সুবহানাহু তায়া’লা ওয়ারাআল ওয়ারাই ছুম্মা ওয়ারাআল ওয়ারাই-জ্ঞান ও অনুভূতি যে পর্যন্ত পৌছে, আল্লাহতায়ালার জাতে পাক তার পরে, বরং তারও আরো পরে।
............বাদশাহ্ আকবর বিপদসংকুল পথে পা বাড়াইলেন। আবুল ফজলের দল
তাহাকে বুঝাইয়া দিলেন যে, ইসলাম ধর্ম পুরাপুরি বিবেকবর্জিত এক মতবাদ।
কিছু গরীব বেদুঈন এই ধর্ম প্রবর্তন করেন। তাঁহারা সকলেই ছিলেন ডাকাত ও
ফেতনা সৃষ্টিকারী (নাউজুবিলাহ্)।
বাদশাহর দরবারে নবুয়ত, দীদারে এলাহী,
শরীয়তের আনুগত্য, হাশর নশর প্রভৃতি বিষয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা শুরু হইল। অহি,
মোজেজা, ফেরেশতা প্রভৃতির অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করাই বাদশাহ্ ও
তাঁহার দরবারীদের প্রধান কার্য হইয়া দাঁড়াইল।
বাদশাহ্ আকবর ভাবিতে শুরু করিলেন, ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের পর এক
হাজার বৎসর গত হইয়াছে। ইসলামের আয়ু ছিল এক হাজার বৎসর। বর্তমানে
তাই নতুন কোন ধর্ম প্রবর্তনের প্রয়োজন।
কিন্তু এই নতুন ধর্মের রূপরেখা কিরূপ
হইবে তাহাই তিনি চিন্তা করিতে লাগিলেন।
তিনি দেখিলেন তাঁহার রাজত্বের শতকরা প্রায় পঁচানব্বই জন প্রজাই হিন্দু।
শিয়ারাও তাঁহার পিতার আমল হইতে মোঘল সাম্রাজ্যের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার
করিয়া আছে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে জৈন সম্প্রদায় অন্যতম। ইহা ছাড়া
পারসী বা অগ্নি উপসাকদের কথাও ভাবনা করা উচিৎ।
খৃষ্টানরাও সেই সময়
আনাগোনা শুরু করিয়াছিল।
বাদশাহ্ সিদ্ধান্তে আসিলেন,সব জাতির বাদশাহ্ হিসাবে তাঁহার সব ধর্মেরই
পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিৎ এবং সকল ধর্মের ভাল মতবাদ সমূহ লইয়া নতুন ধর্ম
গঠন করিতে হইবে। ইহাতে সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁহার প্রতি খুশী হইবে।
তাহা ছাড়া এই বিশাল সাম্রাজ্য সুষ্ঠুভাবে শাসন করিবার জন্য এই নতুন ধর্মই
হইবে সর্বাপেক্ষা বড় অস্ত্র।
বাদশাহ্ আলাহ্
পাকের উপর তাওয়াক্কোল ছাড়িয়া দিলেন।
নিজের
বুদ্ধিবিবেচনা অনুযায়ী রাজত্ব রক্ষার অস্ত্র হিসাবে শুরু হইল নতুন ধর্ম রচনার
প্রস্তুতিপর্ব।
নতুন ধর্মে সর্বাপেক্ষা বেশী প্রভাব ছিল হিন্দুদের। ইহা ছাড়াও দেশের প্রত্যেক
ধর্মের বুদ্ধিমান ধর্মনেতাগণ শাহী দরবারে আসিয়া বাদশাহর সহিত তাহাদের ধর্ম
বিষয়ে আলোচনা করিতেন। বাদশাহ্ তাহাদের অত্যন্ত সমাদর করিতেন এবং
আলোচনার বিষয় লইয়া সব সময় গবেষণায় লিপ্ত থাকিতেন।
বহু গবেষণার পর তিনি নতুন এক ধর্ম প্রবর্তন করিলেন।
নাম দিলেন ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’।
