আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার মেয়েবেলা-হোস্টেরের স্মৃতিঃ পর্ব-৪



(বকে বকে সকলের মাথা খুব ধরিয়েছি!......এবারে সমাপ্তি......) হোমের কথা সে ভাবে বলা হয়নি। হোমে যারা থাকত তাদের অনেকেরই মা-বাবা ছিল না। এ প্রসঙ্গে প্রতিমাদির কথা মনে পরল। উনি হোমেই বড় হন। বাইরে থেকে আমাদের হোস্টেলে পড়াতে আসতেন।

ঠিক সবিতাদির উল্টো। খুব হাসি-খুশি। খেলার ছলে পড়া করিয়ে দিতেন। কিন্তু সবিতাদি ওনাকে বিশেষ পছন্দ করতেন না, বেশ বুঝতাম। এ সময় আশ্রমে বড় উৎসব শুরু হয়।

প্রতিমাদি ওনার মেয়েকে নিয়ে এলেন- সেই শিল্পীদিকে দেখি, ঠিক যেন শিল্পীর হাতে তৈরি। শিল্পীকে সবার ভাল লেগে যায়। লম্বা, ফর্সা, কোঁকড়ানো ঘাড় পর্যন্ত চুল, মুখে চাপা মিষ্টি হাসি। শিল্পীদির গজ দাঁত ছিল। মন খুলে হাসলে আরও সুন্দর লাগত।

শিল্পীদি কোনো একটা নাটকে কৃষ্ণও সাজল। কিন্তু তার কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিমাদি মারা গেলেন। ওনার স্বামীও ওনাকে ছেরে যান। ফলে শিল্পীদির স্থান হল হোমে। আমার চেয়ে বড় হলেও স্কুলে আমার ক্লাসেই ভর্তি করা হল।

কিছুদিন পর দেখলাম ওকে নেড়া করে দিল। আমার খুব কষ্ট হত, সেই শিল্পীদি!মার সাথে সুন্দর সেজেগুজে পুতুলের মত আসত!হোস্টেলে সবাই কত ভালবাসত! তাকে হোমে না জানি কি কষ্টটাই না সহ্য করতে হত। অথচ শিল্পীদির মুখে সেই আগের মতই হাসি লেগে থাকত। ক্লাসে আমিও শান্ত ধরনের ছিলাম। তবু নানা ভাবে শিল্পীদিকে একটু সাহায্য করার চেষ্টা করতাম।

সে সময় ছুটিতে জলপাইগুড়ি গেলাম। পাপা জলদাপাড়ায় ঘুরতে নিয়ে গেল। হলং বাংলোতে ছিলাম। হাতির পিঠে জঙ্গলে গন্ডার, হরিণ দেখলাম। পাপা প্রচুর ছবি তুলল।

সেগুলি হোস্টেলে ও স্কুলে সবাইকে দেখালাম। শান্ত শিল্পীদি তার থেকে আমার দুটো ছবি চেয়ে নিল। আমার এত ভাল লাগল, কি বলব! হোমের মেয়েদের সাথে সবিতাদি বেশি মিশতে দিতেন না। ওরা আমাদের চেয়ে বেশি আনন্দ করত। মনে আছে দোলের আগের দিন রাতে ন্যাড়া-পোড়া হত।

আমরা হোস্টেলের জানলা দিয়ে দেখতাম হোমের মেয়েরা বিশাল খড়ের পুতুল করে তাকে পোড়াচ্ছে। যদিও পরের দিন হোম-হোস্টেল ভুলে সবাই এক সাথে খুব মজা করতাম। হোমের একটি মেয়েকে মনে পড়ছে। সেও আমার সাথে একই ক্লাসে পড়ত। ৫এ হোমের বেশ কয়েকটা মেয়ে আমার সাথে স্কুলে পড়ত।

তারা হঠাৎ ঠিক করল হোস্টেলের সবচেয়ে ফর্সা আমি ও হোমে ওই মেয়েটি-নাম ছিল মনে হয় সোমা-আমাদের ‘প্রিয়বন্ধু’ হতে হবে। ঐ ‘সই’ পাতানোর মত ব্যাপার, আর কি! কি সব ছড়া কেটে বন্ধুত্বও করে দিল। কিন্তু আগে আমরা যাওবা কথা বলতাম, এবার দেখা হলেই লজ্জা পেতাম। বিকেলে মাঠেও সবাই আমাদের খ্যাপাত। হোমে আরেকটি বিখ্যাত মেয়ে ছিল ‘ইংরেজ’।

