীন ভালবাসা। টানা সাত ঘন্টা বসে থাকার পর সাদা সাহেবের আগমন ঘটিল। এসেই বলে দোস্ত তুই ফোন ধর। তোর বাসা থেকে ফোন দিতাছে আমার মোবাইলে বারবার।

আমি ভয়ে ধরতাছিনা। আমি বলি তুই এইডা একটা কাম করলি। তুই জানস আমি এই এয়ারপোর্টে বইসাই আজকে পাচশ রুবলের কফি খাইয়া ফালাইছি। ও বলে দোস্ত মাফ কর। আমার মারাত্মক সমস্যা ছিল।

তাই আসতে পারি নাই। এখন তাড়াতাড়ি চল, ট্যাক্সী নিয়া আইছি, নীচে ট্যাক্সী দাড়া করাইয়া রাইখা আইছি, ১৫ মিনিটের বেশী দাড়া করাইয়া রাখা যায় না, জরিমানা করব তাইলে। আমি কিছু বলার আগেই ট্যাক্সী ড্রাইভার আর শুভ্র মিলা আমার লাগেজ নিয়া দৌড়ানি আরম্ভ করল সময় শেষ হওয়ার ভয়ে। বলে, দুস্ত যা কথা গাড়ীতে কইস। এখন চল।

বাসার কল ধরলাম। বাবা মা দুইজনেই শুভ্রর উপর রেগে আগুন। অ এত দেরী করল কেন। আমারে বলতেছে তোর আর ওর ফ্লাটে যাওয়ার দরকার নাই। তুই সোজা ষ্টেশনে চলে যা।

এত কষ্ট যখন করছিস তখন আরেকটু কর। আমি বলি ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি বললাম তোমারা মোবাইলের চার্জার কই রাখছ? উনারা বলে মনে হয় তোর কাধের ব্যাগে। আমি বলি কানবা না কেন তোমারা। চার্জারটা পাইলে আমি তোমাদের একটা খবর দিতে পারতাম।

তাইলে আর এত কান্নাকাটি করা লাগত না। যাই হোক মনটা খারাপ হয়ে গেল। শুভ্র বলে দুস্ত আমার মালিক আসলে একট বানচোত। হারামীরে এত কইলাম আমার এক ভাই আইব এয়ারপোর্টে আমারে একটু ছুটি দেন। কিন্তু আমারে উলটা কয় তাইলে যায় সমস্যা নাই, তবে কালকে থেকে আর আসার দরকার নাই।

বঝলাম ওর অবস্থা। বললাম তুই মোবাইল ধরলি না কেন। বলে দুস্ত আমার রেষ্টুরেন্ট মাটির নিচে। আর সিম ব্যাবহার করি এক মাক্ষুইন্দ্যা কোম্পানীর। নেটওয়ার্ক নাই।

খালি বংলাদেশে সস্তায় কথা বলা যায় দেইখা এই সিমডা ব্যাবহার করি। আমি বুঝলাম ওর অবস্থা। কইলাম ঠিক আছে যা। বুঝলাম। মস্কো নিয়া একটা কথা আছে।

মস্কো চোখের পানিতে বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ এখানে দয়া মায়ার কোন স্থান নেই। আজকে চাকরি গেলে ও কালকে কি করবে? এর থেকে আমার সাত ঘন্টা বসে থাকা তেমন কোন ব্যাপার না। এই শুভ্রও আমার সাথে এক বিমানে আসছিল রাশিয়ায়। ডাক্তারী পড়তে।

স্কলারশীপেই আসছিল। ওর পকেটে সম্বল ছিল দুই ডলার। বাড়ীর অবস্থা তেমন ভাল না। থাক আরেকদিন ওর কথা বলব। সেইটা আরেক কাহিনী জীবনের।

জীবনের আরেকটা দিক। সংগ্রামের দিক। হতাশা আর আশাভঙ্গের দিক। মাঝে মাঝে মনে হয় সব লাত্থি মাইরা ভাইঙ্গা ফালাই। চলবে...............


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।