ঃ ভুলু....., ভুলু..
রাতের নিস্তব্ধত কে ভেঙে দিয়ে বেজে উঠলো সোবহান সাহেবের কন্ঠস্বর। এমনিতেই সোবহান সাহেবের কন্ঠস্বর যথেষ্ট চড়া । তার ওপর একটু জোর দিলে তো কথাই নেই। পাশের বাড়ী থেকেই টের পাওয়া যায় যে কিছু ঘটেছে। খাবার টেবিলে বসে সোবহান সাহেব সাধারনত কথা কম বলেন।
নি:শ্বব্দে খেয়ে ওঠেন। অবশ্য খাবারে কোন গন্ডগোল হলে তা আলাদা কথা। সোবহান সাহেবের স্ত্রী মাজেদা খানম এই ব্যাপারে খুবই সতর্ক। সুন্দর ভাবে খাবার বেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। আজও তেমনি খাবার বেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।
সোবহান সাহেব হাত ধুয়ে প্লেটটা সামনে নিয়ে নিজেই ভাত বেড়ে নেন। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে জোরে ডেকে ওঠেন......ভুলু , ভুলু.....।
মাজেদা খানম একটু তটস্থ হয়ে ওঠেন। মৃদুস্বরে বলেন- ভুলু তো আজকে আসে নাই।
ভুলু হচ্ছে সোবহান সাহেবের প্রিয় কুকুরের নাম।
বাচ্চা থেকে ওকে বড় করেছেন পেলে। সোবহান সাহেবে খেতে বসলেই ভুলু এসে তার পায়ের কাছে বসে। ইদানীং সাথে আছে তার তিনটা বাচ্চা। মোট চারজন সোবহান সাহেবের খাবার সাথী হয়। তিনি ওদেরকেও দেন , নিজেও খান।
এটা নিয়মিত একটা ব্যাপার । তাই হঠাৎ করেই ওদেরকে না দেখে উনি একটু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
- আসে নাই-- আসে নাই কেন? একটু জোর দিয়ে কথাগুলো বললেন সোবহান সাহেব। সকালে তো দেখলাম ওদেরকে। সারাদিনে এমন কি হল ....... কোথায় আছে দেখো এখনি.. ।
ভাতের থালাটা ঠেলে দিয়ে আদেশের সুরে বললেন তিনি। তারপর উঠে দাঁড়ালেন ।
-একটু খেয়ে নিলে হয় না? অতি আস্তে কথাগুলো উচ্চারন করেই চোখ নামিয়ে নিলেন মাজেদা খানম।
- না- হয় না । এটাও বোঝো না এখনো।
এতদিন পরে তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে যে আমি ওদের ছাড়া খেতে পারি না। রাগতস্বরে বললেন সোবহান সাহেব। - ঐ হারামজাদা দু’টা কোথায় , সারাদিন টো টো... ডাকো ওদেরকে ।
এত জোরে কথাগুলো বললেন যাদের উদ্দেশ্য করে সেই হারামজাদাদুটো ঠিকই শুনতে পেলো। ওরা পাশের বারান্দারুমে ছিলো।
টেবিলে বই নিয়ে বসে আছে। একজন হলো হামিদ- সোবহান সাহেবের ছেলে, বয়স বছর পনেরো হবে। আগামী বছর মেট্রিক পরীক্ষা দিচ্ছে। আরেকজন হলো মিজান- সোবহান সাহেবের দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই । সোবহান সাহেবের এখানেই থাকে।
এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিচ্ছে। কাছাকাছি বয়সের কারনে দুজনের মধ্যে চাচা ভাতিজার বাইরেও একটা বন্ধুর সম্পর্ক রয়েছে। খেলাধুলা, দুষ্টামী, পালিয়ে সিনেমা দেখা , দুজনে একসাথেই করে। দু’জনেই সন্ধ্যের পরে সোবহান সাহেবের ঘরে ঢোকা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। উনি ঘরে ঢুকলেই ওদের পড়াশোনা শুরু হয়ে যায়।
পড়াশোনা মানে হচ্ছে বই নিয়ে বসে থাকা আর আগামীকালের সারাদিনের দৌড়ঁঝাপের প্ল্যান প্রোগ্রাম করা। অত্র এলাকায় মিজান দুষ্টামীর শিরোমনি হিসাবে বিবেচিত। মফস্বল শহর বলে এখানে সবাই সবাইকে চেনে। মিজানের নামে নানা রটনা শুনতে শুনতে সোবহান সাহেবের কান ঝালাপালা। সাথে তার ছেলে হামিদও একই ট্রেনিং নিচ্ছে।
সোবহান সাহেবের কন্ঠস্বরের দিকেই যেনো কান ছিলো ওদের । সুতারং ওদেরকে আর ডাকতে হলো না। ওরা নিজেরাই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মুখ কাচুমাচু করে। - কিরে ভুলু কই?
