শাপলা। বাংলাদেশের জাতীয় ফুল। একে নতুন করে চিনিয়ে দেয়া বাহুল্য মাত্র। তবু নিজের হাতে তোলা কিছু ছবির কারণে একে নিয়ে একটা ব্লগ পোস্ট করার লোভ শামলাতে পারলাম না। আমাদের গাঁয়ে সর্বশেষ শাপলা দেখেছি বছর তিনেক আগে।
তার আগে কবে দেখেছি, সেটা স্মৃতি থেকে উবে গেছে। আমাদের গ্রামটা যেন আস্ত একটা দ্বীপ ছিল এক সময়। পূর্ব আর দক্ষিণ সীমানা দুটো বিল আর একটা দহ দিয়ে ঘেরা। উত্তরে একটা বাওড়। উত্তর-পশ্চিম আর পশ্চিমে ইছামতীর রাজত্ব।
এছাড়া বিশাল গ্রামটার বিশাল মাঠের এখানে সেখানে নিচু জলাভূমির অভাব নেই। তো এতগুলো জলাশয়ের জলধোয়া যে গ্রাম, সেখানে যে জলজ উদ্ভিদের অভয়ারণ্য থাকবে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নীলের হরষে যখন শরত কাঁপে, তালে তালে মনেহরী সাদা মেঘগুলো নাচে, ঝিরি ঝিরি বাতাসে দুলে দুলে ওঠে বিল-ঝিলের কালো জল, মাছেরা ঘাই মারে, তখন কচুরিপানা আর শেওলার দঙ্গল ভেদ করে উঁকি মারে শাপলা-কুঁড়ির দল। কিন্তু মানুষের অত্যাচারে এ দৃশ্য হারিয়েই গিয়েছিল। আশার কথা প্রকৃতির বদন্যতায় বছর তিনেক ধরে আবার ফিরে পেতে শুরু করেছে চিরচেনা সেই ছবি।
শাপলা জলজ উদ্ভিদ, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সামান্য পানি পেলেই এরা বংশ বিস্তার করতে পারে। সাধারণত বদ্ধ জলাশয়ে এদের বাস। হাওর, বাওড়, দহ, পুকুর এদের বংশবিস্তারের সহায়ক জলাশয়। খাল, নদ-নদী’র মতো প্রবাহমান জলাশয়ে এরা বাস করতে পারে না।
শাপলা গাছের নির্দিষ্ট কোনো উচ্চতা নেই। মূলত জলাশয়ের পানির গভীরতাই এদের উচ্চতা নির্ধারণ করে দেয়। এরা কচুরিপানার মতো ভাসমান উদ্ভিদ নয়। এদের শেকড় প্রোথিত থাকে জলাশয়ের তলদেশের মাটিতে। চারা জন্মানোর পর পানির সাথে পাল্লা দিয়ে এদের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়।
শাপলার পাতা পানিতে ভেসে থাকে। ফুল ফোটে পানির উপরিতল থেকে ৬-৮ ইঞ্চি ওপরে। পানির গভীরতার ওপর নির্ভর করে শাপলা গাছ ১ থেকে ৫ ফুট পর্যন্তু উঁচু হতে পারে।
লম্বা-নরম বোঁটার (ডাঁটা) সাহায্যে শাপলার পাতা সরাসরি পানির উপরি তলে ভেসে থাকে। বোঁটা গজায় একেবারে শেকড় থেকে।
শাপালার আলাদা কোনো কাণ্ড বা শাখা প্রশাখা নেই। মূলত পাতার বোঁটায় একাধারে কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখার অভাব ঘুঁচিয়ে দেয়। প্রতিটা শাপলা গাছের শেকড় থেকে ৮-১০টা ডাঁটা বের হয়।
শাপলার পাতা বৃত্তাকার। বেশ বড় হয়, বড়সড় একটা থালার মতো।
পাতা পুরু। দেখতে অনেকটা পদ্মপাতার মতো, তবে পদ্ম পাতার চেয়ে কিছুটা ছোট, অত মসৃণও নয়, পরুত্বও খানিকটা কম। পাতা ও বোঁটার সংযোগস্থলটা চেরা। পাতার কিনার খাঁজকাটা, রং গাঢ় সবুজ।
বাংলাদেশে তিন প্রকার শাপলা দেখা যায়।
নীল, সাদা আর গোলাপি। ঢাকার কাঁচা বাজারগুলোতে যত্রতত্র গোলাপি শাপলা দেখা যায়। কিন্তু আমাদের গ্রামে গরুখোঁজা করেও গোলাপি শাপলার দেখা পেলাম না। তবে নীল আর সাদা শাপলা পেলাম প্রচুর। ওপরের ছবিটা নীল শাপলার।
বাংলাদেশেল যেটা জাতীয় ফুল, সেটা কিন্তু সাদা শাপলা। গ্রামে সাদা শাপলার প্রাচু্র্য সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অলসতার কারণে জলাশয় থেকে সাদা শাপলার ছবি তুলেতে পারিনি। সাদা শাপলা ফোটে খুব ভোরে। রোদ উঠতে উঠতে লজ্জাবতী রমণীর মতো সবুজ পাঁপড়ির ঘোমটায় মুখ ঢেকে ফেলে।
অত সকালে ঘুম থেকে ওঠা আবার আমার অভ্যাসের বাইরে। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হলো। বেশকিছু শাপলা কুঁড়ি তুলে এণে বোতলের পানিতে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। পরদিন সকালে দেখি দলমেলে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে। তারই একটা ক্যামেরাবন্দি করে ফেললাম।
