সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
রেমিট্যান্স আয় বাড়ছে কিন্তুঃ
রেমিট্যান্স আয়ে নতুন রেকর্ড হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ। সাম্প্রতিককালে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ ক্রমেই সুসংহত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভের পরিমাণ ৯৩৬ কোটি ৬১ লাখ মার্কিন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। ২০০৬-০৭ অর্থ বছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল প্রায় ৬০০ কোটি ডলার।
তবে ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে প্রবাসী বাঙালীরা পাঠিয়েছিল ৪৮০ কোটি ডলারের ওপর। রেমিট্যান্সের আয় ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ। এর পেছনে কয়েকটি কারণ কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমত: দেশের বাজারে অব্যাহতভাবে ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির জন্য প্রবাসীরা তাদের পরিবারের বাজার খরচ মেটাতে বেশি করে টাকা পাঠাচ্ছেন। এর ফলে সামগ্রিকভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
দ্বিতীয়ত: ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের ফলে হুণ্ডির পরিবর্তে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরো বেড়েছে। এর ফলে চলতি অর্থ বছরে আগের বছরের তুলনায় প্রতিমাসে বৈদেশিক মুদ্রায় গড় রিজার্ভ প্রতি মাসে অনেক বেশি ছিল। পাঁচ বছর আগে গড় রিজার্ভ বছরে দেড়শ কোটি ডলারের কম ছিল।
রেমিট্যান্স বাড়ার প্রধান কারণ বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের সংখ্যা বৃদ্ধি। প্রতি বছরই চাকরির খোঁজে হাজার হাজার বাংলাদেশী যাচ্ছে।
এদের অধিকাংশই অর্ধশিক্ষিত এবং ন্যূনতম দক্ষতার অধিকারী। কায়িক শ্রমদান করে বিদেশী চাকরি করার জন্যই এরা বিদেশে যায়। শিক্ষিতদের তুলনায় এরাই বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠায়, কেননা এদের পরিবার রেমিট্যান্সের টাকার ওপর অনেকটা নির্ভর করে। শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির ক্ষেত্রে এই কারণ তেমন কাজ করে না। বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকরা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে।
বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানোর সুযোগ তাদের সামনে খোলা ছিল না। বাধ্য হয়ে অথবা প্রলুব্ধ হয়ে তারা হুণ্ডি ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়ে হুণ্ডি ব্যবসা বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়ায় অনেকেই এখন বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। হুণ্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর বিষয়টি অনেকদিন থেকেই জানা ছিল। কিন্তু উহা প্রতিরোধ করার জন্য খুব কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বরং যা বিদ্যমান ছিল তাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অথবা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। যেমন লন্ডনে হাই কমিশনে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য একটি সেলের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সেখানে সোনালী ব্যাংকের কার্যক্রমের সংকোচন। বৈধ চ্যানেল হাতের কাছে না থাকার জন্যই অনেকে বাধ্য হয়ে হুণ্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। বৈধ চ্যানেলকে আমাদের প্রায় দোরগোড়ায় নিয়ে আসতে হবে যেমনভাবে কাজ করে হুণ্ডি ব্যবসায়ীরা। তাদের সেবায় যে ক্ষিপ্রতা এবং দক্ষতা দেখা যায় বৈধ চ্যানেলে একই ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতা দেখাতে হবে।
নচেৎ কেবল আইন করে হুণ্ডি বন্ধ করার ব্যবস্থা করলে তা পুরোপুরি বন্ধ হবে না। অন্যদের মত প্রবাসীরাও উন্নতমানের সেবা চায় এবং সেটা দিতে না পারলে কেবল আইনের দোহাই দিয়ে তাদের উৎসাহিত করা যাবে না।
বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য যে ব্যবস্থা সেটি এক এক দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর প্রবাসীর প্রয়োজনকে মনে রেখে নির্ধারিত হতে হবে। যেমন মধ্যপ্রাচ্যে যারা কায়িক শ্রম দিয়ে কাজ করছে তাদের চাহিদা একই অঞ্চলে শিক্ষিত ও দক্ষ প্রবাসীদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। তারা যে সেবা চায় তা শিক্ষিত ও দক্ষ প্রবাসীদের চেয়ে পৃথক ধরনের ও মাত্রার।
একই সেবা এই দুই শ্রেণীর জন্য কার্যকর হতে পারে না। আবার মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় যারা যুক্তরাজ্যে বা যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছে তাদের চাহিদা কিছুটা ভিন্ন। এইসব ভিন্নতা বিবেচনায় না এনে সকল প্রবাসীদের জন্য একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হলে তা সুফল দিতে ব্যর্থ হবে। সেবা প্রদানে এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শনে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছিল বলেই অতীতে রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা বৈধ চ্যানেলের বাইরে থেকে গিয়েছে। বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাঙালীদের চাহিদা বিশ্লেষণ করে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রতি বছর রেমিট্যান্স বৃদ্ধির প্রধান কারণ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যা বৃদ্ধি। আগেই বলা হয়েছে, এদের মধ্যে অল্প শিক্ষিত ও সীমিতভাবে দক্ষ ব্যক্তিদের সংখ্যাই বেশী। এরা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর এবং প্রায় ক্ষেত্রে গ্রামীণ। স্বল্প শিক্ষিত এবং দরিদ্র হবার কারণে এরা নানা ধরনের দালালের প্রতারণার স্বীকার হয় যা মাঝে মাঝে কাগজে সংবাদ হয়ে দাঁড়ায়। পৌনঃপুনিকভাবে সংবাদ হলেও তাদের সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান হচ্ছে না।