- আব্বা , আমি তো বলতে পারি না, দুপুর থেকে দেখি নাই।
- দেখো নাই , দ্যাখো নাই কেন? সারাদিন কি করো? কাজটা কি তোদের.. হ্যাঁ....
ওরা চুপ করে রইল।
- যা, খুঁজে আন.... হঠাৎ ধমক খেয়ে যেনো সম্বিৎ ফিরে পেলো ওরা। পেছনে ফিরে দ্রুত বের হয়ে গেলো ঘর থেকে।
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার । আকাশে মেঘ আছে বোঝাই যাচ্ছে। নিজেও বাইরে এসে কয়েকবার ভুলু ভুলু করে ডাক দিলেন সোবহান সাহেব।
সন্দেহ নেই যে আশে পাশে থাকলে ওরা মুহুর্ত দেরী না করে চলে আসতো তার কাছে। বোঝাই যাচ্ছে আশে পাশে কোথাও নেই । হামিদ আর মিজানও খোঁজ করছে আশে পাশে, বাড়ীর পিছনের বাগানে । আরো দু’একবার ডেকে থেমে গেলেন সোবহান সাহেব। ঘরের ভিতরে চলে এলেন ।
বিছানায় উঠে চুপচাপ বসেছেন। মুখটা গম্ভীর হয়ে গেছে। মাজেদা খানম এই মুখটাকে চেনেন। ঝড়ের পূর্বাভাস। এ অবস্থায় কোন কথা বলা সম্ভব নয়।
কঠোর কোন সিদ্ধান্ত হবে , যা টলানো যাবে না। মাজেদা খানম তটস্থ হয়ে বসে আছেন উনি কি বলেন তা শোনার জন্য। - ওদেরকে ডাক...... গম্ভীর গলায় আস্তে করে বললেন সোবহান সাহেব।
- জ্বী........., ঠিক বুঝতে পারেননি মাজেদা খানম-
- হামিদ আর মিজানকে ডাকো..... একই ভাবে বললেন সোবহান সাহেব।
মাজেদা খানম দ্রুত বাইরে চলে গেলেন।
তারপর ওদের দু’জনকে ডেকে আনলেন ভিতরে।
ওরা একই ভাবে অপরাধীর মত এসে দাঁড়িয়েছে। কোন কথা বলছেনা।
-পেয়েছিস?
-না। বললো মিজান।
-কেন পাসনি? ....... ওরা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। -কেন পাসনি বল, গলার স্বরটিকে একই অবস্থায় ধরে রেখে বললেন, .........কি করেছিস?
-জ্বী..
-কি করেছিস ওদেরকে কোথায় ফেলে এসেছিস , বল.....।
সোবহান সাহেবের গলার স্বর ক্রমশ বাড়ছে। ওরা দু’জন তেমনি অপরাধীর মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কোন কথা বলছে না।
- কথা বলছিস না কেন? এবার রীতিমত হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন সোবহান সাহেব। -বের হ ঘর থেকে, এই মুহুর্তে বের হ শুয়োরগুলো। চিৎকার করে উঠলেন সোবহান সাহেব। ভুলুকে নিয়ে এসে তবে ঘরে ঢুকবি।
- ওরা কোথা দিয়ে আনবে এত রাতে........ মাজেদা বেগম কিছু বলতে চাচ্চিলেন।
কিন্তু থেমে গেলেন স্বামীর রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে।
সোবহান সাহেব খাট থেকে নেমে নীচে দাঁড়িয়েছেন। - কোথা দিয়ে আনবে... আনবে যেখানে ওরা ওদেরকে রেখে এসেছে সেখান থেকে। অমানুষ হয়েছে শুধু, অকাজের জন্য কি তোদের জন্ম ? একটা পশুর সাথে কিভাবে ব্যাবহার করতে হয় তা-ও জানো না। যা , এই মুহুর্তে বেরিয়ে যা..... ভুলুকে না এনে ঘরেও ঢুকবি না, আর এই ঘরে তোদের খাওয়া দাওয়াও বন্ধ ।
দু’জনেই কোন কথা বলল না। আস্তে পিছন ফিরে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো। মাজেদা খানম পিছন পিছন গিয়ে ভীত কন্ঠে বললেন, তোরা যাস কই ? বাইরে এত অন্ধকার।
মিজান একবার পিছন ফিরে বলল - ভুলুরে আনতে যাই।
-ভুলুরে আনবি কই দিয়া , বাইরে তো বৃষ্টি।