আসল নাম মনে নেই। হোমে-হোস্টেলে সবার একটা করে ডাক নাম থাকত। আমি গুটিসুটি মেরে শুতাম তাই ডাকত-খরগোস। তো, ইংরেজ একটু পাগলী ধরনের ছিল। খুব চ্যেঁচিয়ে গান ধরত।

ওই দেখায় লিচুপাতা খেলে নাকি মুখ পান খাওয়ার মত লাল হয়। হোস্টেলে আমরা দুষ্টুমীও করতাম। আমার আর সীমার ট্রাঙ্ক পাশাপাশি ছিল। বাড়ি থেকে আনা টুক-টাক খাবার আমরা ভাগ করে খেতেম। একবার ঝগড়া হল।

সীমা আমার পাশে বসে আমায় না দিয়েই খেতে শুরু করল। আমি কিন্তু আমার থেকে ওকে দিলাম। এবার ও-ও আমায় দিল। আমি খেলাম না। এতে সীমা খুব রেগে গেল! আমায় জোর করে খাওয়াবেই! আমিও কিছুতেই খাবনা!ব্যাস্‌!ও আমায় মাটিতে ফেলে জোর করছে, আর ঠিক সে সময় সবিতাদি ঘরে ঢুকেছেন! বেশ করে দু’জনের মাথা ঠুকে দিলেন।

সীমার সাথেই দেখছি আমার বেশি লাগত! একবার আমরা পাশাপাশি বসে পড়ছি। হঠাৎ কি ভেবে আমি সীমার গালে আমার পেন দিয়ে দাগ দিলাম। পেনের কালি বোধহয় শেষ হয়েগেছিল। ফলে সীমার গালে দাগ লাগেনি, কিন্তু ওতো দেখতে পাচ্ছেনা! আমার ভারি মজা লাগল। সীমাটা খেপে গেল।

এবার ও আমার হাতে দাগ দিল। তারপর আমি ওর পায়ে...ও আমার মুখে...এই ভাবে আমরা দু’জনে দু’জনকে রং করতে লাগলাম যতক্ষণ না সবিতাদি এসে পিট্টি দেন। আরেকটা মজার ঘটনা বলি। আমাদের বড় হলের বাইরেই টানা চওড়া ও বড় বারান্দা ছিল, শেষে লাইব্রেরী। বারান্দায় বড় বড় টেবিল থাকত সেখানে দু’বেলা আমরা পড়তাম।

বারান্দায় গ্রীল লাগান ছিল। সেখানে আমরা রুমাল, মোজা এসব শুকতাম। প্রায়ই সেগুলো গ্রীলের ফাঁক দিয়ে চওড়া কার্নিসে পরত। আর দেবিকাদির মাথাটা সরু বলে ও গ্রীলে মাথা গলিয়ে লাঠি দিয়ে তা তুলে দিত। সবিতাদি এটা জানতেন না।

আমার দেবিকাদিকে দেখে ও রকম করার সখ হল। সে দিন স্কুলে যাবার সময় কার কি পরে গেছে, দেবিকাদিও স্কুলে চলে গেছে। আমি ময়দানে নামলাম। খুব কায়দা করে মাথা গলিয়ে জিনিষটা উদ্ধারও করলাম। কিন্তু আমার মুন্ডুটি গেলেন আটকে।

কি করি! বেশি কেউ নেই সব স্কুলে গেছে, ক’জন যাবার তোরজোর করছে। সবিতাদিও এসময় কাজে যেতেন। উনিও ব্যস্ত! এদিকে সামনে হাইস্কুলের বারান্দায় দু-একজন করে জড় হচ্ছে, পাশে আমার প্রাইমারী স্কুলের ছেলে-মেয়েরা নিচে ভীড় করছে। হাইস্কুলের বুড়ো নেপালী দারোয়ান কোথা থেকে খবর পেয়ে নিচে এসে চেঁচাচ্ছে। বিকেলে আমরা বড় মাঠে খেলতে যেতাম।

দারোয়ান আমায় বেশ ভালবাসত। দিদু চিৎকার করচ্ছে গ্রীল কাটতে হবে। এসময় সবিতাদি এলেন। সবাই আমার মাথা নিয়ে অনেক টানাটানি করল। কিন্তু সে আর বেরতেই চায়না! সবিতাদি ঠিক পাপার মত ছিলেন।

খুব চ্যাঁচামেচি করতেন, কিন্তু কিছু করতে ভয় পেতেন। সবাই বলছে-গ্রীল কাট। উনি রেগে গিয়ে চ্যাঁচাচ্ছেন ‘আমি গ্রীল কাটব না, দীপান্বিতার মুন্ডু কাটব। ’ হাঃ-হাঃ, এখন লিখতে লিখতে কত মজাইনা পাচ্ছি। কিন্তু তখন ভয়ে, লজ্জায় মাটিতেও মিশতে পারছিলাম না।

