স্বপ্ন জগতের গোলাপী আকাশে ডানা মেলা মুক্ত বিহঙ্গ ! না ভয় আর না পিছুটান ....
-এই নেয়ামুল এই ,ঘুমাস কেন ?
ওঠ ওঠ ! আরে এই গাধা শুনছিস ? ওঠ না !
-ঊমম! কী ? চেঁচাস কেন ?
-চেচাই না তোকে উঠতে বলছি । ঘুমাচ্ছিস কেন ?
-আমার ইচ্ছা । স্যার এসেছে ?
- না , এই পিরিয়ড টা হবে না মনে হয় ।
-তো ?
- তো ! এজন্য তুই ঘুমাবি নাক ডেকে ডেকে ক্লাসের মধ্যে ??
-হুম! তোর অসুবিধা ?
-হুম! সারারাত করিসটা কি, হ্যাঁ ?
ডেইলি আধঘন্টা লেটে আসিস ক্লাসে । মুখটা গাবের মত কয়রে রাখিস ।
চোখ দেখলে মনে হয় ভুতে পেয়েছে । ডেইলি এই লাস্ট বেঞ্চটায় বসে ঘুম দিস ।
-তো ?
-তো মানে ? তুই যে আমাদের ফ্রেন্ড , এটা কেউ বিশ্বাস করবে ? বলবে এই ভূতটা জোটালে কোত্থেকে ?
-তো এখন কি করতে হবে , মানুষকে বিশ্বাস করাতে ?
- নাহ! তোর ভূত তাড়াতে হবে । সারারাত কি করিস ??
- গল্পের বইয়ের পাতায় পাতায় ডিম পাড়ি । আর, প্রতি রাতে একটা গ্লাসে পানি নিই ।
ওতে একটা মুভির সবগুলো ক্যারেক্টার আর থিমটা ঢালি , তাতে চিনি মেশাই । আর তারপর ?
তারপর সারারাত ধরে আকাশ দেখতে দেখতে একটু একটু করে চুমুক দিই ।
-আবার সাহিত্য ! আশ্চর্য মানুষ তো তুই ! একশোবার না বলেছি , আমার সাথে সাহিত্য করবি না !
-আচ্ছা বাবা থাম দেখি এইবার ! তোর মতলবটা কি ?
-মতলব মানে ? কোন ধান্দাবাজি মতলব নাই । তুই পরের ক্লাসটা করবি ?
-হুম না করে উপায় আছে ! কেন ?
-গুড ! দোস্ত তাইলে আমার প্রক্সিটা দিবি প্লীজ ! দিবি বল ?
-আচ্ছা দেখি ।
- দেখি মানে ? শালা মাইর খাবি ।
ওইদিন তোর তিনটা দিলাম , আর আমার একটা নিয়া গড়িমসি !
-আচ্ছা দেব । আর কিছু ?
- না । ঘুমাসনে । মনে রাখিস মিস গেলে কপালে তোর খারাপি আছে !
-আচ্ছা বাবা মিস হবে না, যাতো !
::::::::::::::::::: ...zzzZZ.... :::::::::::::::::::
-এই নেয়ামুইল্যা, এই শালা ওঠ ।
-আহ! আবার কি ?
ওহ! তুই ? কি হইল ?
-ওঠ শালা ! আর কত ঘুমাবি ? চল চা খেয়ে আসি , রমিজ মামার দোকান থেকে ।
-উমম! একটু শান্তিতে চোখটাও বুজতে দিবিনা হারামজাদা ! চল ... বিল তুই দিবি ।
-এহ! মজা লও ? আচ্ছা, চায়েরটা আমার বিড়ির টা তুই দিবি ।
-উক্কে !
:::::::::::::::::: রমিজ মামার দোকান ::::::::::::::::::
তিন চেংড়া বয়সের ছেলে ঝুপড়ি মতন ছ্যাপড়া চাল আর ফুটো বেড়ার রমিজ মামার ছোট্ট হোটেলটায় বসে বসে আজগুবী যতসব উদ্ভট পেঁচাল পাড়ছে আর একটু পরপর অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ছে । ফাকে ফাকে চায়ের কাপেও চুমুক চলছে । মাঝে মাঝে পাশের টেবিল থেকে বয়স্ক গম্ভির চেহারার দু একজন চোখ কুঁচকে তাকাচ্ছে , বিরক্ত ভংগিতে ।
ভাবটা যেন এমন -
"কোত্থেকে যে আসে এসব ইচড়েপাকা ছোকরাগুলো !
