আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রবন্ধ : ১ । নব্বই দশকের কবিতা সংকলন নিয়ে কিছু কথা

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...

প্রথম অংশ দশকভিত্তিক সাহিত্য ভাবনা অভিনব নয়, তবে স¤প্রতি দশকভিত্তিক সাহিত্য বিচার-বিশ্লেষণ, আলোচনা সমালোচনার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লক্ষণীয়। এই দশকভিত্তিক সাহিত্য ভাবনা নিয়ে পণ্ডিতমহলে যথেষ্ট মতবিরোধ থাকলেও ইতিহাসের পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, এ রীতিটি প্রায় সকলেই মেনে নিয়েছেন। তিরিশের দশকের নতুন সাহিত্যধারা চিহ্নিত করণের মাধ্যমে সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে দশকভিত্তিক ভাবনার শুরু হয়েছিল। ফলে দশকভিত্তিক সাহিত্য ভাবনা একেবারে যে আনকোরা নয় তা বলাবাহুল্য। সুতরাং বলা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা সাহিত্যে দশকভিত্তিক সাহিত্যের বিভিন্ন শ্রেণীকরণ, বিষয়বস্তু ও চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের প্রয়াস চলেছে।

এ বিষয়ে মূল প্রশ্নটি অন্যত্র অর্থাৎ দশকভিত্তিক এই সাহিত্য ভাবনায় আমরা ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের সাহিত্য প্রকৃতার্থেই পাচ্ছি কিনা? নাকি শুধুই কালিক সীমারেখায় এই দশকভিত্তিক ভাবনার মূল হিসেবে কাজ করছে? ‘নির্বাচিত বাংলা কবিতা : নব্বইয়ের দশক’ সংকলন গ্রন্থের সম্পাদক সুমন সরদার নিজে নব্বই দশকের সাহিত্যের একটি চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন; যদিও তাঁর প্রকল্পিত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তর মতভেদের অবকাশ আছে তথাপি তিনি ধন্যবাদার্হ্য কারণ, তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞান উপলব্ধি থেকে সংকলিত কবিতায় স্বতন্ত্র মাত্রা ও ভিন্ন স্বাদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে সম্পাদক কবিতা বাছাইয়ের সময় পূর্ববর্তী কবির প্রভাব স্বীকার করে নিয়েও নব্বইয়ের কবিতার বেশকিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন। উলে¬খ্য, তাঁর নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যসমূহের অনেকগুলোই পূর্ববর্তী চলি¬শ-পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশির দশকের বাংলা কবিতায় পাওয়াও দুরূহ নয়। তারপরও সম্পাদক তাঁর সংকলনভুক্ত কবিতাবলি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত যুক্তির অবতারণ করেছেন : পূর্ব দশকের কাব্য ঋণের পাশাপাশি ঐতিহাসিক চেতনা, পূর্ববর্তী ও চলমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব কাব্যচেতনার শক্তি যোগান দেয়। সুতরাং দশকের একটি প্রভাব নব্বইয়ের কবিদের ওপর পড়েছে এবং তা অন্য দশকের চেয়ে আলাদা।

(সম্পাদকের কথা, পৃ : ১০) অর্থাৎ সম্পাদকের নিজস্ব পরিকল্পিত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের মাপকাঠিতে ‘নির্বাচিত বাংলা কবিতা : নব্বইয়ের দশক’ গ্রন্থের সম্পাদনা কালে অন্য দশকের চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যের কবিদের কবিতা নির্বাচন করেছেন। তিনি কবিতা নির্বাচন কালে গুরুত্বপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে মাপকাঠি ব্যবহার করেছেন তা নিম্নরূপ : ব্যর্থতার গ¬ানি অকপটে প্রকাশ, রাজনৈতিক চেতনার প্রতি অমনোযোগ, সহজাত ভোগবিলাসিতা নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ, বহুধাবিভক্ত ও বিচিত্র ধারায় কাব্যচর্চা, পূর্ণাঙ্গ বক্তব্য উপস্থাপন না করে পাঠকের চিন্তাশক্তিকে আরো উস্কে দেয়া প্রভৃতি। (সম্পাদকের কথা : পৃ : ১২) উপরোক্ত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কবির সংখ্যা নব্বই দশকে একেবারে কম নয়; এই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কবিদের সকলের একটি করেও কবিতা নিয়ে নব্বইয়ের কবিতা সংকলিত হলেও প্রমাণ সাইজের এই সংকলনগ্রন্থ হবে। অতএব এই বিশাল কর্মযজ্ঞে নেমে সম্পাদক সুমন সরদার আরো একবার হোঁচট খেয়ে স্বীয় উদ্ভাবিত প্রক্রিয়ার দুই দেশের সর্বসাকুল্যে আশি জন কবির কবিতা নিয়ে সংক্ষিপ্ত অথবা বলা যেতে পারে ফুটনোট প্রতীম একটি কবিতার সংকলন সম্পন্ন করেছেন। সুমন সরদার এ সংকলন-গ্রন্থে কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একজন কবির ‘৫টি কবিতার অধিক নয় এবং ৩ পৃষ্ঠার উর্ধ্বে নয় এই নীতির ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক কবির কবিতা বাছাই’ করেছেন।

সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, সম্পাদকের নির্ধারিত নীতিমালা অশৈল্পিক; কিন্তু আর্থিক দিক ও সংকলনের কলেবর বিবেচনায় এই অশৈল্পিক শর্তেই কবিতা বাছাইয়ের চূড়ান্ত দুঃসাধ্য কাজটি তাঁকে করতে হয়েছে। উপরন্তু তিনি দুই দেশের চলি¬শ জন করে মোট আশি জন কবির নিজস্ব পরিচয় ও কবিপ্রতিভার ন্যূনতম বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার নিমিত্তে আরো তিনটি দিক বিবেচনায় রেখেছেন। তা হলো : প্রথমতঃ নব্বইয়ের দশকে যে সকল কবি মোটামুটি পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন; দ্বিতীয়তঃ কবিজীবন দীর্ঘ না হওয়া সত্ত্বেও যাঁদের কবিতায় নিজস্বতার সুর ধ্বনিত হয়েছে; এবং তৃতীয়তঃ যাঁরা সা¤প্রদায়িকতা কিংবা মৌলবাদিতা অথবা প্রতিক্রিয়াশীতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ নন। (সম্পাদকের কথা, পৃ : ১২-১৩) অনেক শর্ত জুড়ে দেয়ার পরও সম্পাদক সুমন সরদার নব্বইয়ের কাব্যধারার শর্ত পূরণে সক্ষম সকল কবির কবিতা তাঁর সংকলনভুক্ত করতে পারেননি। এক্ষেত্রে সম্পাদকের ব্যর্থতার দায়ভার তিনি সবিনয়ে স্বীকার করেছেন, তবে অনেক কবির পর্যাপ্ত কবিতা আমার সংগ্রহে না থাকা অথবা কোনো কোনো কবির সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার করণই মুখ্য।

আবার কেউ কেউ আকারে ইঙ্গিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গ্রন্থভুক্ত কবিদের পছন্দের কবিতাকে গুরুত্ব দিয়েছি। যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি, তাঁদের কবিতা আমি নিজেই বাছাই করেছি। এক্ষেত্রে যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নি তাঁদের কারো কারো সম্ভাব্য অভিযোগ মাথায় পেতে নিলাম। (সম্পাদকের কথা, পৃ : ১৩) এই সবিনয় স্বীকারোক্তির পরও সম্পাদক কর্তৃক আলাদা করে চিহ্নিত স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নব্বইয়ের কবিদের ‘সম্পাদকের কথা’য় একটি দীর্ঘ নামের তালিকায় তাঁদের কবিতা পাঠের গুরুত্ব স্বীকার করে তাঁর ব্যক্তিক অক্ষমতা তুলে ধরেছেন।

