কাদের মোল্লা ১৯৭১ এ এক হাজার মানুষ খুন করেছিল ।
মিরপুর , মনিপুর , রূপনগর , শিয়ালবাড়ি , শেওড়াপাড়া আর কাজীপাড়া ছিল তার প্লে-গ্রাউন্ড ।
এবং , তার হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার আগে থেকেই ।
আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭১ সালেই একহাজার মানুষ হত্যা করে ।
একটা মাত্র লাইন , একটা মাত্র বাক্য আমাদের কিছুই বোঝায় না ।
কাদের মোল্লার ইতিহাস ঘেঁটে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষকে শুনাচ্ছি সেই সব দিনগুলির কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ।
****
৬ই মার্চ ,১৯৭১।
সিরামিক ইন্ড্রাস্টির গেইট ।
মিরপুর ৬ নম্বর ।
দেশ উত্তাল ।
পরদিন রেসকোর্স ময়দানে ডাক দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তারও আগে , ১লা মার্চ নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় উদ্বোধনী সভা স্থগিত ঘোষণা করেছে ইয়াহিয়া খান ।
বাঙ্গালীর মনে ক্ষোভ,হতাশা । সিরামিক ইন্ড্রাষ্টির গেইটে তাই আজ জড়ো হয়েছে বেশ কিছু মুক্তিকামী জনতা । তাদের লক্ষ্য একটাই , বাঙ্গালী জাতির দাবী পেশ করা ।
জনসমাবেশ একত্রিত হতেই অনেকে স্লোগান দিয়ে উঠলেন , 'জয় বাংলা !'
পায়ে হেঁটে কয়েক কিলোমিটার পার হয়েই এই জনসমাবেশে যোগ দিয়েছেন কলেজ ছাত্র শাহাদত । গলা মেলালেন তিনিও । গলার রগ ফুলিয়ে বললেন , 'জয় বাংলা !!'
জনসমাবেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল । সকলে গলা মেলালো এই স্লোগানে ।
হঠাৎ ভীর ফাঁক হয়ে যাচ্ছে ।
লক্ষ্য করলেন তিনি । ধারালো অস্ত্র হাতে ওরা কারা ?
নেতাগোছের লোকটিকে ভাল মতই চেনেন তিনি । মিরপুরবাসী চেনে তাকে । চেনে 'কসাই' কাদের মোল্লা নামে ।
হাতে লম্বা ছুরি , রাম-দা ওদের ।
নির্বিচারে নিরীহ মানুষগুলোর শরীরের যত্র-তত্র ছুরি চালাতে লাগল তারা । দা দিয়ে কোপাতে থাকল ।
আহতদের আর্তনাদের ভারী হয়ে উঠল মিরপুর-৬ এর ওই এলাকাটি ।
****
ব্লক-বি , মিরপুর -১ ।
এখানে বর্তমানে শাহআলী থানা অবস্থিত ।
কাজিফুরী মসজিদ ও ঈদগাহ এখানেই । [আমার বাসাও এই জায়গার ঠিক পাশেই ]
১৯৭১ সালে এই এলাকাতে বাস করতেন ফিরোজ আলী ।
একটি ছোট ভাই আছে তাঁর ।
তাকে নিয়ে ফিরোজের গর্ব ও শংকার শেষ নেই ।
তবে তা কেবল ভেতরেই ।
বাইরে কিছুই প্রকাশ করেননা তিনি ।
এমনকী পল্লবের সামনেও না ।
ফিরোজ আলীর ছোট ভাই পল্লব , তবে মা নাম রেখেছিলেন টুনটুনি ।
অদ্ভূত নাম , কিছুটা মেয়েলী ধাঁচের ।
তবে , টুনটুনি কি ছেলে পাখি হয় না ?
