একটা একটা করে নৌকো ভাসায় তারা। কিছুক্ষণ ভাসে, যতক্ষণ ভাসে, ততক্ষণ যেন তারাও ভাসে। আস্তে আস্তে জলের ঢেউ ছলকে নৌকার ভেতরে আসে, তাদের দুজনই ভীষণই আঁতকে ওঠে। এই বুঝি তাদের নৌকাডুবি, হয়ত তাদের স্বপ্নডুবি! স্বপ্নটার ঘোর ভাঙলো সাবিনার জয় দিয়ে।
কদিন ধরেই টুনু ভীষণ ব্যস্ত নির্মাণে।
তিনটি বিয়ারিং-এর চাকা দিয়ে ত্রিভুজাকৃতির এই বাহনটি পরম মমতা নিয়ে তৈ্রী করছে সে। টুনুর এই ব্যাপারটা ভীষণ লক্ষ্যণীয়। উদ্ভূত কিংবা গতানুগতিক যা কিছুই হোক, মজা পেয়ে গেলে সে তার সমস্ত অধ্যাবসায় ঢেলে দেয় সে কাজে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিংবা ফাঁকি দিয়ে তিনদিনে তৈরী করল বাহনটি। এটিই সাবিনার উপহার।
সাবিনা বসে আর টুনু ধাক্কা দেয়। এখন পানি আনতেও সুবিধা হয়। ওতে বসিয়ে দিয়ে এর সাথে আটকিয়ে দড়ি ধরে টানলেই হয়। এটাও একটা খেলা। এভাবেই দিন কাটছিল দুটি ভিন্ন সুরের হেয়ালী জীবনের।
রঞ্জু হাওলাদার হাসপাতালে। কিছুটা দায়িত্ববোধ থেকে হাসপাতালে গিয়েছিল সাবিনা। সে বুঝতে পারছিল বিক্রেতা-খদ্দেরের সীমাটা আস্তে আস্তে অতিক্রম করছে ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। ফেরার পথে গলির মোড়ের মুদীর দোকানে সদাই করতে গেল সাবিনা। চাল, ডাল, ডিম আর পেঁয়াজ এসব কিনবে।
সাবিনা লক্ষ্য করেছে, এই দোকানের ছেলেটা সে গেলেই কেমন ভ্যাঁবলার মতন চেয়ে থাকে। ছেলেটা তোঁতলা। তার চোখ দুটো ভীষণ সুন্দর। তারার মতন জ্বলে। কিন্তু আজ সাবিনার মেজাজ ভীষণ খারাপ।
বাস থেকে নামার সময় শাড়িটা ছিড়ে গেছে। হঠাৎ সে বলে উঠল, 'ওই ছেরা তোর প্যান্টের চেইন খোলা কে?'
ছেলেটার নাম আনিস।
আনিস: চে...এ...এ...এইন নাই।
ছেলেটা এরপর থেকে চেইনের ওপর হাত দিয়ে রেখেছে। সাবিনার ভীষণ হাসি পেল।
ছেলেটাও বোকা বোকা হাসি দিল। (আনিসের তোঁতলামি এই অংশে উহ্য রইল)।
আনিস: আপনে ওই কাম কইরা কি মজা পান?
সাবিনার আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
সাবিনা: আমি কি করমু এইডা কি তোরে জিগামু?
আনিস: আপনে কি রাগ করছেন? ওইদিন রাইতে আপনের অসুখ আছিলো, না? সোবহান মিয়া কইতাছিল। রাইতে আপনে যহন একলা ফিরতাছিলেন, আমি জাইগা আছিলাম।
আপনের মন খারাপ করলে আমারে কইয়েন। আপনেরে বাঁশি বাজাইয়া শুনামু। বাঁশিটা ভাইঙ্গা গেছে। আরেকটা বানাইতে অইবো। হুনবেন বাঁশি?
সাবিনা: ঠিক আছে ঠিক আছে।
আরেকদিন হুনমু।
ছেলেটা একদম অন্যরকম। সাবিনা লক্ষ্য করছিল এত তোঁতলামি সত্ত্বেও ছেলেটার চেহারা থেকে চোখ সরাতে পারছিল না সে। তার সরল কথাগুলোতে যেন তার চোখগুলো আরো বেশি জ্বলজ্বল করছিল।
মন্টু মিয়ার নয়-দশজনের গ্রুপটা এখন শাহবাগের মোড়ে।
আজ ভীষণ খেটেছে সবাই। টুনু এই দলের সদস্য। তিনবার তাদের রিসাইক্লিং ষ্টেশনে বিকিয়ে এসেছে টোকানো প্লাস্টিক, সিলভার, টিন কিংবা বোতল। সবাই ভীষণ ক্লান্ত। হঠাৎ তারা দেখতে পেল একজন সাদা চামড়ার মহিলাকে ধস্তাধস্তি করে একটা সিএন জি চালিত টেক্সীতে তুলে নিচ্ছে।
টুনু ছুটে গেল। ততক্ষণে তারা চলে গেছে। তার চোখে পড়ল একটা গাঢ় নীল রঙের বইয়ের মত জিনিস, পড়ে আছে মাটিতে। কুড়িয়ে নিল সে। প্রথমে ভেবেছিল, ব্যাংকের বই।
সাবিনা বুর একটা আছে। কিন্তু ওটাতে ছবি নেই। এটাতে ছবি আছে। আরেকটা কার্ড, তাতেও ছবি আর একটা কার্ড। ওর গ্রুপের কেউই পড়াশোনা জানেনা।