এমনকি যাঁদের নামোল্লে¬খ করতে পারেন নি তাঁদের প্রতিও অগাধ শ্রদ্ধা-সম্মান প্রদর্শন করেই এই সংকলন-গ্রন্থ প্রকাশে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন। নব্বইয়ের বিশাল কবিদের মিছিল থেকে সম্পাদক যে আশি জন কবির কবিতা নিয়ে খণ্ড এই প্রয়াস গ্রহণ করেছেন নিঃসন্দেহে তা প্রশংসার্হ্য। তবে তিনি যদি এই সংকলন গ্রন্থটিকে একটি চলমান প্রকল্প হিসেবে ধারাবাহিক খণ্ডে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করতেন তাহলে সম্পাদকের সার্থকতা অথবা অর্জন আরো খানিকটা হতে পারত। সম্পাদক ‘নির্বাচিত বাংলা কবিতা : নব্বইয়ের দশক’ সংকলনে কবিদের নামের আদ্যাক্ষরক্রমে কবিতাবলি সাজিয়েছেন। এক্ষেত্রে সম্পাদক বয়োজ্যেষ্ঠতার পরিবর্তে কবির নামের ক্রম-নীতি অনুসরণ করেছেন।

এ সংকলন গ্রন্থের শুরুতে তিনি বাংলাদেশের চলি¬শ জন কবির কবিতা সংকলিত করেছেন। অতঃপর পশ্চিমবঙ্গের ত্রিশ জন এবং সর্বশেষে ত্রিপুরা’র দশ জন কবির কবিতার সমাবেশ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচিত চলি¬শ জন কবির অনেকেই ইতোমধ্যেই স্ব-স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা, পরিচয় লাভ করেছেন। আর যাঁরা অদ্যাবধি প্রতিষ্ঠা পান নি তাঁরাও আধুনিক বাংলা কবিতায় স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। বক্ষমান আলোচনায় আমি বাংলাদেশের চল্লিশ জন কবির রচিত কবিতাবলির সামগ্রিক পাঠোত্তর একটি স্কেচ তৈরির চেষ্টা করেছি।

অলকা নন্দিতার পাঁচটি কবিতা দিয়ে গ্রন্থের সূচনা ঘটেছে। কবির ‘প্রতœজীব’, ‘শাদাশাড়ি’, ‘নির্বানতত্ত্ব’, ‘বৃষ্টি নামুক চৈত্রের খরায়’ এবং ‘মোহনা’ শীর্ষক পাঁচটি কবিতার মধ্য দিয়ে কবি-চারিত্র্য ধরার প্রয়াস পেয়েছেন সম্পাদক। অলকা নন্দিতার সবক’টি কবিতায় নব্বইয়ের ধারার সঙ্গে একাত্ম না হলেও ‘নির্বানতত্ত্ব’ কবিতায় নব্বইয়ের স্বরূপ অনেকটাই উঠে এসেছে। অর্থাৎ অলকার কবিতার স্বীয় ঐতিহ্যের জাগরণের সুস্পষ্ট আভাস দিয়েছে। আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’র চারটি কবিতার সংকুলান হয়েছে সম্পাদক নির্ধারিত ছক অনুযায়ী।

‘পলাশী’, ‘তৃতীয় যাত্রা ধ্বনি’, ‘ভিক্ষুক চতুর্থ রাতে’, ‘শিকারি ও আয়না’ কবিতা চতুষ্টয়ে আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’র মেধানির্ভর কাব্যপ্রতিভার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। কবির ‘পলাশী’ এবং ‘তৃতীয় যাত্রা ধ্বনি’ অত্যন্ত বক্তব্যধর্মী কবিতা। কবিতাদ্বয়ে বাঙালির পরাজয়ের ঘৃণ্য নৃতত্ত্ব অসাধারণ কাব্যব্যঞ্জনায় কবি মূর্ত করে তুলেছেন। সাঈদ ওবায়দুল্লাহ’র কবিতায় বক্তব্য প্রকাশের প্রবহমানতা বজায় রেখে কবি ছন্দকে স্বীয় স্টাইলে সাজিয়েছেন। যেখানে ছন্দের চেয়ে কবির ভাব প্রকাশ প্রধান ব্যাপার।