কাজ কাম নাই , খালি বাপের টাকা নষ্ট করা ! - এদের কারনে দেশটার অর্জন বলতে আজো তেমন কিছু নেই ! এরা আসে শুধু বাপ মায়ের জন্য অভিশাপ হয়ে । "
কিন্তু, কে কি বলছে আদৌ সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তিন ছোকড়ার । মনের আনন্দের জোয়ারে যেন একজন উড়ে , একজন ভেসে আর একজন থেমে থেমে লাফিয়ে চলেছে ।
যে ছেলেটা থেমে থেমে একটু একটু লাফ দিচ্ছে , তার চোখ দুটোয় ঘুম লেগে আছে । যেন এখনো ঘুমের জগত থেকে পূর্ণ মুক্তি মেলেনি ।
ওই জগতটার সাথে সম্পর্ক রেখে রেখেই তাল মিলিয়ে চলেছে এজগতটার সাথে । সপ্নীল চোখদুটোয় যেন সাগরের গভীরতা । চোখদুটো যেন প্রকাশ করতে চাচ্ছে, মনের রঙিন আর কাব্যিক স্বপ্নীল জানালাটার ছবি ।
থেকে থেকে সে আশে পাশে চোখ বুলাচ্ছা আমুদে ভঙ্গিতে, যেন কৌ্তুকবোধ করছে কোন কিছু নিয়ে ।
প্রায় আধাগন্টা আড্ডা দিল ওরা ।
তারপর একজন বলে উঠল ,
-ক্লাস টাইম শেষ । কবির স্যারের ক্লাস আর ৫ মিনিট আছে । যাবি না ? জাভেদ , নেয়ামুল ?
- আমি যাবো না আর আজকে ক্লাসে । তুই আর জাভেদ যা ।
-কেন ? তুই যাবি না কেন ?ক্লাসের বাইরে আসলেই তোমারে শয়তানে ধরে না ?
-না ।
আসলে কি, একটু ঘুমানো দরকার । জরূরী এই মুহূর্তে ।
-চল ক্লাসে ঘুমাইস । ভুং ভাং বাদ দে , চল ।
- নারে সত্যি ।
গত তিন রাত এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি ।
তোরা যা । আর হ্যাঁ , দোস্ত ভালো কথা , মনিরের প্রক্সিটা দিস প্লীজ । আমার দেয়ার কথা ছিল । প্লীজ দোস্ত না দিলে পোলাটা সিরিয়াস মাইন্ড খাবে ।
-আচ্ছা দেবনে । তুই তাইলে , রুমে যাবি এখন না । ঠিকাছে যা , চাবিটা পাইছিলি কালকে আর ?
-ওহ্ হো রে! ভালো কথা চাবি তো আর পাইনি । এখন তো রুমেই ঢুকতে পারতাম না রে । দে জাভেদ চাবি দে ।
দুজন ক্লাসের দিকে হাটা ধরল । পেছনে বসে থেকে ওদের যাওয়া পথের দিকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে চেয়ে রইল নেয়ামুল । ক্লাসগুলো বাদ দেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে এভাবে ?
নাহ! আফসোস সে করবে না । ভুল কিছু তো করছে না । রেজাল্ট এক গ্রেড নামলেই যে সে মানুষ খারাপ হয়ে যাবে তা তো না ।
তার ওই আঁতেলদের মত সব এইটি আপ না হলেও চলবে । কে কি বলল সে ভাবে না । ভেবে কি হবে ? যাদের জন্য ভাববে তারা ওর জন্যই বা কতটুকু ভাবে ?! সে কারো ধার ধারে না । আপন নির্মল খোলা আকাশে সে এক মুক্ত বিহঙ্গ ! - না আছে তার ভয় , আর না কোন পিছুটান !!
যেহেতু , মনে করে না বিবেক ছাড়া সে আর কারো কাছে দায়বদ্ধ /
এক ভাবুক, এক উদাস , এক গন্তব্য ভুলে যাওয়া, পরোয়াহীন এক মুক্ত স্বাধীন সত্তা - এভাবেই নিজেকে বিচার করতে ভালো লাগে তার !
ফোঁপানোর আওয়াজে সৎবিৎ ফিরে কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে নেয়ামুল । কেউ একজন ফোঁপাচ্ছে ! চেপে চেপে ফুঁপিয়ে চলেছে কেউ একজন ! - এবং সম্ভবত তার আশেপাশেই !