ফলে তারা নানাভাবে প্রবঞ্চিত এবং শোষিত হয়েই যাচ্ছে। কিছুদিন পুর্বে জাতীয় একটি দৈনিকের সংবাদে পড়েছিলাম- মালয়েশিয়ায় ৯০০ বাংলাদেশী খোলা আকাশের নিচে দিন-রাত কাটাচ্ছে। সেখানে শারীরিক নির্যাতনে কয়েকজন শ্রমিক আত্মহত্যা করেছে বলে জানা গিয়েছে। মালয়েশিয়ায় যে ৯০০ বাংলাদেশীর খবর বেরিয়েছে তারা আদম বেপারীদের প্রতারণার শিকার হয়েছে। এই আদম বেপারীদের মধ্যে যেমন বাংলাদেশীরা রয়েছে তাদের সঙ্গে রয়েছে মালয়েশিয়ার নাগরিকরাও।
সংবাদে প্রকাশ, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার সে দেশের শ্রম মন্ত্রণালয়ের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। বাংলাদেশী শ্রমিকদের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০টি কোম্পানির নাম মালয়েশিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয়ের কাছে দেয়া হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশী শ্রমিকরা ঐ পত্রিকার প্রতিবেদককে জানিয়েছে যে, তারা মালয়েশিয়ায় যাবার জন্য ঢাকায় রিক্রুটিং এজেন্টের কাছে জনপ্রতি দুই লাখ টাকা জমা দিয়েছে। অনেকেই জমি-জমা বিক্রি করে অথবা ধার-কর্জ করে বিদেশে চাকরি পাওয়ার আশায় এই টাকা দিয়েছে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে কাজ করেও তারা মালিকদের কাছ থেকে কোনো বেতন পায়নি, বরং নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
মালিকদের নির্যাতনে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে, একজন অন্ধ হয়ে গিয়েছে, একজনের কিডনী নষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং ক'একজনের আত্মহত্যার কথা শোনা গিয়েছে। এভাবে অন্য অনেক দেশ থেকেই প্রতিদিন আসছে ভাগ্যাহত শ্রমিকের লাশের কফিন!
প্রবাসী শ্রমিকদের প্রবঞ্চনা ও নির্যাতনের ঘটনা এই প্রথম না। এটা প্রায় রুটিনে পরিণত হয়েছে। তাদের দুর্দশা শুরু হয় দেশ থেকে যাত্রার আগেই যখন তারা দালালদের খপ্পরে পড়ে এবং রিক্রুটিং এজেন্টদের কাছে এসে টাকা জমা দেন। অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া চাকরির আশ্বাস দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়।
আবার অনেক ক্ষেত্রে বিদেশে নিয়োগকারী মালিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাকরি না দিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে। দেশে শ্রমিকদের জন্য জনশক্তি অধিদপ্তর রয়েছে, বিদেশে দূতাবাস রয়েছে। প্রবাসে গমনেচ্ছু এবং প্রবাসী শ্রমিকদের যে সেবা এইসব কর্তৃপক্ষের দেয়া উচিত তা দেয়া হলে শ্রমিকদের দেশে এবং বিদেশে এমনভাবে শোষণ, প্রবঞ্চনা এবং নির্যাতনের শিকার হতে হতো না। এইসব কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্ব পালনে বেশ উদাসীনই বলতে হবে। মাঝে মাঝে আবার এদের বিরুদ্ধে অভিযোগও পাওয়া গিয়েছে।
সরকার এদিকে দৃষ্টি দিলে অনেক সমস্যার আগাম সমাধান হয়ে যেতে পারে। সমস্যা দেখা দেওয়ার আগেই একটা পদ্ধতি চালু করা হলে প্রবাসীদের এবং প্রবাসে গমনেচ্ছুদের দুঃখ-কষ্ট অনেকটা লাঘব করা যেতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশে যে বিদেশে এত দূতাবাস রয়েছে তার অন্যতম যৌক্তিকতা হলো সেখানে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশীদের সেবা দেয়া। এটা মনে না রেখে কেবল ভিআইপি অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকলে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করা হবে না। এই সহজ সত্যটি অনেকেই বোঝেন না বা বুঝতে চান না।
তারা কেবল কত টাকা রেমিট্যান্স হিসাবে জমা হলো তার উল্লেখ করেই আত্মতৃপ্তি লাভ করে থাকেন।
প্রবাসী শ্রমিকরা কীভাবে দিন কাটাচ্ছে কেমন তাদের কাজের পরিবেশ এসব সরেজমিনে দেখে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংস্থার সদস্যদের বিদেশে পাঠানো যেতে পারে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে প্রবাসীদের উপকার হবে।
রেমিট্যান্স বাড়ছে বলে তৃপ্তি প্রকাশ করা স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের বদৌলতে এই রেমিট্যান্স বাড়ছে তাদের স্বার্থও দেখতে হবে।
রেমিট্যান্স প্রেরণকারীরা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশাল অবদান রাখছে। তাদের জন্য দেশ কী করছে, কতটুকু সেবা দিচ্ছে, সেই বিষয়ও ভেবে দেখতে হবে। শুধু ভেবে দেখা নয়, তাদের কল্যাণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সরকারের দায়িত্ব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।