mojnu@ymail.com
আজ বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে শুধু শপাং শপাং শব্দ। দোররা মারার আওয়াজ। একুশ শতকেও বাংলার নারীর পিঠে ডোরাকাটা দাগ, ছোপ ছোপ জমাট রক্তের দাগ এবং পিঠের ওপর থেকে নিচে, নিচ থেকে ওপরে, ডান থেকে বাঁয়ে, বাঁ থেকে ডান পাশে সরলরেখার মতো দোররার দাগ। যেন পল ক্লির আঁকা বিমূর্ত চিত্র। বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে আজ দোররা নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য।
অন্য ধর্মের লোকেরা যাকে বলে চাবুক, বিশুদ্ধ মুসলমানেরা তাকে বলে দোররা। দোররার সদ্ব্যবহারের কথা আজকাল প্রতিদিনই কাগজে আসে। এক স্কুলছাত্রী আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, দোররা জিনিসটি কী? আমি তাকে বলেছি, ওটা ইসলামি চাবুক। সাবধানে থেকো।
মানুষকে পেটানোর নানা উপকরণ আছে: বাঁশের লাঠি, কঞ্চি, বেত, জুতা প্রভৃতি।
কেউ যদি আঘাত ও অপমানকে যোগ করে একসঙ্গে দিতে চায় তা হলে জুতাই উত্তম। তার পরই দোররা। আজ বাংলার গ্রামগুলোতে ধর্মরক্ষক ও মোড়লদের বাড়ির বেড়ায় ঝুলছে দোররা। সন্ধ্যার পরে তাঁদের উঠানগুলোতে বসছে বৈঠক। লিঙ্গ পরিচয়ে আসামি অবধারিতভাবে একজন বা একাধিক নারী।
সমাজপতিরা অপরাধীকে কশাঘাতের যে বিধান দিচ্ছেন, তার সংখ্যাগত একটি বৈশিষ্ট্য আছে। তারা ৩২, ৫২ বা ৬৫-র সংখ্যায় সন্তুষ্ট নন। দোররাই যদি মারার হুকুম হয় তা হলে তা হতে হবে ১০১ বার। দোররা-প্রাপক বাঁচুক বা মরুক ১০১ ঘা তাকে খেতেই হবে।
দোররার শপাং শপাং আওয়াজ শুনতে পেয়েছি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থেকে।
দোররার শব্দ শুনতে পেয়েছি সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থেকে। দোররার শব্দ ভেসে এসেছে শ্রীমঙ্গলের শাসনগ্রাম থেকে। শাসনগ্রাম নামটি সার্থক। ‘ইসলামি’ শাসন আছে বলেই ওই গ্রামের নাম শাসনগ্রাম। সেখানে কোনো ৪২ বছর বয়স্ক তিন সন্তানের মা ভানুগাছ সড়কে দাঁড়িয়ে কোনো বিধর্মী ছেলের সঙ্গে কথা বললেও মুরব্বিরা ‘বাঁশের কঞ্চির দোররা’ দিয়ে মারেন তাঁকে ১০১ ঘা।
অবশ্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে অমুসলমান ছেলেটি বেঁচে গেছে। আমাদের পল্লীর ‘মুরব্বিয়ান’রা সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপবাদ নিতে চাননি। তা না হলে যুবকটির পিঠের চামড়াও বাদামি রঙের পলিথিনের মতো উঠে যেত।
আমাদের গ্রামের ‘মুরব্বিয়ান’রা সবাই পুরুষ। কোনো নারীকে যারা ধর্ষণ করে, তারাও পুরুষ।
সুতরাং হাতেনাতে ধরা পড়ার পরও সালিসে বসেই বিচারপতি মোড়ল মহোদয় এবং তাঁর জুরির সদস্য ধর্মপতিরা প্রথমেই ধর্ষককে বলেন, ‘তুমি নির্দোষ, খালাস। পুরুষ মানুষের মতোই কাম তুমি করেছ। এই সালিসে তোমার থাকনের দরকার নাই। বাড়ি চইলা যাও। ’
তারপর বিচারক ও জুরিরা শ্বাপদের মতো, শকুনের মতো অথবা পাগলা শেয়ালের মতো চোখ করে তাকান ধর্ষিতার দিকে।
ধর্ষিতা একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে। ‘শুনানির প্রয়োজন নাই। পুরুষ মানুষের শখ হইছে। গোপনে কী করছে না করছে, তার জন্য আবার বিচার কিরে! পাথর ছুইড়্যা মারার হুকুম দিতাম। তা না দিয়া দিলাম মাত্র ১০১ দোররা।
হাজেরানে মজলিশের সামনেই সে দোররা মারা হবে। পিঠের কাপড় সরাও। ’ জল্লাদ পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে ফাঁসির দড়ির মতো দোররা হাতে। সে তার কর্তব্য পালনে কালবিলম্ব করে না।
কয়েক ঘা খাওয়ার পরই যখন অভাগিনী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, তখন মাথায় পানি ঢেলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে তাকে সুস্থ করে তোলা হয়।
তারপর অবশিষ্ট বেত্রাঘাত বা দোররাঘাত।
গত কয়েক সপ্তাহে আমরা সাত-আটটি গ্রাম থেকে দোররা মারার খবর কাগজে দেখেছি। সব শেষ সংবাদ এসেছে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থেকে। সেখানে মা (৫০) ও মেয়েকে (৩০) দোররা মারা হয়েছে। এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নির্যাতিতারা আতঙ্কে আছেন।
পাঁচ দোররাবাজকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
ভাবার বিষয়, সব ঘটনায়ই দোররা পড়েছে শুধু নারীর পিঠে এবং সেসব নারী যারা যৌননিপীড়নের শিকার, তারা যাদের দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছে তাদের পিঠে দোররার ছোঁয়াও লাগেনি। কারণ তারা পুরুষ, ও-কাজ তারা করতেই পারে। প্রকৃতপক্ষে ঘটনা শুধু সাত-আটটি নয়। এমন দোররা কত যে হানা হচ্ছে নির্যাতিত নারীর পিঠে, তা জানা যেত যদি দেশের সব মোড়লবাড়িতে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে রাখা যেত।
গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য আইনের শাসন। গণতন্ত্র আর দোররাতন্ত্র একসঙ্গে চলে না। গ্রাম-বাংলায় দোররাবাজদের তালেবানরাজ ঠেকানোর জন্য রাষ্ট্রকে কঠোর আইন করতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন যে শুধু অর্থহীন হয়ে পড়বে তা-ই নয়, বাংলার নারীরা ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে পারবে না। এখন আমাদের জনপ্রতিনিধিদের যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে: তাঁরা গণতন্ত্র চান না, দোররাতন্ত্র চান।
লেখক::
সৈয়দ আবুল মকসুদ
গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
সৌজন্যে: দৈনিক প্রথম আলো
১৬ জুন ২০০৯।
কোম্পানীগঞ্জের ঘটনা: Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।