আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চেরাগ আলী (দ্বিতীয় পর্ব)



আগের পর্বটি দেখুন এই লিন্কে: Click This Link । । ১। । ঘুমাতে গিয়েও ঘুম আসে না চেরাগ আলীর।

কী এক অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসেছে। অনেকদিন মানুষের পৃথিবীতে যায়নি বেশ তো ছিলো সে, আজ গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এসে কিছুতেই আর মন বসছে না তার। উঠে গিয়ে ইজিচেয়ারে গা হেলিয়ে দিয়ে গুনগুন করতে থাকে আনমনে ," আমায় এত রাইতে কেনে ডাক দিলি..."। একটু পর উঠে কোহেকাফের দিকে রওনা দেয় চেরাগ। আজকে একটু মাতাল না হলে চলছে না।

অলস জীবনের প্রতি একটা বীতশ্রদ্ধ মনোভাব মনের ভেতর ঘাঁই মারছে, বেশি বেড়ে ওঠার আগেই ওটাকে ডুবিয়ে মারা উচিত। এখন আর আগের মতো উড়ে যাওয়া লাগে না পুরো রাস্তা, কোন এক যুবক জ্বিন, কি জানি নাম - জ্বিনস্তাইন না কী - কয়েক বছর আগেই নতুন এক মন্ত্র আবিষ্কার করেছে, নিমিষেই চলে যাওয়া যায় গন্তব্যস্থলে। কিন্তু চেরাগ আলী একটু পুরানো কিসিমের, ওর এসব অত ভালো লাগে না। ধীরে-সুস্থে যাবো, একটু আধটু থামবো পথে-ঘাটে, এই না হলে যাত্রার মজা। পানশালার সাকি জামশেদ চেরাগের পুরানো বন্ধু, হায় কম দিন তো হলো না তাদের পরিচয়।

সেই কবে পানীয় পছন্দ হয় নাই বলে জামশেদের সাথে পাঙ্গা নিতে গিয়ে দুইজনই হাসপাতালে পড়ে ছিলো একমাস, সেই থেকে তাদের দোস্তি। আজকেও গিয়ে চেরাগ বসে পড়ে ওর পুরানো চেয়ারে। জামশেদ একটু ব্যস্ত ছিলো, তাড়াতাড়ি করে হাতের খদ্দের বিদেয় করে দুটা জিন নিয়ে এসে বসে চেরাগের সাথে। দুই জ্বিন আস্তে আস্তে জিনে চুমুক দেয়, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। নৈ:শব্দ প্রথম ভাঙ্গে জামশেদই , "কিরে দোস্ত আজকাল তো তোমারে দেখাই যায় না, কই থাকো? পাইছো নাকি নতুন কাউরে?" চেরাগ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, "পাইলে তো হইতোই দোস্ত।

বুঝলা এই জ্বিনের জিন্দেগি আর ভালো লাগে না। মানুষ হইলেই ভালো আছিলো। " "ধুস কি যে কও না তুমি, মাথা খারাপ হইছে?" চেরাগ জবাব দেয় না, আস্তে করে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কোহেকাফের একদম চুড়ার দিকে এই সুরাখানা, দিগন্তবিস্তৃত লাভা, একটু পর পর আগুন বুদবুদের মতো উঠছে উপরে। মনটা ভালো হয়ে যেতে থাকে চেরাগের।

জামশেদের দিকে ফিরে বলে, "তোমার আগের কথা মনে পড়ে জামশেদ ভাই? ঐযে যখন আমি বাগদাদে ছিলাম আলাদিনের সাথে, কত কাজ কত বিপদ কত রোমাঞ্চ ছিলো জীবনে। আর এখন? আরে গত একশো বছরে আমারে কেউ পুছেও নাই। তাও আজকে সকালে কে জানি ডাকছিলো, বাহিরে এসে দেখি কেউ নাই। ভাল্লাগে না আর। নিজেরে বাংলাদেশ সরকার মনে হয়; একরম কাজকাম ছাড়া আমি আর থাকতে পারুম না।

