তাং;-১৩/০৮/১৯৯৫
প্রিয় রাজ,
আমি কিন্তু ঠিক ই জানতাম একদিন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমার মত সাধারন মেয়ের কোন ক্ষমতা ছিলনা তোমার মত সুদর্শন মেধাবী ছেলের জীবন সঙ্গিনী হবার। সব বুঝেও আমি তোমাকে ভালবাসতাম। মানুষ যখন নেশা করে তখন সে তার ক্ষতি হচ্ছে এটা জেনেই করে। আমিও সব জেনেই তোমাকে চিঠি লিখতাম।
তোমার সাথে পাশাপাশি রিকশায় বসে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি তে বেড়াতে যেতাম। ছায়াবানী সিনেমা হলে ছবি দেখতে যেতাম তোমার সাথে। ছায়াবানী সিনেমা হলেই ত আমরা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবি দেখলাম, তাই না?
ফেরার সময় কারেন্ট ছিল না। চাঁদের আলোয় পথ দেখে আমাদের রিকশা চলছিল। ভাঙ্গা রাস্তায় আমার গা বারবার তোমার গায়ের সাথে লেগে যাচ্ছিল! আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, তুমি আমার হাত ধরে ছিলে সেইটাতে আমার লজ্জা লাগছিল না।
কিন্তু গায়ে গা লাগাতে ভীষন লজ্জা লাগছিল! আমাকে চমকে দিয়ে তুমি হঠাৎ বলেছিলে- ছবির নায়িকা মৌসুমি দেখতে খুব সুন্দর! শুনে আমার সারা শরীর শক্ত হয়ে গিয়েছিল! আমি যতটুকু সম্ভব রিকশার কোনার দিকে ঘেঁসে বসতে বসতে বলেছিলাম- মৌসুমি কে খুব পছন্দ হইছে না? ত যাও না মৌসুমির কাছে। আমার কাছে কি! তুমি হো হো করে হেসে উঠেছিলে আর আমার অনিচ্ছা(!)র বাঁধাগুলোকে নিষ্ঠুর ভাবে অপমান করে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে! তারপর আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিলে- মৌসুমি যতই সুন্দর হোক আর যাই হোক সে’ত আমার ‘বাঁকা হাসির মেয়ে’ না! তুমি আমার বাঁকা হাসি’র মেয়ে!
বাঁকা হাসির মেয়ে!
আমাকে শুধু একবার দেখার জন্য যখন তুমি আমার কোচিঙে যাবার রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে সেই সময়ে আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- তুমি ত শুধু আমাদের নাটোরের না। দেশের সেরা ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র দের একজন। আমার মত সাধারন একটা মেয়ে কে কি দেখে ভালবাসলে? তুমি বলেছিলে, তোমার ঠোঁটের কোনায় হঠাৎ হঠাৎ একটা বাঁকা হাসি খেলা করে। সেটাই আমাকে পাগল করে দেয়!
সেই থেকে আমি তোমার বাঁকা হাসির মেয়ে! হায়রে বাঁকা হাসির মেয়ে! তোর মনটাও কেন যে তোর হাসির মত বাঁকা হল না!
আচ্ছা রাজ, তুমি যে বিড়াল চোখের বড় লোকের মেয়েটাকে বিয়ে করছ সেটা ত আমি মেনেই নিয়েছিলাম।
আমি যখন আম্মা কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছিলাম তখন আম্মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল- আল্লাহ পাক জোড়া মিলায় নাই মা! আমাদের ত কিছু করার নাই!
আমি আল্লাহ পাকের বিধান মেনে নিয়েছিলাম। তুমি ঘুরে ঘুরে রাজবাড়ির পাথরের সিংহ দেখাচ্ছ, আর বিড়াল চোখের একটা মেয়ে তোমার হাত ধরে সেই দৃশ্য দেখছে- এই দুঃসহ দৃশ্য আমি সহ্য করে নিয়েছিলাম।
কিন্তু তুমি ওকথা আমাকে কেন বলতে গেলে? ‘দুঃখিত সোমা, জীবনের বাস্তবতার কাছে পরাজিত হলাম, তোমার ভালোবাসা’র মূল্য দিতে পারলাম না!’ এই কথা দিয়ে তুমি আসলে কি বুঝাতে চাইলে?
রাজবাড়ি’র সান বাঁধানো ঘাটে বসে তুমি আর আমি সুন্দর একটা ছিমছাম ঘর, তোমার একটা সৎ চাকরি, ব্যাঙ্কে মাসে মাসে কিছু টাকা জমানো, বিয়ের দু’বছরের মাথায় ফুটফুটে একটা বাচ্চা! কত সুন্দর বাস্তবতা তৈরি করতাম!
আমাদের ‘সেই বাস্তবতা’ বিড়াল চোখের বাবার ঢাকায় বিশাল বাড়ি,গাজী পুরে দুটা বড় ফ্যাক্টরি আর বিড়াল চোখের ঠাঁটঠমক দিয়ে তৈরি ‘এই বাস্তবতা’র কাছে হেরে গেল!!
হায়রে! ‘আমাদের ভালোবাসা’ কত সহজে ‘তোমার ভালোবাসা’ হয়ে যায়!
চিঠি শেষ করার জন্য কি লিখব? এই চিঠি’র ত শেষ নাই! বাঁকা হাসির মেয়ে ত অনন্ত কাল তোমাকে চিঠি পাঠাতেই থাকবে রাজ! সেই চিঠি হয়ত মিলে তৈরি কাগজে কালির কলমে লিখা নয়। সেই চিঠি কোন ডাক পিয়ন দিয়ে যায় না খামে ভরে! কিন্তু সেই চিঠি ত তুমি আজীবন পেতে থাকবে রাজ!!
আর শুধু দু’টা কথা বলে এই কালির কলমের চিঠি শেষ করব।
আমার ভয়ে এখন আমাদের পাড়ায় কোন বিড়াল ঢুকেনা।
বিড়াল দেখলেই আমি লাঠি নিয়ে তাড়া করি!
আমি একা একা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেক চেষ্টা করি বাঁকা হাসি হাসতে। পারি না। একসময় আয়নাটা ঝাপসা হয়ে যায়। আমি আর কিছু দেখতে পাই না।
ইতি,
সোমা
(বাঁকা হাসির মেয়ে)
আমার নতুন রুমমেট সরোদ আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
চিঠি হাতে নিয়ে আমি হত বিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি!
আমি সরোদ কে জিজ্ঞেস করলাম- সরোদ তুই ত রাজ ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছিলি, ভাবী’র চোখ কি বিড়াল চোখ?
সরোদ বিস্মিত হয়ে বলল- তুই জানলি কেমনে? ভাবী’র বিড়াল চোখ নিয়ে ত কত মজা হল। আলীম ভাই বলল- কি রে বেটা রাজ! বাসর রাতে সবাই কাল্পনিক বিড়াল মারে, তুই ত দেখি আসল বিড়াল মারার জন্য নিয়ে এসেছিস!
রাজ ভাই সদ্য পাশ করে হল ছেড়েছেন। আমি আগের সীট ছেড়ে রাজ ভাইয়ের সীটে এসে উঠেছি। বিছানার তলা ঝাড়ু দেবার সময় আজকে চিঠি টা হাতে পেলাম! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।