আমীর খসরু স্বপনের ‘পাঠ’, ‘বেড়াল’, ‘পথ’, ‘রেলিঙ’ এবং ‘স্তন’ শীর্ষক কবিতার মূল বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রথম পাঠে কবির সহজ-সরল প্রাঞ্জল শব্দবিন্যাসে কবিতার মায়াজাল বিস্তার করা। নব্বইয়ের কবিতায় শাব্দিক সারল্য অন্যতম একটি প্রধন বৈশিষ্ট্যরূপে ইতোমধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। কবির ‘স্তন’ কবিতায় এ ভূমির ঐতিহ্য অসাধারণ কাব্যসুষমায় আবৃত করা হয়েছে। আয়শা ঝর্ণা’র ‘মুগ্ধভিড়’, ‘মাতৃগন্ধ’, ‘ঘূর্ণিবার্তা’, ‘শীলাদ্যুতিময়’, ‘প্রকৃতি’ শীর্ষক পাঁচটি কবিতার ভাষার সারল্য প্রশ্নাতীত; বরং ভাবের ক্ষেত্রেও খানিকটা অগভীর। তবে আয়শা ঝর্ণার কবিতার যে বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, নারী মননের অকপট উন্মোচন ঘটেছে ‘মুগ্ধভিড়’, ‘মাতৃগন্ধ’ এবং ‘প্রকৃতি’ কবিতাত্রয়ে।

অর্থাৎ নারীও আজ কবিতায় অকপট শ্রেণী অবস্থান ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে; উপরন্তু ঝর্ণা যথেষ্ট পরদর্শী এক্ষেত্রে। আহমেদ স্বপন মাহমুদ-এর ‘ব্যবধান’, ‘প্রজাপতির রক্ত’, ‘পাখি’, ‘মৃত্যু’ এবং ‘মুমূর্ষু’ শীর্ষক কবিতায় পাখি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর সবকটি কবিতায় পাখি যেন চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ। স্বপন মাহমুদের পাখির প্রতীকে এদেশের সংস্কৃতি-রাজনীতি পরিবেশনীতি সবকিছুরই মাত্রাগত কাব্যব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। কবির হুমায়ূন-এর ‘গোপন’ কবিতার যে গোপন অসুখের কথা অর্থাৎ প্রেম-বিরহ-কাম চিত্রিত হয়েছে, তা ‘ঘুমনারী’, ‘স্পর্শ এক’ এবং ‘নৈঋত’ কবিতা অবধি সংক্রামিত হয়েছে।

এর মধ্যে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘স্পর্শ এক’ কবিতার ছন্দভঙ্গি এবং আঙ্গিক বিন্যাস। উপরন্তু কবিতার কাব্যময়তা শৈল্পিক মানদণ্ডে উত্রে যায়। তবে প্রেম-কাম-বিরহ তাঁর পিছু ছাড়েনি কখনো। কামরুজ্জামান কামু-এর কবিতাগুলো হচ্ছে ‘চারিদিকে ধানের ব্যঞ্জনা’, ‘ইম্ম্যাচিউরিটি’, ‘দিনরাত্রির গোলকধাঁধা’ এবং ‘কবি রঙ্গে বসে বসে’। এই চারটি কবিতার মধ্যে কামু অন্তত দুটো কবিতায় প্রচলিত কাব্যাঙ্গিক ভাঙার সাবলীল প্রয়াস পেয়েছেন।

তবে উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘চারিদিকে ধানের ব্যঞ্জনা’। এ কবিতাটি কবি ‘সারাংশ’, ‘ডাকু’, ‘প্রেমিক’, ‘পরকীয়া’, ‘ধান ও ঘটনা’ উপনামে বিভক্ত করেছেন। কবিতাটিতে সমকালীন সামাজিক ব্যঙ্গচিত্র উঠে এসেছে। কিভাবে প্রান্তিক মানুষের জীবন থেকে মান-সম্মান ও সম্ভ্রম চুরি হয়ে যায়, তা প্রকাশ পেয়েছে। ‘কবি রঙ্গে বসে বসে’ কবিতাটি অভিনব কাব্য প্রয়াস হিসেবে যতটা তাৎপর্যবাহী বিষয়-উপাদান বিবেচনায় ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।