কৌতুহলী চোখে চারদিকে তাকালো ।
তেমন কাউকে মনে হচ্ছে না । তবে একদম কোনার টেবিলে পিঠ বাঁকা করে বসে থাকা এক বৃদ্ধের উপর চোখ আটকে গেল ।
লোকটা তারদিকে পিছ দিয়ে আছে । বসেছে একেবারে যুবুথুবু হয়ে , একেবারে শেষ কোনার টেবিলেরও কোনাটায় । থেমে থেমে ফুঁপিয়ে উঠছে মনে হচ্ছে ।
আশ্চর্য, প্রায় আধা ঘন্টা যাবত এখানে বসে আছে , অথচ একবারোও খেয়াল করেনি ব্যপারটা !
উঠল নেয়ামুল । ধীর পায়ে এগিয়ে গেল কোনার টেবিলটার দিকে ।
লোকটার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ল ।
-চাচা ?
উত্তর নেই । তবে কান্না থেমে গেছে মনে হল ।
-চাচা , কি হয়েছে চাচা ? কাঁদছেন কয়েন এভাবে ?
-না, কিছুনা , বাপ ।
-বলেন চাচা । কোন অসুবিধা নেই । আমি তো আপনার ছেলেরই মত । আমাকে নির্ভয়ে খুলে বলেন ।
কি হয়েছে /
-নারে বাপ । কিছুনা , তোমারে বইলা আর কি হইব ! সব আমার কপাল ।
-চাচা কপালের দোষ দিয়া কি লাভ আছে ? বলেন । তারচেয়ে খুইলা বলেন আমাকে , কিছু করতে না পারি , অন্তত আপনার মনের দুঃখের বোঝাটাতো কমবে , নাকি ?
-কি কমু কও , বাপ । পাপ করসিলাম জীবনে , এল্লেগ্যাই এইরহম একটা পোলা হইসে আমার ।
-কি করসে আপনার ছেলে ? নাম কি ওর ?
-ওর নাম জিগাইয়্যো না । ওর নাম মুখে আনতেও আমার ঘিন্যা লাগে । কেমনে যে ওরে জন্ম দিসিলাম !
-ধুর কি যে বলেন ! আচ্ছা নাম বলা লাগবে না । বলেন সে কি করেছে, যার জন্য কাঁদতে হচ্ছে আপনাকে এভাবে ?
-বাপ , আমি গরিব মানুষ । লেখাপড়াও জানি না ।
জমিজমাও নাই কোন । ঘরে তিনটা পোলাপান । ছোট পোলা আর মাইঝা মাইয়্যাটা পড়াশুনা করে । বৌটা আমার অসুস্থ বহুত দিন ধইরা । আগে মাইনষের বাসায় বাসায় কাম করত ।
এহন তাও পারে না ।
-আর আপনার বড় ছেলে ? সে কি করে ?
-ওর কথা আর কইয়্যো না । পোলাডা আমার সোনার ছেলে আছিল ছুডো বেলায় । কত আশা আর স্ব্পন নিয়া ওরে ইস্কুলে দিসিলাম । ইচ্ছা আছিল পড়াশুনা কইরা একদিন অনেক বড় হইব ।
বড় ডাক্তার হইব ।
কিন্তু খারাপ পোলাপানের সাথে মিশশা দুই দিনে নষ্ট হইয়া গেল ! এহন গাঞ্জা খায়, মদ খায় আরো কত কি খায় আল্লাহই জানে । যেইখানে ইচ্ছা যায় । কেউ তারে কিছু কওয়ার নাই ।
যে কয়বারই তারে বুঝাইবার গেসি , ঘরের মধ্যে ঝগড়া লাগাইয়া সব উল্টায় পালটায় বাইর হইয়া গেসে ।
তারপর ফেরত আসছে যখন টাকার দরকার হইসে ওর শুধু তখন !
ও একটা অমানুষ ! কক্ষনো ভাবে না কিভাবে সংসারটা চলে । কিভাবে, ছোট ভাইবোন দুইটা পড়াশুনা করতাসে , কিচ্ছু ভাবে না । সে শুধু আছে তার নিজের ফুর্তি আর নেশা নিয়া ।
-এখন সে কই ?