নিশ্চয় হয় ! - ভাবেন ফিরোজ আলী ।
মাত্র আঠারো বছর বয়স টুনটুনির ।
তবে এই বয়সেও সে যথেষ্ট সক্রিয় । আসলে , যে কোন বয়সের তুলনাতেই সে যথেষ্ট সক্রিয় - শেখ মুজিবুর রহমানের সমর্থক হিসেবে ।
ফিরোজ আলীর গর্ব এখানেই । তবে , শংকাও এই কারণেই ।
দেশের পরিস্থিতি তো ভাল না ! যদি ,যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পারে না , বাঙ্গালীর জাতিগত দাবী সহ্য করতে পারে না , তারা যদি কিছু করে বসে ? ইসলামের নামে যারা সহিংসতা করে যাচ্ছে , তারা যদি কিছু করে বসে ?
ছেলেটার বয়স একদম কম , ও কি ভবিষ্যৎ দেখতে পায় ? ভাল মন্দ আগে থেকে বোঝে ?
ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে ফিরোজ আলীর ।
হ্যাঁ , এলাকার অনেকেই জানে , পল্লব ছেলেটা শেখ মুজিবর রহমানকে গুরু ভাবে । তাঁর যে কোন নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালক করে ও । এবং সেই সাথে - জাগাতে চেষ্টা করে ঘুমন্ত বাঙ্গালীদের ।
'তোমরা জেগে ওঠ , পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র কি কিছুই টের পাও না তোমরা !!'
এলাকার অনেকের সাথে এসব কথা জানে কাদের মোল্লাও ।
নোংরা নোটবুকে আগে লেখে রাখা অনেকের নামের সাথে আরও একটা নাম যোগ করে সে ।
'পল্লব টুনটুনি'
'দেশটাকে হিন্দুদের হাতে তুলে দিবার চায় এরা' রাগে জ্বলতে জ্বলতে গরগর করে বলে আব্দুল কাদের মোল্লা , 'ছাড়ুম না,আমার এলাকার একটারেও ছাড়ুম না । কুত্তার মত রাস্তায় রাস্তায় টাইনা মারুম ওরে আমি । '
কাদের মোল্লার লোক ছায়ার মত লেগে থাকে পল্লবের পেছনে ।
পল্লব যথেষ্ট সতর্ক ছেলে ।
বয়স কম হলে কি হবে !
সহজে নাগাল পাওয়া যায় না তার ।
তবে একদিন -
২৯শে মার্চ , ১৯৭১ ।
ঢাকার অন্যপ্রান্তে ছিল পল্লব । নিজের কাজেই ।
এতদিনে মোক্ষম সুযোগ পেয়ে আর দেরী করল না কাদের মোল্লার লোকজন ।
পল্লবের পাশে ব্রেক কষল একটা গাড়ি ।
চার/পাঁচ জন নেমে পল্লবের চোখ বেঁধে তুলে নিল তাকে গাড়িতে ।
মিরপুরে ফিরিয়ে আনা হল তাকে ।
হাত পেছনে বেঁধে রাস্তায় তাকে ফেলে দিয়ে মিরপুরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তাকে টেনে হেঁচরে নিয়ে যাওয়া হয় । নির্মম রাস্তার কর্কশ ঘর্ষণে সারা শরীরের চামড়া ছিলে যেতে থাকে তার ।
রক্তপাত শুরু হয় শরীরে বিভিন্ন স্থান থেকে । অন্য প্রান্তে পৌঁছে আবারো প্রথম প্রান্তের দিকে টেনে নেয়া হয় তাকে ।
আঠারো বছর বয়সের একটা ছেলের শরীর । পরিপূর্ণ যৌবনে পৌঁছেনি তখনও । এত অত্যাচার সহ্য করতে পারে না পল্লব ।
জ্ঞান হারায় রাস্তাতেই ।
জ্ঞান ফিরলে লক্ষ্য করে ঈদগাহ মাঠে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে । একটা গাছের সাথে ।
আল্লাহর বান্দার সাথে এমন অত্যাচার চালিয়ে শেষটায় তাকে কি না ঈদগাহে বেঁধে রাখা হল ?
শত যন্ত্রণাতেও হাসি পেল পল্লবের ।
কয়েকজন মানুষকে দেখতে পায় ও সামনে ।
চোখে-মুখে জীঘাংসা নিয়ে তাকিয়ে আছে যে লোকটা , তাকে চিনে নিতে মোটেও কষ্ট হল না টুনটুনির ।
এ তো কাদের মোল্লা ।
কসাই কাদের মোল্লা !