ওরা কোন জবাব দিলো না। ভুলুকে আনতে যাবার জন্য দুজনে বের হলো। আসলে কোথা থেকে ওদের আনতে হবে ওরা জানে। কিন্তু ওদের মনে যে প্রশ্ন ঘুরে ফিরছে তা হলো, ওদের কি এখন ওখানে পাওয়া যাবে? আসলে ভুলুর অত্যাচারে ওরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ভুলুর প্রতিটা আচরণই যেনো অত্যাচার ।
সে ঘেউ ঘেউ করলেও জ্বালা , না করলেও জ্বালা। কেন যে ভুলু ওদের কাছে জ্বালা সেটা ওরাও জানে না। এ নিয়ে সোবহান সাহেবের কাছে বহু গাল খেয়েছে। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলো যে ওদের বিদেয় করতে হবে। বুদ্ধিটা মিজানের ।
জটিল বুদ্ধি পাকানোতে সে ওস্তাদ। এর আগেও ভুলুর সাথে ওদের অনেক যুদ্ধ হয়েছে। ধরে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ফেলে এসেছে। কিন্তু প্রতিবারই ভুলু ফিরে এসেছে। সকালে রেখে এসেছে।
বিকেলে ফিরে এসেছে। বিরক্ত হতে হতে শেষে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। হামিদ মৃদু দ্বিমত করেছিল। মিজান বলল- দেখবি এইবার কাজ হবে।
-কিন্তু বাবা......
-ভাইজান টেরই পাবে না।
তুই কিছু চিন্তা করিস না। তুই খালি আমার সাথে থাক।
মিজান আর প্রতিবাদ করলো না। বুদ্ধিটা ওর কাছে ভালোই লাগলো। সকালে কাজটা করে এসেছে।
কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া যে এত ভয়ঙ্কর হবে তা ওরা ভাবেনি। এখন আর কি করবে, আর কিছু করার নেই । যেতেই হবে নদীর ওপারে।
হ্যাঁ, নদীর ওপারেই ফেলে এসেছিল। ফটিকের খেয়ায় পার হয়ে ওপার চলে গেলো।
তারপর বস্তার মুখটি খুলে ওদের ছেড়ে দিল। তারপর আবার খেয়ায় চড়ে এপার। ভুলু দীর্ঘক্ষণ ঘেউ ঘেউ করছিল নদীর তীর পর্যন্ত এসে। কিন্তু ওরা সেই ডাকে কোন কর্ণপাত করেনি। হাসতে হাসতে এপারে চলে এসেছে।
সকালের ব্যাপার, এখন ভুলুকে পাওয়া যাবে কিনা জানে না ওরা। তবু যেতে হবে। ফেরার পথ বন্ধ।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশে গভীর কালো মেঘ।
পথঘাট প্রায় জনশুন্য। মফস্বলে এই সময়ে এমনিই প্রায় সবকিছু বন্ধ হয়ে যায় । তার মাঝে বৃষ্টি । একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে নেই। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে খেয়াঘাট।
দশ পনেরো মিনিট লাগবে। একবার ভেবেছিল বাড়ী গিয়ে ছাতাটা নিয়ে আসবে। কিন্তু সাহসে কুলোলো না। যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজতেই হবে। এখন গিয়ে খেয়া পাওয়া যাবে কিনা তাতেও সংশয়।
যা ভেবেছিল তাই। বৃষ্টি বেড়ে গেলো। ধীরে ধীরে ভিজে যাচ্ছিল ওরা। ভিজতে ভিজতে খেয়াঘাটে এসে আরো হতাশ হলো । কেউ নেই।
খেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আশে পাশে কোন নৌকার দেখা নেই। শুধু অন্ধকারে পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ । ভুতুরে লাগছে ওদের কাছে সবকিছু। - চল চলে যাই।
বলল মিজান।
-না, আমাদের যাইতেই হবে। কোন উপায় নাই। অসহায়ের মত বলল হামিদ। ফটিকের বাসায় চল।
- ফটিক বৃষ্টিতে নামবে না।
-তবু চল। - আমরা যা করছি তার ফল এইটা। হামিদের গলায় অনুশোচনার সুর।
ফটিকের বাড়ী এখান থেকে বেশ কিছু দূরে।
সেখানেই যাবার মনস্থ করলো ওরা । ফটিক শুয়ে ছিল। ওদের ডাকাডাকিতে উঠে আসলো। কেরে , মিজান না.. কি খবর এত রাতে।