- জানিনা । পড়শু রাইতে বাড়ি ফিরছিল ।
আইসাই ট্যাকা চাওয়া শুরু করে । ওরে ঠান্ডা করার লাইগ্যা কইসিলাম , বাপ তুই থাম, কাইলকার মইধ্যে যেইহান থিকা পারি তোর লাইগ্যা ট্যাকা যোগাড় করুম ।
প্রথমে থামলেও মনে হয় বুঝসিল যে ওরে ঠান্ডা করার লাইগ্যা মিছা কথা কইতাসি ।
-পরে ?
-আমি দূর্বল মানুষ । সব সময় রিশকা চালাইতেও পারি নাহ ।
তার উপর রিশকাডাও লইসিলাম একজনের মাধ্যমে অনেক হাতে পায়ে ধইরা ।
কাইলকা হাইঞ্জা বেলা বেজায় গরমে ক্লান্ত হইয়া পড়সিলাম । একটু জিরাইতে বাড়িত গেসিলাম ।
ফিরা আইয়্যা দেখি, রিশকাডা গ্যারেজের দখলে !
-আশ্চর্য ! কেন ?
-আমি যখন ছিলাম না , ওই সময় আমার পুতে রিশকাডা পাশের গ্যারেজে বেইচা টাকা নিয়া ভাগসে ! গাঞ্জা খাইব !
কথা গুলো বলতে বলতে লোকটা ডুকরে কেঁদে ওঠে । সে কান্না উঠে আসছে বুকের গভীর থেকে ।
কান্নার দমকে কেঁপে উঠতে উঠতে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বাবুল মিয়া কোনরকমে বলে,
-এহন এই রিশকা আমি মালিকরে কই থিকা কেমনে যোগাড় কইরা দিমু ! ? !
নেয়ামুল বলার মত কথা খুজে পায় না , খুজে পায় না সান্তনার ভাষা । কিছু কিছু ক্ষেত্রে সান্তনা দেয়াটা অর্থহীন ।
ও ভেবে পাচ্ছেনা ঠিক কি করা উচিত তার এই অসহায় মানুষটার জন্য । তবে এটা বুঝতে পারছে যে, তার কিছু করা উচিত এবং এখনি ।
কিন্তু কি করতে পারে সে ?
গত মাসের হলচার্জ সহ সব বিল দেয়া শেষ ।
এ মুহূর্তে ওর কাছে মাত্র ৫৩০ টাকা আছে । সারা মাসের জন্য হাতখরচ হিসেবে ।
টাকাটা দিয়ে দিলে মাস কিভাবে চলবে , সে ভেবে পাচ্ছে না । কিন্তু এটাও ভেবে পাচ্ছে না যে , ওই বয়স্ক লোকটা এমুহূর্তে কিভাবে কি ম্যানেজ করবে / ? /
যেখানে তার নিজের খরচ ছাড়াও সংসারের হাজারটা খরচ আছে !
লোকটার দিকে আবারো তাকালো নেয়ামুল । জীর্ণ , ময়লা আর শত তালি মারা ছেড়া একটা শার্ট গায়ে ।
যতটা না বয়স তারও চেয়ে বেশি দেখাচ্ছে, দুশ্চিন্তার ভারে । শীর্ণ হাড্ডিসার দেহ – যেন বহু অনাহার , বঞ্চনা, অভাব আর ক্ষুধার সাক্ষ্য বহন করছে নিরবে ।
হঠাৎ কেন যেন নিজেকে দায়ী মনে হল তার । মনে হল, সে কিছু করতে পারে তার সামনে বসা ওই অসহায় লোকটির জন্য ।
পকেটে হাত দিল নেয়ামুল ।
যতটাকা ছিল , সবটা বের করে জোর করে বাবুল মিয়ার হাতে গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞাস করল, চাচা কিছু খেয়েছেন সকালে ?
উত্তরের অপেক্ষা করল না সে । অর্ডার দিল পরোটা আর ডিমের । সেগুলো এলে বাবুল মিয়ার সামনে দিয়ে বলল , নেন চাচা শুরু করেন । কোন না করা চলবে না । মনে করেন আপনার ছেলের তরফ থেকে , আর খাওয়া শেষ হলে আমরা প্রিন্সিপালের অফিসে যাবো ।
আমাকে কয়েকটা ঘন্টা সময়য় দিন, ইনশা আল্লাহ আজকে বিকালের মধ্যেই আপনার রিকসার জন্য একটা ব্যাবস্থা হয়ে যাবে । বাবুল মিয়া বিশ্বাস করতে পারছে না ছেলেটার কথাগুলো । ফ্যালফ্যাল কয়রে চেয়ে রইল ।
:::::::::::::::::::::::::: বিকেল ৫ টা ৩০ মিনিট ::::::::::::::::::::::::::
-এই আশরাফ নেয়ামুল কই ?