‘ইম্ম্যাচিউরিটি’ শরীরী বিষয়ক কবিতা হলেও কামুর বলার ধরন পূর্ববর্তীদের চেয়ে আলাদা। খোকন মাহমুদ-এর কবি চরিত্রের সাধারণ প্রবণতা ‘ঘুড়িমেঘ’, ‘জন্ম মৃত্যুর বাঁকে’, ‘ঝরাপাতাগুলো’, ‘জলের অতলে’ এবং ‘আগুনস্বভাব’ শীর্ষক কবিতাবলিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন সম্পাদক। খোকন মাহমুদের কবিতায় ধারাবাহিক নস্টালজিয়া এবং উপমহাদেশীয় অধ্যাত্মবাদ প্রকটিত হয়েছে। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি যেন তাঁর কবিজ স্বভাব। তবে তিনি বেশ খানিকটা নৈরাশ্যবাদী স্বভাবাক্রান্ত হয়েছেন পূর্বজ জীবনানন্দের কাব্যধারার অনুকরণে।

চঞ্চল আশরাফ-এর কবিতা ‘দাহ’, ‘নিমজ্জনচিত্র’, ‘অনিবার্য’, ‘সিসিফাস’ সংকলভুক্ত কবিতা। আধুনিক জৈবনিক বাস্তবতায় চঞ্চল আশরাফ অতৃপ্ত-পিপাসার্ত কামনা-বাসনা ও যৌনতার ক্লিষ্টকিন্ন প্রকাশ করেছেন। কামকেন্দ্রিক জৈবনিক চেতনার জটিলতর বিষয়-আশয় কবির কাব্যোপদান। তিনি জীবনকে কামের মত্তমাতাল গন্ধে খুঁজে খুঁজে যেন এক ক্লান্ত পথিক। যে কবির সিসিফাসের ন্যায় চূড়ায় ওঠা হয়নি কোনদিন।

জাফর আহমদ রাশেদ-এর কবিতা ‘অবিনাশের সঙ্গে’, ‘প্রেয়সী অস্পৃশ্যা হলে’, ‘অস্থিতে আগুন’, ‘অজাতিস্মর’, ‘উৎকর্ণ’। কবির মূল বিষয় প্রেম। প্রেমে জাফর আহমদ রাশেদ বাস্তব জীবনের লৌকিক দুঃখ-যন্ত্রণা ভুলতে রোমান্টিক। তাঁর প্রেম অনেকাংশে রাবীন্দ্রিক প্রভাবপুষ্ট ভাববাদী চেতনার অরূপের সাধনার সমান্তরাল। মাটির পৃথিবীতে কবির প্রেয়সীকে সৌন্দর্যের ধরাবাঁধা ছকের খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

কবি বিমূর্ত প্রেয়সীর সন্ধানে পার্থিব চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। টোকন ঠাকুর রচিত ‘অতিথি পাখির সঙ্গে’, ‘শিশুবর’, ‘আবছায়া, ঝাপসায়া’ ও ‘ফড়িংজন্মফল’ কবিতার প্রকৃতিমুগ্ধ শুদ্ধাচারী কবি-আত্মার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ নতুন করে আর একজন প্রকৃতি পূঁজারী কবিকে পাওয়া যায়; যিনি জীবনানন্দ দাশের চোখ দিয়ে একালের বাংলার শ্রীহীনতা তুলে ধরেছেন। প্রসঙ্গত টোকন ঠাকুরের প্রকৃতি মুগ্ধতায় রোমান্টিকতার ছোঁয়া সচেতভাবেই এসেছে। তবে টোকন ঠাকুরের প্রকাশভঙ্গি আলাদা; খানিকটা অভিনবও বটে।

তিনি কবিতার আঙ্গিকগত পরীক্ষার ক্রমাগত যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। তপন বাগচী-এর ‘আকাশ, পদ্মা ও চাঁদের যৌবন’, ‘নীলিমা আমার বোন’, ‘খোলাবাজার’, ‘নদীকাহিনী : দুই’, ‘নৌকাকাণ্ড’ কবিতা পাঁচটিতে কবির দ্বিধারিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত। তপন বাগচীর কবিতার প্রিয় উপাদান বাঙালি জীবনের চিরায়ত লীলাকীর্তন এবং দেশের রাজনীতি। রাজনৈতিক প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর কবিতায়। তবে তিনি পুঁজিবাদী বা সমাজবাদী রাজনৈতিক আদর্শের সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নির্ধারণ না করে কবিতায় মানবতার পক্ষে সামাজিক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান কামনা করেন।