-দাদা , একটু ওপারে যাইতে হবে।
-মাথা খারাপ ? এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে। আরে তোমরা তো পুরা ভিজছ, ঘরে আস।
-না দাদা, আমাদের খুব বিপদ। পুরো ঘটনাটি খুলে বলল ওরা ।
-আমি কি করবো।
আজকে আমিও ভিজছি, সন্ধ্যা থেকে জ্বর। তা তোমরা এইরকম কাম করলা কিভাবে ? অবলা পশুর সাথে এইগুলা করতে হয় না। কাইলকে ছাড়া তো কিছু করা যাইবে না।
- তাইলে আমরা যাই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দু:খের সাথে বললো ওরা।
কিন্তু দরজা থেকে নড়লো না। দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। ফটিকও তেমনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কি যেন ভাবলো। তারপর বললো- তোমরা ঐপারে গেলে কি এখন ভুলুরে পাবা?
- পাওয়া যাইবে...দুইজনেই একসাথে বলে উঠলো, সোৎসাহে।
-মনে হয় না, তবুও খাড়াও।
আমার ছোটভাই ছটকুরে চেনো তো? ও আসুক। ও যদি যাইতে চায় তাইলে যাইতে পারো।
ওরা আশা হতাশার মাঝে বসে রইল। ছটকু এলো দীর্ঘ প্রায় এক ঘন্টা পরে। সেও প্রায় ভিজা।
কোনভাবেই সে এই অন্ধকারে নৌকা নিয়ে নদীতে নামতে রাজী হচ্ছিল না। ফটিকের পীড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত রাগ হয়েই বলল- ঠিক আছে আমাদের যদি কিছু হয় তাইলে কিন্তু তুমি দায়ী। আমি গেলাম।
ওদের দুজনের মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলো। তারপরও অন্ধকার, নদীর ভয়, ভুলুকে না পাবার ভয় ইত্যাদী বারবার গ্রাস করছিল।
সৃষ্টিকর্তার নাম নিতে নিতে ওরা নৌকায় উঠলো। নৌকায় ওঠার পরেই বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেলো। তিনজনেই চুপচুপে ভিজে যাচ্ছে। অন্ধকারে তেমন কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না । দূরে ওপারে কোন একটি ঘরের টিমটিমে বাতি দেখা যাচ্ছে শুধু।
বাতাস, বৃষ্টি আর পানির শব্দ । বড় বড় ঢেউ। ভয়ে বুক টিপ টিপ করছে ওদের। যদি নদীতে ডুবে যায়? আর ডুবে গেলে কি হবে। ওদের কাছে নিজেদের এই নদীর মতোই মনে হলো।
মনে হলো ওরা অনন্ত জীবন ধরে এভাবেই অন্ধকারে বয়ে চলছে। আর অনন্ত কাল ধরে এভাবেই বয়ে যাবে। এই পথ হয়তো আর শেষ হবে না। নৌকায় বসেই ওরা সিদ্ধান্ত নিল যদি ভুলুকে পাওয়া যায় তাহলে আর কোনদিনই কোন দুষ্টুমী করবে না। কারো কোন ক্ষতি করবে না।
ছটকুকে স্বাক্ষী রেখে কথাগুলো বলল ওরা। আর যদি পাওয়া না যায়, তাহলে আজ আর এপারে আসবে না। পরে আবার সিদ্ধান্ত পাল্টালো- হামিদের যু্ক্তি হলো বাবা যেহেতু ওদের সাথে এরকম করেছে , আর কোনদিনই এপারে আসবে না । ছটকুকে বললো ওদের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। তারপর যদি ভুলুকে না পায় তাহলে ছটকু চলে গেলেই হবে।
এরপর চুপচাপ বসে রইল নৌকার মাঝে। যেন জীবনের কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারার প্রশান্তিতে চুপ হয়ে গেছে। নৌকা যে ওপারে চলে এসেছে, তা খেয়াল হলো ছটকুর ডাকে। - তাড়াতাড়ি করেন , যান।
লাফিয়ে কাদায় নামলো ওরা।