-কি জানি, আমি রুমে আসার পর থেকে ওকে দেখিনি ।
-তাইলে, তখন যে রমিজ মামার হোটেলে চাবি নিল আমার কাছ থেকে / ! /
-হুম সেটাই ভাবছি ।
সে ঘুমাবে বলে ক্লাস বাদ দিল । আর আমি রুমে আসার পর দেখি রুম তালা মারা । আদৌ কি সে রুমে এসেছিল ??
-উঁহু! মনে হয় না । আচ্ছা ফোন দে তো শালাকে । দেখি ওর উদ্দেশ্যটা কি ।
-আরে ফোন কি দেই নি ? এর মধ্য ৫ বার রিং দিলাম । একবারো ধরেনি , আর ধরবে কি অল্টাইম বিজি দেখাচ্ছে ।
-বলিস কি ! ও তো ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করার মানুষ না ! কাহিনীটা কি ?
-আসলে কি জানিস ?
ওর আচরন ইদানিং আমার অদ্ভুত লাগছে !
-কিরকম ?
-কালকে রাতে তোর ঘুম ভেঙেছিল ?
-নাতো । কেন ? রাতে অদ্ভুত কিছু ঘটিয়েছিল ?
-আরে কিছু ঘটিয়েছে তো বটেই ! তবে তা এখানে না ।
-মানে ?
-আরে কালকে রাতে সে রুমেই ছিল না ! আমি বাথরুমে যাওয়ার জন্য উঠি ।
দেখি, ওর ল্যাপটপ টা খোলা , ইংরেজি উপন্যাসের বইটা খোলা , চশমাটা পড়ে আছে একপাশে । কিন্তু, সে নেই ! যেন এই মাত্রই খুব তাড়াহুড়া করে জরুরি কোন কাজে বেরিয়ে গেছে ! এমনকি রাতে ফেরেও নি আর !
-বলিস কি ? মধ্যরাতে তার কিসের কাজ আশ্চর্য ! রাতবিরাতে এভাবে নিরুদ্দেশ হওয়াতো ভালো লক্ষন মনে হচ্ছে না ।
-আচ্ছা, আজকে শালাকে ভালোভাবে ধরতে হবে । এখন চল , ভুলে গেছিস এখন জরুরী রক্ত দিতে যাবার কথা ছিল পোনে ছয়টা বাজতে আর পনেরো মিনিট আছে । জলদি কর ।
-মনে আমার ঠিকই আছে । কিন্তু নেয়ামুলটাকে নিতে চাচ্ছিলাম । ওর আবার এসবে আগ্রহ ছিল তো ।
-যাক চল সময়য় কম !
:::::::::::::::::::::::::::::: ১৫ মিনিট পর ::::::::::::::::::::::::::::::
-আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ যে , মনে কয়রে এসেছেন ।
কজন এখন এভাবে মানুষের সেবায় এগিয়ে আসে বলুন ?
- কি যে বলেন ।
এটাতো দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে তাইনা ? আর দায়িত্বে অবহেলাটা আমরা ঠিক পছন্দ করি না ।
সে ধরনের শিক্ষাই ছোটবেলা থেকে পেয়ে এসেছি । কি বলিস আশরাফ ?
- বাদ দে তো ! আচ্ছা আমরা তাহলে শুরু করতে পারি কি বলেন । গ্রুপ একি । তারপরেও প্রথমে চেক কয়রে নেয়াটাই বোধহয় ভালো , কি বলেন ?
- আপনারা রক্ত দিতে চাচ্ছেন এখন ?
-হ্যাঁ ।
সেরকমই তো কথা ছিল তাইনা ?