শেষে মুনমুনদির বোন মঞ্জুদি-যে একটু-আধটু ম্যাজিক দেখাত, সে আমার পার নিচে ইট দিয়ে, কায়দা করে হ্যাচকা টান মেরে মুন্ডুটি উদ্ধার করলেন। তারপর!...আমায় খাটে বসিয়ে ১মে সবিতাদি দু’গালে ঠাস্‌ ঠাস্‌ শুরু করলেন। তারপর দিদু, তারপর যারা যারা ছিল প্রায় সবাই হাত ঝালিয়ে নিল। তবু সবিতাদি চ্যাঁচাচ্ছেন। কারণ আমি কাঁদচ্ছি না, মুখ ফুলিয়ে, লাল করে বসে আছি! অনেক পরে হোস্টেলে যেতে সবিতাদি হেসে আবার সে প্রসঙ্গ টেনে বললেন-তুমি কি ভাবে অমন বুদ্ধি মাথায় এনেছিলে! আমি দেবিকাদির কথা বল্লাম।

উনি বললেন, তখন বলনি কেন?...কিন্তু তখন আর কে কার কথা শুনছিল! আমরা রবিবার দুপুরে বারান্দায় বসে ক্যারাম, বিস্‌নেস্‌ম্যান-এসব খেলতাম। আমার ক্যারামে খুব নেশা, এদিকে হেরে যাই। শিখাদি তুখোড় ক্যারামে। তবু ও কিন্তু সব সময় আমায় ওর জোড় নিত। আরেকটা ঘটনা বলে হোস্টেল পর্ব শেষ করব।

দিনটা ছিল শনিবার। পরের দিন গার্জেন ডেট। শনিবার হাফ স্কুল হয়। সামনে কোন টানা ছুটিও পড়বে, সবাই বাড়ি যাব। তাই মনের আনন্দে সব মাঠে খুব খেলছি।

বড় আর ছোটোরা আলাদা খেলতাম। কিন্তু সেদিন কি হল, আনন্দে সব এক সাথে খেলছিলাম। খেলাটা ছিল-‘বুড়ি ছোঁয়া’। আমাদের মাঠ ছিল বিশাল বড়। সেখানে একদিকে বড় বড় বকুলগাছ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে।

মাঝে ইটের বেদী, সেখানে যে বুড়ি সে বসে। দৌড়ে এসে তাকে ছুঁতে হবে। যে চোর সে আমায় তাড়া করেছে। বড় কোন দিদি হবে। সারা মাঠ দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বুড়ির কাছে এসেই দড়াম্‌! মুখের নিচের দিক ফেটে রক্তারক্তি কান্ড।

সবাই ভয় পেয়ে গেল! সবিতাদির সামনে নিয়ে যাবে কি করে! উনি যা রাগী! কিন্তু আমার এই অবস্থা দেখে উনিও ভয়ে চুপ করে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। সবাই আমায় কোলে করে নিয়ে গেল। সারা বিকেল, সন্ধে ঘিরে রয়েছে। রাতে মুখ বেশ ফুলে উঠল।

রাতে খাওয়ার ব্যবস্থাও আলাদা হল। আত্রেয়ীদি তখন ছিল, ওই আমায় খাইয়ে দিচ্ছিল। জনে জনে আমার খবর নিচ্ছে। সব খুব ভাল লাগছিল। ভয় শুধু ছিল, সেই গার্জেন ডেটে পাপা আসবে বহুদিন পর, যদি সবিতাদি বা অন্যদের কিছু বলে! সবিতাদি বারবার বলছিলেন-কখন এমন হয়না, ঠিক আজই হল? উনি কতদিন পর তোমায় দেখবেন! বিকেলে পাপা এলো এত্তো জিনিষ নিয়ে।

পাপা সবার সাথে কথা বলত। খুব আড্ডাবাজ ছিল। পাপা সবিতাদিকে কিছুই বললো না। সব শুনে, আমায় বরং বলল এভাবে পড়ে, উঠে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দিতে হবে। বড়দিদিরাও পাপার সাথে দেখা করল।

পাপা কাউকে কিছু বললনা। আজ খুব ভাল লাগছে এই ভেবে যে, সেদিন কত স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছিলাম, আর আজ তা সবার সাথে প্রথম শেয়ারও করতে পারলাম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।