আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার ছেলেবেলা, আমার মেয়েবেলা আর বয়ঃসন্ধির মন খারাপের দিনগুলো...



কাল বাড়ি যাব। বাড়ি যেতে আমার ভাল লাগে না । তারপরও যাব । ঘরগুলোতে মানুষ আছে কিন্তু শূন্যতা তার থেকেও বেশি !...ঘরময় বাবার স্মৃতি আমাকে এমনভাবে তাড়িত করে...বোঝাতে পারব না ! প্রয়োজন ছাড়া আমি ঘরের মানুষগুলোর (আম্মু ছাড়া ) সাথে কথা বলি না। গত ঈদের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম পাঁচ মাস পর ।

এতগুলো দিন আমি বাড়ি না গিয়ে কি করে থাকলাম এটা ভেবে আমার বন্ধুরা বেশ কিছুদিন আমাকে নিষ্ঠুর-হৃদয়হীন-বর্বর কত কিছুই না বলেছে...কিন্তু ওরা কি করে বুঝবে আমার কষ্ট !...আর আম্মুতো আমার সাথে দেখা করতে আসেই তাই আম্মুর জন্য মন খারাপ হয় না । আগে ভাবতাম আমি যেদিন একা একা ঢাকা যাব সেদিন আমি বড় হবো । কিন্তু আম্মু কিছুতেই আমাকে একা ঢাকা আসতে দেন না । তবে ঢাকা থেকে যাওয়ার দিন একাই যাই । আম্মু যে কেন বোঝে না আমি বড় হয়ে গিয়েছি... মা'য়েদের চিন্তা যেন একটু বেশি-ই ।

অথচ এই আম্মু কে একসময় আমি খুব অপছন্দ করতাম । সংসারে কাজের চাপে আর আমার ছোট বোন জন্মানোর কারণে (আমার বড় দুই ভাই আছে ) খুব অবহেলা করতেন আমাকে । আমি বড় হয়েছি আব্বুর কাছে । আমার ছেলেবেলা-মেয়েবেলা খুব একা একাই কাটিয়েছি আমি । মাঝে মাঝে কবিতা-গান-গল্প লিখতাম ।

ডায়েরি লিখতাম । নিজের ভেতরে নিজেকে খুঁজতাম । খুব একা ! বর্ণহীন...গন্ধহীন... বয়ঃসন্ধিতে কত কিছুইতো পরিবর্তন হয় । আমি আম্মুকে বলতাম না । আব্বুকে বলতে গেলে লজ্জা পাব, বলতাম না ।

অনেক পরে হয়ত আম্মুর চোখে ধরা পড়ত আর তখন তিনি বুঝিয়ে দিতেন শিখিয়ে দিতেন । তাহলে আমার মা কি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন না ? হয়ত ছিলেন হয়ত ছিলেন না... কিন্তু আমার ভেতরে ততাদিনে একটা পশু তৈরি হয়ে গিয়েছিল । আম্মু কে দু'চোখে দেখতে ইচ্ছে করত না । খুব খারাপ আচরণ করতাম ! ২০০১, সদ্য এস এস সি পাশ করেছি । কি একটা কারণে ছোটবোনের সাথে মারামারি হল ।

আম্মু একতরফা ভাবে বিচার করলেন- আমার জুতা দিয়ে আমাকে পেটালেন অথচ ওকে কিছুই বললেন না ! খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন । পুরো ক্রেজি হয়ে গিয়েছিলাম । মরে যাব এরকম চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিলাম । মরে যাওয়ার জন্য তিনটা ডিস্প্রিন খেয়েছিলাম । ভাগ্য ভাল সেদিন কিছুই হয়নি আর কেউ জানতে পারে নি ।

সেই ঘটনার পর আম্মুর সাথে চার মাস কথা বলিনি । মনে মনে খুব কষ্ট পেতাম ! কথা বলতে ইচ্ছে করত...কিন্তু বলতাম না ! আম্মুর সাথে নিজের অজান্তেই অনেক বড় দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল । অবশ্য এজন্য আব্বু আমাকে বকাঝকা করতেন । তিনি ভেবে পেতেন না , কেন আমি আম্মুর সাথে দূর্ব্যবহার করি । আমার আব্বু ছিলেন আমার সবকিছু ।

আমার সব চাওয়া-পাওয়া, ভাল লাগা- মন্দ লাগা...আব্দার সবকিছুই তাঁর কাছে ছিল । ২০০৪ এ আব্বু চলে গেলেন ! মৃত্যুর দিন আব্বু আমাকে বলেছিলেন-'তুমি ডক্টরের কাছে যাও আমাকে বাঁচাও...। ' আমার সাথে এটাই ছিল শেষ কথা ! আমি ডক্টরের কাছে গেলাম... আব্বুর সাথে আমার আর দেখা হয়নি সেদিন । আমারতো কেউ রইল না ! কিন্তু আমার ছিল...আমার আছে, আমার মা ! আমার আম্মু ! যাঁকে কোনদিন পরিপূর্নভাবে ভালোবাসিনি । সেই মা আমাকে বুকে আগলে রেখেছেন আজ অব্দি ! আমার মা'য়ের দীর্ঘায়ু কামনা করি ।

বাবার মৃত্যুর কারণে আমাকে ঢাকায় পড়াতে পারেনি তখন । টাঙ্গাইলে বিবিএ... আম্মু কেঁদে কেঁদে বলতেন-তোমাকে চারুকলায় ভর্তি করাতে পারলাম না !... আমি বলতাম- আমারতো আব্বু-ই চলে গেল...অন্যকিছুর জন্য আমার আর মন খারাপ হয় না ! এই কয়েকটা বছরে আমি আম্মুকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি ! টাঙ্গাইলে থেকেছি বলেই আম্মু কে নিজের মত করে চিনতে পেরেছি । সত্যিকার অর্থে, আমার মা যদি আরো বেশি সচেতন হতেন তাহলে হয়ত এমনটি ঘটত না । আম্মুকে ভুল বুঝতাম না । বয়ঃসন্ধির সময়টা আমার আরো ভাল হতে পারত...


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।