শাপলা কুঁড়ির সৌন্দর্য কম নয়। জলাশয়ের সারি সারি শাপলা কুঁড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, নয়নচেয়ে দেখবার মতো সৌন্দর্যে অবতারণা হয় তখন। শাপলা কুঁড়ি কিন্তু একবারে ছোট নয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফুল-কুঁড়ির মধ্যে শাপলার কুঁড়িকে ফেলা যায়। পদ্ম ফুলের কুঁড়ি অবশ্য শাপলার চেয়ে বড়।
তবে শাপলার কুঁড়ি শিমুল কিংবা কুমড়ো ফুলের কুঁড়ির চেয়েও বড়। শাপলা কুঁড়ি ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা হয়। শাপলা-কুড়ির বাইরের অংশটা সবুজ পাঁপড়ি দিয়ে ঢাকা থাকে। শাপলার পুষ্প মঞ্জরি সরল। একপুষ্পক।
পাতার মতই একটা লম্বা ডাঁটার মাথায় শাপলা ফুল ফোটে। এই ডাঁটা পাতার ডাঁটার সমানই লম্বা হয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশ শাপলা ফুলের বোঁটা বা ডাঁটা তরকারী হিসেবে খায়।
শাপলা ফুলের ব্যাস ৩-৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। সাদা, নীল ও গোলাপি--তিন জাতর ফুলের আকারে অবশ্য ভিন্নতা আছে।
শাপলা ফুলের পাঁপড়িগুলো তিনটা স্তরে সাজানো থাকে। পাঁপড়িগুলোর মাঝখানে থাকে কমলা-হলুদ রংয়ের পুষ্পকিশোর থাকে।
শাপলা ফুলে তিন স্তরে মোট ১৮ টি পাঁপড়ি থাকে। প্রথম স্তরে ৫টা, ২য় বা মাঝের স্তরে ৬ টা এবং ৩য় বা বাইরের স্তরে ৭টা পাঁপড়ি থাকে। সাদা শাপলার প্রথম ও ২য় স্তরে সাদা রংয়ের পাঁপড়ি থাকে, বাইরের স্তরের পাঁপড়িগুলোর ভেতরের পিঠ সাদা এবং বাইরের পিঠ হলুদ ডোরাকাট ওয়ালা সবুজ রংয়ের।
নীল শাপলার বাইরের ১ম ও ২য় স্তরের পাঁপড়িগুলো নীলচে-সাদা রংয়ের। তবে বাইরের পাঁপড়িগুলো সাদা শাপলার মতই।
ছবি: সামহোয়ার ইন ব্লগ ডট কম
শাপলা ফুল দেথতে যতটা সুন্দর, এর ফল দেখতে ততটাই বিদঘুটে। গোলাকার এই ফল সম্পর্কে আমি আর একটা বাক্যও খরচ করব না, নিজ দায়িত্বে ওপরের ছবি থেকে বুঝে নিন।
ছবি: সামহোয়ার ইন ব্লগ ডট কম
শাপলা ফুলের বীজ দেখতে অনেকটা সরিষা বীজের মতো।
ফলের খোসা ছাড়ালেই দেখা যায়ে এর ভেতর সাজানো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অজস্র বীজ। বীজগুলো সাজানোর সুবিদার্থে ফলের ভেতর মণ্ডের মতো শাঁস। শাঁস সাদা রংয়ের আর বীজের রং বাদামী।
শাপলা ফুলের ইংরেজি নাম Water lily। বৈজ্ঞানিক নাম Nymphaea nouchali।
এই সিরিজের অন্য পোস্টগুলো—
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১ : শিয়ালকাঁটা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-২ : ভাঁটফুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৩ : কালকসুন্দা / কালকসিন্দা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৪ : আকন্দ
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৫ : আশশেওড়া
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৬: কচুরিপানা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৭ : বৈঁচি
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৮ : শেওড়া
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-৯ : শিমুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১০ : ভেরেণ্ডা / কচা
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১১ : হাতিশুঁড়
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১২ : বট
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১৩: শিয়াকুল
বাংলার গুল্ম-তরু-লতা-১৪ : বাঁশ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।