" শেষের দিকে গলাটা ক্যামন ধরে আসে চেরাগ আলীর। বন্ধুর এহেন বন্ধুর জীবনের কথা শুনে জামশেদের খারাপ লাগতে থাকে, কিন্তু জামশেদ উদ্যোগী জ্বিন, সে কিছুতেই চেরাগকে এভাবে থাকতে দিতে পারে না। কথা নয়, কাজে বিশ্বাসী সে। চেরাগকে পাকড়াও করে সে, "আচ্ছা কইলা সকালে কে জানি ডাকছিলো। এক কাম কর, তার আর ডাকনের অপেক্ষায় থাইকো না।

পাহাড় যদি তুমার কাছে না আসে, তইলে তুমারেই যাইতে হইবো। সোজা বাসায় যাও এখন, রাত একটু বাড়লেই বাহির হয়া ধরবা তারে। বুঝলা, এইটা প্রো-অ্যাক্টিভের যুগ। " চেরাগ আলী বাসার পথে যেতে যেতে চিন্তা করে জামশেদের কথাগুলো নিয়ে। ঠিকই বলেছে জামশেদ, সে-ই যাবে পাহাড়ের নিচে।

প্রো-অ্যাক্টিভ কথাটা তার পছন্দ হয়েছে, মনে মনে কয়েকবার আওড়ায়। রাতটা নামুক শুধু, এরপর চোরের দশরাত, জ্বিনের একরাত করে ছাড়বে চেরাগ। । । ২।

। আলাউদ্দীনের সময় কাটে না ধোলাইখালের দোকানে বসে। বাসায় গিয়ে ঘুম দিতে মন চায় তার। মাঝে মাঝে পিদিমটার দিকে চোখ যায় তার। নাঃ তার ভালোই পছন্দ হয়েছে।

ওটার বিভিন্ন ব্যবহার ভাবতে থাকে মনে মনে। আপাতত ওর বিছানার পাশে রেখে দেয়া যায়। পোলাপান দেখলে বেশ হিংসা করবে, এই ভেবে বড়ই আমোদিত হয় আলাউদ্দীন। পুরানো মালের দোকানে কাজ করার সুবাদে মাঝেমাঝেই এধরণের জিনিষপাতি নিয়ে যায় ঘরে, এজন্য সে যথেষ্ট হিংসার পাত্র তার বন্ধুমহলে। আপাতত থাক, কিছুদিন পর বেচে কটকটি খাওয়া যাবে।

বিকেল একটু গড়াতেই পিদিমটা শার্টের ভিতর গুঁজে বেরিয়ে পড়ে আলাউদ্দীন দোকান ছেড়ে। বাসায় গিয়ে বিছানার পাশে রেখেই বেরিয়ে পড়ে, এখনো সন্ধ্যা হয়নি পুরোপুরি, মাঠে গেলে ফুটবল খেলার সময় আছে এখনো। বেশ কিছুক্ষণ ফুটবল পিটে আর আড্ডবাজী করে যখন ঘরে ফেরে তখন রাত একেবারে কমও হয়নি। কিছু মুখে গুঁজে শুয়ে পড়ে আলাউদ্দীন, কালকে সকালে আবার তো যেতে হবে দোকানে। আলাউদ্দীনের ঘুম ভাঙ্গে হঠাৎ করে।

কেন ঘুম ভাঙ্গলো বুঝতে পারে না কিছুই, আশপাশ ঘোর অন্ধকারে দিশাও পায় না ভালোমতন। তবু কেন জানি মনে হতে থাকে ঘরে সে একা নয়, আরো কেউ যেন তার বিছানার দখল নিয়ে রেখেছে। ঠিক ভীরু বলা চলে না যদিও আলাউদ্দীনকে, তবু তার মনে বেশ ভয় ভয় লাগতে থাকে। অস্ফুটে বলে ওঠে, "কে? কে?" কে যেন কানের পাশে বলে ওঠে, "আমি চেরাগ"। "চেরাগ??? চেরাগ কে? আমার ঘরে কি? " "বলতেছি, কিন্তু তার আগে কও আগে আমার পুরা কথা শুনবা, চিল্লাইবা না।