হাতে ওটা কি ওর ?
আতংক নিয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকে ফিরোজ আলীর আদরের ছোটভাই পল্লব ।
একটা চাপাতি ।
কাদের মোল্লা ওর পেছন দিকে চলে গেল ।
পিছমোড়া করে বাঁধা হাত খুলে দিচ্ছে কেউ ।
কাদের মোল্লার লোকেরা পল্লবের হাত টানটান করে ধরে সামনে আনে ।
বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সামনে তাকায় পল্লব ।
কাদের মোল্লার চাপাতি ধরা হাত উঠে যাচ্ছে ওপরে ।
'জয় বাংলা ।
' শোনা যায় কি যায় না এভাবে বলল পল্লব ।
বিদ্যুৎবেগে নেমে আসল কাদের মোল্লার হাত ।
অসহ্য যন্ত্রণায় জন্তুর মত চিৎকার করে উঠে জ্ঞান হারাল পল্লব ।
সামনে পড়ে থাকল ওর কাটা আঙ্গুল ।
৭ দিন এভাবে বেঁধে রাখা হয় পল্লবকে ।
আঙ্গুল কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে ওর ।
কোন চিকিৎসার ব্যাবস্থা ছাড়াও সাতদিন কিভাবে যেন টিকে গেল পল্লব ।
৫ এপ্রিল ,১৯৭১ ।
'টুনটুনি পাখি উইড়া গেছে না এখনও আছে ?' হাসতে হাসতে দলের একজনকে জিজ্ঞাসা করল কাদের মোল্লা ।
'এখনও বাইচা আছে ।
'
'শালাকে গুলি করে মেরে ফেল ! ' হাসি থেমে সেখানে স্থান নিল ক্রোধ ।
ধিকি ধিকি জ্বলছে কাদের মোল্লার চোখের তারা ।
'আর , ওই গাদ্দারের লাশ গর্তে ফালাইস না । ২ দিন ওই গাছে ওরে ঝুলায়া রাখবি । লোকে দেখুক ।
'
গুলি করে বুক ঝাঁঝরা করে দেওয়া হল পল্লবের । ঈদগাহের মাটি শুষে নিল রক্ত ।
গণকবরে , রাজাকার কাদের মোল্লার ভাষায় যেটা 'গর্ত' , সেখানেও ঠায় হল না কিশোর ছেলেটার ।
ওই গাছেই দুই দিন ঝুলিয়ে রাখা হল ছেলেটার লাশ ।
তারপর নিতান্ত অবহেলার সাথে গণকবরে ছুঁড়ে ফেলা হল ওর লাশ ।
*****
কাদের মোল্লার দুটো মাত্র অপরাধের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম ।
ঘটনা সম্পূর্ণই সত্য । কেবল অনুভূতির বর্ণনা নিজে অনুভব করে দিয়েছি ।
হয়ত আমি তেমন অনুভব করতেই পারিনি ।
কারণ বাস্তব জীবনে , পল্লব অথবা ওই জনসমাবেশের জনতার অনুভূতি অনেক অনেক গুন বেশি তীক্ষ ছিল ।
কাদের মোল্লা মনিপুর , কাজীপাড়া , শেওড়াপাড়া , রূপনগর , শিয়ালবাড়ি প্রভৃতি এলাকায় যত বিহারী ছিল , তাদের একত্রিত করে নিজের অধীনে সশস্ত্র বাহিণী গঠন করে ।
যার ফলাফল , হাজারো মানুষের মৃত্যু !
হানাদার বাহিনীর থেকেও একে আমি ভয়ংকর শত্রু হিসেবে দেখতে পাচ্ছি ।
কি ধারণা আর সবার ?
কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই তো ??
[উৎসর্গঃ শ্রদ্ধেয় আনিসুল হককে ।
উনার 'মা' লেখা থেকেই শিখেছি , কিভাবে ইতিহাসকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলতে হয় । ] ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।