পরিতোষ হালদার-এর ‘প্রতিদিন ছুঁয়ে যাই’, ‘জল-নদী’, ‘সাঁই রাত খুলে দাও’, ‘নৃ’ এবং ‘ঋতুছায়া’ কবিতাগুলোতে সমকালীন সভ্যতার বাস্তবতায় জীবনের গভীরতা ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেন। জীবনকে খুঁজে পেতে নদীর জলের লীলায়িত তরঙ্গের ন্যায় তাঁর কবিতার ভাষা নেচে চলে। স্বীয় সংস্কৃতি ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধানী কবি পরিতোষ হালদারের কবিতায় নব্বইয়ের মূল সুর প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে। পাঁশু প্রাপণ-এর কবিতাগুলো হচ্ছে ‘অহম্’, ‘ভাজকের হাড় ও করাত করাত শব্দ’, ‘অনুভূমিকের তটি কূল ও রামদয়াল’ এবং ‘সিঁদুর-স্বস্তি’। পাঁশু প্রাপণ কবিতায় প্রকারণিক নিরীক্ষায় অধিক মনোযোগী।

তিনি কাব্যভাষায় তৎসম শব্দের প্রয়োগে সচেতন। গদ্যগন্ধী কাব্যভাষায় জ্যামিতিক নিয়মে দর্শন ও জগৎ-ভাবনা শাব্দিক জটিলতায় তুলে ধরেছেন। অভিধান থেকে অর্থ এনে তাঁর কবিতার শব্দের মায়াজাল তুলে নেয়া হলে সরল এবং শ্রীহীন হয়ে পড়ে। বলা দরকার তিনি কাব্যোপাদানের চেয়ে বিনির্মাণ শৈলীকে অধিকতর মূল্যায়ন করেন। বাদল ঘোষ-এর নির্বাচিত ‘মৃত মাছের বিমূর্ত চোখ দু’টো’, ‘সর্বগ্রাসী ঘুম’, ‘তোমার ছবির নিকুচি করি’, ‘সম্মতির রাজদূত’ এবং ‘পোড়ো বাড়িটায়’ সমকালীন যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তির ছায়াপাত ঘটেছে।

এতসব বৈসাদৃশ্য দেখে দেখে এক সর্বগ্রাসী ঘুমের দেশে কবি শান্তি খুঁজেছেন; কিন্তু ভুলতে পারেন কালের পোড়ো বাড়িতে নিজের অবস্থানকে। আধুনিক জীবনের শহুরে ঘরাণায় একঘেয়েমি জীবনের নিষ্করুণ প্রকাশ বাদল ঘোষের কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু। বায়তুল্লাহ কাদরীর কবিতা ‘সিনীবালি : এক’, ‘শূন্যের মাঝারে’, ‘ব্রহ্মাণ্ডে তা দিচ্ছে’, ‘বর্ষা : চার’ এবং ‘পাখি-১’। কবির জীবনবোধ উপমহাদেশীয় ভাববাদে আবিষ্ট। তিনি নাগরিক জীবনের বিষণœতায় স্বস্তি-শান্তি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবা-রাত্রির কাব্য’ উপন্যাসের উদ্ভট জৈবনিক বাস্তবতার সমান্তরাল বায়তুল্লাহ কাদরীর প্রেয়সী। উদ্ভট নৃত্যের শাহুরিক যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের সঠিক ঠিকানা কি? তা অনুসন্ধান করাই কবির মূল লক্ষ্য। ব্রাত্য রাইসু-এর ‘হাঁদাগঙ্গারাম’, ‘নন্দনতাত্ত্বিক পদচারণা’, ‘হালুমহুলুম-ভালুমবাসা : লাভ ইন ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ এবং ‘কালো মেয়ে’। জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা ব্রাত্য রাইসুর কবিতার মূল বিষয়-উপাদান। কবি জীবনের কথা ভণিতাহীন অকপট প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন।