কেউই বুঝে উঠতে পারল না এর মূল্য কতটুকু। সবাই ফিরে গেল যার যার বাড়িতে। সারাদিনের কর্মক্লান্তি, একঘেঁয়ে দৈনন্দিনতা, আকাশ খেয়ে ফেলার মত অসম্ভব ক্ষুধা গলা টিপে মেরে ফেলল যাবতীয় কৌতুহলকে। ঘরে ফিরে টুনু খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ল।
বেশ কয়েকদিন ধরে দিনে আকাশ মেঘলা থাকে আর রাতে ভীষণ বৃষ্টি পড়ছে।
বৃষ্টি যেন মানুষের কামক্ষুধা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। সাবিনা বিলিয়ে চলেছে তার যৌবন, প্রতি রাতে, প্রতিটি বাসরে। এই রাতগুলো আর যাই হোক, সাবিনার নয়। একেক রাতে একেক জলসা। একেক মানুষের ভিতর একেক ধরনের পশু।
সবগুলো পশু আলাদা আলাদা। আগে বুঝতো না সাবিনা। এখন বোঝে। একেকটি পশুর একেক রকম গন্ধ, একেক রকম বদভ্যাস, একেক রকম শরীরী কামনা। সবকিছুর মাঝেও সে বেঁচে থাকে অবাঞ্ছিত কিন্তু অর্থের যোগান দেয়া জীবনটা নিয়ে।
মাঝে মাঝে রঞ্জুকে দেখতে যায়। এখন সুস্থ হয়ে উঠেছে ও। এর মাঝে একবারও তার বৌ আসেনি তাকে দেখতে। দু একবার আনিসের বাঁশিও শুনেছে। তবুও সে বুঝতে পারে সে ভেঙ্গে পড়ছে।
মানসিক, শারীরিক দুইভাবেই...
আজ ভীষণ বৃষ্টি। বড়লোকের ছেলেদের মতন আজকে টুনুর গ্রুপের পার্টি ডে। দিনভর থাকবে ডোবায় সাঁতরানো। মাঝে কিছুক্ষণ কদমফুল বিক্রি আর ইদানীং তারা একটি মজার খেলা আবিষ্কার করেছে। ঢালু রাস্তায় ভীষণ স্রোতে আসা পানিতে বুক পেতে দেয়া।
হয়ত সমুদ্রের ঢেউয়ের আনন্দ পায় তারা। আনন্দের কোলাহল শেষ করে তারা অপেক্ষা করছিল একটি টেলিভিশনের দোকানের সামনে। কোনো সিনেমার গান শুনবে বলে। হঠাৎ টুনু লক্ষ্য করল টেলিভিশনে একজন সাদা চামড়ার মহিলার ছবি দেখাচ্ছে। ও বুঝতে পারল এটি সেই মহিলা।
ততক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে কুড়িয়ে পাওয়া বইটি হয়ত গুরুত্বপুর্ণ কিছু। সে তাড়াতাড়ি ফিরে গেল বাড়িতে।
বাড়ি ফিরে সাবিনাকে পুরো ব্যাপারটা জানাল সে। সাবিনা পড়ে দেখল বইটির ওপর যা লেখা আছে, তা সেও বুঝছে না। একটা কার্ডে একটা ফোন নাম্বার আছে।
এ ধরনের কার্ড সে দেখেছে। বাকি দুটো জিনিস অপরিচিত। তারা গেল সোবহান মিয়ার কাছে।
সোবহান বুঝতে পারল এটা একটা পাসপোর্ট। বেশ কিছুক্ষণ পরীক্ষণ করে বুঝতে পারল এটি সুইডেনের কোন নাগরিকের।
তখন টুনু বলে উঠল, হ ওই মহিলার নাম কি জানি লুন্ডবার্গ না কি জানি! একটা অফিসে কাম করে, টিভিত হুনছি। বাকিটাও বলল...
সোবহান: আমাগো এহন এই কার্ডের নাম্বারে ফোন করা লাগবো।
টুনু: আগে পুলিশের কাছে যাওন উচিত।
সোবহান: ওই ট্যাবলেট তুই চুপ থাক।
তারা সবাই গেল একটা ফোন বুথে।
তারা অনেকক্ষণ বসে আছে। একটা লোক তখন থেকেই কথা বলে যাচ্ছে। অল্পবয়সী ছেলে। সাবিনাকে দেখে আরো দ্বিগুণ উৎসাহে কথা বলে যাচ্ছে। তার বক্তব্যের সার সংক্ষেপ হল, 'তার কামাই এখন মাশাল্লাহ ভাল।
তার মোবাইলের চার্জ শেষ। তাই দোকানের মোবাইল থেকে কথা বলছে। বাড়ির হাঁস-মুরগিগুলো ভালো আছে কিনা! তার আব্বার সাথে আলাপ হলেই যেন তার বিয়ের কথাটা মনে করে পাড়ে... এইসব। ' কলটা কেটে দোকানদারকে দিতেই দোকানদার বলে উঠল, ' কি মিয়া এতক্ষণ কথা কইলেন আর মাত্র পাঁচ মিনিট, ফাইজলামি করেন?'
ছেলেটা চোখ টিপল সাবিনাকে ইশারা করে। দোকানদার আরও খেপে গেল।
ছেলেটি কোনমতে বিল দিয়ে পালাল। ছেলেটি খেয়াল করেনি যে দোকানদার নিজেও একই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সাবিনা আর টুনু ভীষণ মজা পাচ্ছিল। সোবহান মিয়া মোবাইল নিয়ে ফোন দিল। হ্যাঁ রিং হচ্ছে...
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।