ঠিক আছে?" । । ৩। । আলাউদ্দীন কেমন একটা ঘোর লেগে বসে আছে।

তার সামনে মাটি থেকে একটু উঁচুতে ভাসছে চেরাগ আলী। সেই পাজী পিদিমে টিমটিমে আলো জ্বলছে। আলাউদ্দীন চেরাগকে জিজ্ঞেষ করে, "যা চাইবো তাই?" চেরাগ সম্মতিসূচক ঘাড় দোলায়। আলাউদ্দীনের মনে পড়ে নান্না মিয়ার মোরগ পোলাও এর কথা, একদিন খেয়েছিলো সবাই মিলে। চেরাগকে জানায় সে তার আব্দারের কথা।

চেরাগ একটু ধন্দে পড়ে যায়, নান্না মিয়া জিনিষটা কী -খায় না পিন্দে -তার মাথায় ঢোকে না। কিন্তু ব্যাপার না, কোন কিছু জানা জ্বিনদের কোন সমস্যা না। প্রতিটা জ্বিনই একটা সম্মিলিত চেতনার সাথে সংযুক্ত, একটু সচেতন ভাবে কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করলেই সেটা সম্বন্ধে জানা হয়ে যায়। চেরাগ বেশ মনোযোগ দিয়ে জপতে থাকে, নান্না নান্না নান্না। বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায় কিন্তু কিছুই হয় না, চেরাগ প্রথমে আশ্চর্য পরে আস্তে আস্তে শঙ্কিত হয়ে পড়ে।

আলাউদ্দীন তার দিকে আশাবাদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, চেরাগের নার্ভাস লাগতে থাকে প্রচণ্ড। প্রবল চেষ্টা চালাতে থাকে সে, নান্না নান্না নান্না আরেআজবকীহইলো নান্না নান্না ইয়ামাবুদ নান্না নান্না নান্না রহমকরোমিলায়েদাও নান্না নান্না নান্না... এর মধ্যে টের পায় কে যেন তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। চেরাগ মনটাকে সেদিকে ঘুরিয়ে নেয় একটু, শুনতে পায় জামশেদের চিন্তা, দোস তুমি শেষ। তোমারে ধরতে এখন মালেকুশশরা ছুটতেছে। মালেকুশশর হলো জ্বিন সাম্রাজ্যের স্পেশাল সিক্রেট সার্ভিস, এদের নামে বাঘা বাঘা জ্বিনও লঘুক্রিয়া করে দেয়।

চেরাগ ভাবে, ক্যান আমি কী করছি? আবার শোনে জামশেদের ভয়ার্ত কন্ঠস্বর, তুমি নিজে থেকে গেছো একটা নাবালকের কাছে তার সেবক হইতে। আরে আমি তো জানতাম না তোমারে যে ডাকছে সে এখনো বাচ্চা। তুমি জানো না এই অপরাধের জন্য তোমারে কী শাস্তি পাইতে হবে... জামশেদের কন্ঠ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায়। চেরাগের মাথা ঘুরিয়ে ওঠে, বাতাস থেকে মাটিতে নেমে পড়ে। আলাউদ্দীন এতক্ষণ ধরে খেয়াল করছিলো জ্বিনের এই অবস্থা পরিবর্তন, এবার সে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, জিজ্ঞেষ করে, "কী ব্যাপার?" হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো চেরাগ যা বলে তার মর্ম উদ্ধার করে যা বুঝতে পারে তাতে আলাউদ্দীন তেমন একটা চিন্তার কিছু পায় না।

বলে, "আরে তুমি না জ্বিন, সব পারো। তো তোমার টেনসন কী?" চেরাগ হাহাকার করে ওঠে, "আমারে জ্বিনদের নেটওয়ার্ক থেকে বাইর কইরা দিছে, এখন নিজে নিজে আমি আর কিছুই জানতে পারমু না। আর না জানলে ক্যমনে কি করুম? আরে আমার তো এখন তোমার হুকুম ছাড়া কিছু করনের জো নাই। কোন কু্ক্ষণে যে তোমার কাছে আসলাম...ওঁয়াঁওঁয়াঁওঁয়াঁ" ডাক ছেড়ে কান্না ধরে চেরাগ। আলাউদ্দীনের মাথায় হঠাৎ বুদ্ধি খেলে যায়, "চলো আমার লগে, আমরা একলগে পলামু।

" (চলতে পারে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.