তিনি কবিতায় তথাকথিত ভদ্রতার মুখোশ পরিহিত মানুষের ভাণ প্রকাশ করে দিয়ে এ-কালের নৈতিক অধঃপতনের অমলিন প্রকাশ করেন। তিনি ধূর্ত, ভণ্ডদের হিপোক্র্যাসির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক কাব্যভাষা খুঁজে পেয়েছেন। তথাকথিত ভদ্রতা-সভ্যতা-শালীনতার অনৈতিক চর্চা বন্ধ না করলে নষ্ট সমাজ আরো নষ্ট হবে এটাই কবি কাব্যভাষায় ফুটিয়ে তোলেন। মজনু শাহ্ প্রকতার্থে নব্বইয়ের চারিত্র্যে বিকশিত কবি, যার ‘সংঘামিত্রা’, ‘জলপায়রা’, ‘বীণাপাণি’, ‘অভিভাবিকা’ এবং ‘দুর্বামঙ্গল’ শীর্ষক পাঁচটি কবিতায় স্বীয় ঐতিহ্যের এবং প্রকরণ ভাঙেন, জীবনকে দেখেন বাস্তবতার নিষ্ঠুরতায় এবং প্রকাশ করেন ভাষিক সারল্যে। এই কাব্যচেতনায় সুস্পষ্টরূপে বাঙালির প্রান্তিকজন উঠে আসে অবলীলায়।

এ-কথা আজ আর নতুন নয়, আমরা ইউরোপীয় আধুনিকতার স্পষ্ট প্রভাবে আধুনিকতার চর্চা করেছি। এজন্য মজনু শাহ্ তথা নব্বইয়ের কবিগণ স্বীয় ঐতিহ্যের শেকড় খুঁড়ে জাতির প্রকৃত বিকাশের ধারাক্রম রচনায় প্রয়াসী হয়েছেন। যা নিতান্তই আমাদের গৌরবগাঁথায় বিরচিত হবে অন্যের প্রভাবে নয়। মতিন রায়হান-এর ‘নৃতত্ত্ব সংবাদ’, ‘বৃক্ষের বিরুদ্ধে এক প্রেতিনীর ছায়া’, ‘বেহুলামঙ্গল : তিন’, ‘দাম্পত্য’ এবং ‘কবিতা বিষয়ক কয়েকটি স্কেচ’ কবিতা পাঁচটি নগরজীবনের বিষণœতার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছে। কবির প্রিয় বিষয় তথাকথিত নাগরিক সভ্যতার নামে স্বীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।

মতিন রায়হানের প্রেমও নাগরিক বিষণœতায় ছেঁয়ে গেছে। মাতিয়ার রাফায়েল-এর নির্বাচিত কবিতা ‘জঙ্গম সঙ্গম’, ‘বেবুনসংঘ’, ‘দূ-রে, বখাটে’, ‘আম বাগান’ এবং ‘ভয়’। কবিতাগুলোতে অবিমিশ্র নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা, প্রান্তজনের নিঃস্ব হওয়ার দুঃসংবাদ, নৈতিকতার বদলে সামাজিক আইন-কানুনের প্রতি অবিরাম বিবমিষা এবং ক্লেদক্লিষ্ট আকাশ সংস্কৃতির উন্মাতাল হাওয়ায় ভেসে যাওয়া বাঙালিকে স্বীয় ঐতিহ্যে ফিরে আসার আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে। মাতিয়ার রাফায়েলের কবিতায় ক্লেদক্লিষ্ট কামগন্ধী নগরজীবনের বেড়াজাল ডিঙিয়ে গ্রামীণ জনজীবনের প্রতি অনাবিল প্রশান্তির হাতছানি খুঁজে পাওয়া যায়। মারজুক রাসেল-এর কবিতা ‘মালের আড়ৎ’, ‘কবিতা কবিতা’, ‘ছায়াডাকা পাখিঢাকা’, ‘কয়েকটি খণ্ডচিত্র’ ও ‘প্রেমিকবৈশিষ্ট্য’।

মারজুক রাসেল এ্যাবসার্ডধর্মী এবং আধ্যাত্মিক চিন্তাচেতনার সাথে নগর-জীবনের কায়ক্লেশ, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না তথা প্রাত্যহিক ঘটনাবলি সহজ-সরল সাবলীল শব্দচয়নে তুলে ধরেন; তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু সরল প্রচ্ছন্নতায় প্রবিষ্ট হলেও অভিনিবেশী পাঠকের নিকট নিত্যদিনের যাপিত-জীবনের ক্যানভাস।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।