হাঁটু পর্যন্ত কাদায় মাখামাখি হয়ে গেলো। অন্ধকারে পারের বটগাছটার একটা আবছা অবয়ব ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না । ওরা কাদায় মাখামাখি হয়ে উঠে গেলো রাস্তার উপরে । এদিক সেদিক দৃষ্টি দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু বৃষ্টিতে কিছু দেখার চেষ্টা করা বৃথা।
ওরা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেছে। কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না। ঐ ঐদিকে রাস্তার নীচে ঝোপের কাছে ভুলুকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। সেটা কি ঐ জায়গা? বুঝতে পারছে না । বৃষ্টি আর অন্ধকার ওদের ভেতরেও এসে ভিড় করেছে।
কষ্টে দু:খে দু’জনের চোখ ভিজে এলো। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর কিছু না করতে পেরে কোনক্রমে একটু এগিয়ে বটগাছটার বাড়িয়ে দেয়া একটা শিকড়ের ওপর বসলো। তারপর নি:শব্দে কাঁদতে লাগলো ।
বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ওঠা হঠাৎ ঘেউ ঘেউ শব্দে দু’জনেই লাফিয়ে উঠেছে ।
ভুলুর ডাক না? হ্যাঁ, ভুলুই তো । ওদের পায়ের কাছে। অন্ধকারে যেন মিশে গেছে । বাচ্চাগুলোও ওদের পায়ের চারপাশে ঘুরে ঘুরে কুঁই কুঁই করছে। হঠাৎ হারানো মানিক পাওয়ায় কতক্ষণ হতবাক হয়ে রইলো ওরা।
নিজেদের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ওরা। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ - পাইছি চিৎকার করে দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরলো। অন্ধকারে প্রবল বৃষ্টির শব্দ, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, মানুষের আনন্দচিৎকার সব মিলে মিশে একটা অপার্থিব সুখক্ষণের সৃষ্টি করেছে। আর এতে অংশগ্রহনকারী প্রত্যেকেই যেন এই সময়কালের স্রষ্টা হিসেবে নিজেদেরকে অনন্য করে তুলেছে। সেই সাথে পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহের হাজারো মুহুর্তের মাঝে একটি অনন্য মুহুর্তের সৃষ্টি হয়ে গেলো।
যেটা দু:খ থেকে উৎসারিত কিন্তু পরিপূর্ণ সুখে আবর্তিত। সেই মুহুর্ত থেকে বেরিয়ে ওরা আবারো যখন ফেরৎ আসল সেই হাসি কান্না সুখ দু:খের পৃথিবীতে, তখন ওরা কর্তব্য চিন্তায় অস্থির । যেন আপন স্বরূপে প্রকাশিত হয়েছে ওরা। এত মমতা ভুলুর জন্য কখনোই অনুভব করেনি ওরা । যবস্তাটা যেখানে ফেলেছিল সেখানেই খুঁজে পাওয়া গেলো ।
ভুলু ওর বাচ্চাদের নিয়ে অতি আনন্দের সাথেই বস্তার ভেতরে প্রবেশ করলো। বোঝাই গেলো সারাদিন ওদের নিতে আসার অপেক্ষায় সে বাচ্চাদেরকে নিয়ে নদীর কিনারায় এই খেয়াঘাটেই বসে ছিল।
সোবহান সাহেব এখন তার খাবার গ্রহন করছেন। ভুলু বাচ্চাদের নিয়ে তার পায়ের কাছে। মাজেদা খানমের ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে কিছুটা কৈফিয়তের সুরে মৃদুকে সোবহান সাহেব বললেন,
- কখনো কখনো মানুষ হওয়ার জন্য মানুষকে সুযোগ দিতে হয়।
আমি ওদেরকে কষ্ট দেবার জন্য কিছু করি নাই। ওদেরকে মানুষ হবার শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দিলাম মাত্র। ওরা নিশ্চয় সেই শিক্ষা গ্রহন করবে।
ভুলু আনন্দে ডেকে উঠলো -- ঘেউ , ঘেউ.......।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।