- আসলে হয়েছে কি , কালকে রাতে আমরা কয়েকটা সোর্সে খোজ নিয়ে না পেয়ে , যখন প্রায় হতাশ । তখন আমাদের ইশতিয়াক ভাই একটা নাম্বার যোগাড় করে দিলেন , যেটা বি-নেগেটিভ ছিল ।
-তো ওটায় ফোন দেই যখন তখন আশা তেমন একটা ছিল না – কারন প্রায় রাত তখন দেড়টা বাজে ।
কিন্তু, ভাগ্য ভালো যে উনাকে পাই এবং তিনি এসে নিজে রক্ত দিয়েও আরো ৩ ব্যাগ রাতেই যোগাড় করে দেন । সত্যি কৃতজ্ঞ বোধ করছি ছেলেটার কাছে ।
-ও হ ! তাই ! আচ্ছা , আমরা ভাবলাম রক্ত বুঝি এখনো যোগাড় হয় নি ।
-না না , আপনাদেরও ধন্যবাদ – যে আপনারা কষ্ট কয়রে এসেছেন । তবে রক্তটা আমরা কালেক্ট করে ফেলেছি, আর ওটা বি পজেটিভ নয় , নেগেটিভ ।
-ও ! আচ্ছা । তা নাম কি উনার ?
- নাম বলেনি ।
তবে নাম্বারটা এইযে এটা ......
-দেখি ... আরে ! এ দেখি নেয়ামুলের নাম্বার ! আশ্চর্য ! কিভাবে সম্ভব ?!!
-আপনারা চেনেন তাকে ?
-আরে চিনব না কেন ?
ও আমাদের রুমমেট !
:::::::::::::::::::::::::: বিকাল ৬ টা ৫ ::::::::::::::::::::::::::
নেয়ামুল বসে আছে বাবুল মিয়ার ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে । ঘরটার অবস্থা যায় যায় প্রায় !
উপড়ে টিনের চালায় জং ধরে মরিচায় জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে । ঘরে আসবাব বলতে প্রায় কিছুই নেই ।
অবশ্য সে কিছু আশাও করেনি ।
সারাদিন বহুত খাটাখটনি করে যোগাড় করা ৮ হাজার ৫০০ টাকা সে তুলে দিল বাবুল মিয়ার হাতে ।
-নেন চাচা । এর বেশি আর পারলাম না । তবে আশা করি এটায় আপাতত একটা ব্যবস্থা করতে পারবেন ।
আর আমি দেখি আপনার ছেলের সাথেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করব । যদিও তাতে কতটুকু কাজ হবে জানিনা ।
তবে চাচা ছোট দুজনের পড়াটা চালিয়ে যেতে চেষ্টা করবেন যত বাধাই আসুক ,
দেখবেন এরাই আপনার সব কষ্ট দূর করবে । এরাই যে আপনার সম্পদ – তবে অবশ্যই মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার পরই ।
আর যেকোন সময় দরকার হলে আমাকে স্মরন করবেন । আমিতো আপনার ছেলের মতোই ।
চেষ্টা করব যতটুকুই পারি সাধ্যের মধ্যে ।
আর কখনো আফসোস করবেন না । ওতে কোন ফায়দা হয় না । যাই হোক চাচা আমি আজ আসি ।
কালকে রাত থেকে রুমে যাই নি । পোলাপান গুলো খুজছে নিশ্চয়ই !
আর কোন কথা বলতে না দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল বাবুল মিয়ার ঘর থেকে , ফিরে চলল হলের দিকে ধীর পায়ে ।
শরীরটা বড্ড ক্লান্ত , কিন্তু মনটা প্রশান্ত । তাতে লেগে আছে তৃপ্তির ছোঁয়া । এই তৃপ্তিটা একেবারেই অনন্য ।
একে বিকিকিনি করা যাবে না কোনও কিছুর বিনিময়ে ।
বিষ্ময়ে হতবিহ্বল বাবুল মিয়া চেয়ে রয়েছেন ছেলেটার গন্তব্য পানে ।
এ কার সাথে দেখা হল তার ! এ
তো সাধারন কোন মানুষ নয় !
তার আচরন কর্মতৎপড়তায় বাবুল মিয়া যেন বোবা হয়ে গেছেন ! কিভাবে তার ছেলের বয়েসী আরেকটা ছেলে এরকম অতিমানবীয় একটা কাজ করতে পারে তার মত মূর্খ এক রিকশাওয়ালার জন্য !
একেই বুঝি বলে শিক্ষা !
তিনি তার সারাটা জীবনে যত ধরনের শিক্ষা দেখেছেন , এছেলেটার মধ্যে ছিল তারও চেয়ে বেশি কিছু !
যার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা তার জানা নেই । জানা নেই কিভাবে এক ক্ষুদ্র নরসুন্দর এতোটা মহৎ হতে পারে !
শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞ্তায় চোখ দুটো ভিজে ওঠে তার !
মুখ দিয়ে শুধু উচ্চারিত হয় একটা শব্দ,......
“ফেরেশতা !”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।