আশ্চর্যের বিষয়, দ্বীন-ই-ইলাহী ছিল স্পষ্টতই কুফরী। অথচ তাহার নাম
রাখা হইয়াছিল দ্বীন-ই-ইলাহী অর্থাৎ আলাহর ধর্ম।
এই নতুন ধর্মের প্রধান উপাদান ছিল সূর্যের উপাসনা করা। বাদশাহ্ প্রভাতে,
দ্বিপ্রহরে, সন্ধ্যায় ও অর্ধরাত্রে বাধ্যতামূলকভাবে সূর্য পূজা করিতেন।
তিনি তিলক
লাগাইতেন এবং পৈতা পরিতেন। সূর্যোদয়ের সময় ও মধ্যরাত্রিতে নহবত ও
নাকাড়া বাজান হইত।
এই নতুন ধর্মে সূর্যের নাম উচ্চারণকালে ‘জালাত
কুদরাতুহু’ বলিতে হইত। বাদশাহ্ বিশ্বাস করিতেন যে, সূর্য বাদশাহ্গণের
অভিভাবক ও হিতাকাঙ্খী। তিনি তাই হিন্দুদের নিকট হইতে সূর্যকে বশীভূত
করিবার মন্ত্র শিখিয়া লইয়াছিলেন।
মধ্যরাত্রে ও ভোরে তিনি এই মন্ত্র পাঠ
করিতেন। শিবরাত্রিতে তিনি সমস্ত রাত্রি যোগীদের আসরে বসিয়া থাকিতেন এবং
বিশ্বাস করিতেন যে, ইহাতে আয়ু বৃদ্ধি পায়।
ব্রাহ্মদাণ নামীয় এক ব্রাহ্মণকে বাদশাহ্ ‘রাজকবি’ উপাধিতে ভূষিত
করিয়াছিলেন। ইতিহাসে এই ব্যক্তিই বীরবল নামে পরিচিত। তিনি বাদশাহর খুবই
প্রিয় ছিলেন।
তাহারই সুপারিশে ‘দেবী’ নামক একজন হিন্দু দার্শনিক বাদশাহর
সহিত মেলামেশা করার সুযোগ পায়। রাত্রিকালে বাদশাহর অন্দরমহলেও এই
দার্শনিকের অবাধ যাতায়াত ছিল। বাদশাহ্ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য
সর্বদা উদগ্রীব থাকিতেন। এই দেবী ও গৌতম নামে আর একজন ব্রাহ্মণের নিকট
হইতে বাদশাহ্ মূর্তি, সূর্য ও আগুন পূজার নিয়মাবলী এবং ব্রহ্মা, মহামায়া, বিষ্ণু,
কৃষ্ণ ও মহাদেব পূজার কায়দা কানুন শুনিয়া বড়ই উৎফুল্ল হইতেন এবং এইসব
গ্রহণও করিতেন।
ইহা ছাড়া এই ধর্মে আগুন, পানি, গাছ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী এবং
গাভী পূজা করা হইত।
নক্ষত্র পূজার ব্যাপারেও বাদশাহ্ অত্যধিক বাড়াবাড়ি
করিতেন।
হিন্দুদের পুনর্জন্মবাদের উপর বিশ্বাস করা ছিল এই ধর্মের প্রধান কর্তব্য।
বাদশাহ্ নিজেও বিশ্বাস করিতেন যে, মৃত্যুর পর তিনিও পুনরায় অন্য কোন
সিংহাসনে শান শওকতের সহিত আরোহণ করিবেন। ব্রাহ্মণগণ তাহাকে বুঝাইয়া
দিয়াছিল যে, শক্তিশালী বাদশাহর শরীরে আত্মার জন্ম হয় এবং কামেল
মনীষীগণের আত্মা মৃত্যুর সময় মস্তকের তালু দিয়া বাহির হইয়া যায়। এই
ধারণার বশবর্তী হইয়া তিনি মস্তকের তালুর চুল কামাইয়া ফেলিতেন এবং মস্তকের
চারিদিকে চুল রাখিয়া দিতেন।
(যারা ইতিহাস পড়তে ভালবাসেন তাদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ রচিত খ,ম, আমানুল্লাহ কর্তৃক প্রকাশিত হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি রহঃ -এর অবিস্মরণীয় জীবন কথা ‘নূরে সেরহিন্দ’ গ্রন্থ হতে চয়িত অংশ বিশেষঃ)
সেরহিন্দ প্রকাশন , ৩৮/২-ক, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।