১
পাহাড়ি পথ বলেই হয়তো ট্রেনটা কেমন যেন দুলে দুলে চলছিল। দুপাশ ঘেরা উঁচু নীচু টিলায়। শেষ বিকেলের আলোয় ঝকমক করছিলো চা-গাছের পাতাগুলি। কিছুক্ষণ আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায়, বাতাসে মাটির সোঁদা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেও নীরা ডুবে ছিল অন্য ভাবনায়।
চা-বাগানে যাবার আইডিয়াটা তারই। ভেবেছিল রুনি আর সাজ্জাদ নিজেদের মতো করে একটু মিশুক; বিয়ের কথাটা ফাইনাল হয়ে যাক।
এ দুজনকে সাথে মিলিয়ে দেবার ইচ্ছাটা তার অনেক দিনের। বাইরে থাকায় এ নিয়ে আর এগুতে পারেনি। এবার ফিরেছে ছ'মাসের জন্য; এবারই সুযোগ।
না হলে রুনিকে আর বিয়েতেই রাজী করানো যাবেনা। ক্রিমিনোলজিতে পি এইচ ডি করতে চাইছে সে; সেটায় একবার আটকে গেলে হয়তো বিয়েই করবে না কখনো। বিপত্মীক হলেও বিয়ের বাজারে সাজ্জাদের কদর বেশ। স্বচ্ছল, সুদর্শন, খুবই অমায়িক; এমন পাত্র জোটা মুশকিল বৈকি। রুনিও কম কিছু নয়।
শুধু.....।
ভাবনায় ছেদ পড়লো শাহেদের ডাকে।
" নীরু, সবকিছু গুছিয়ে নাও। আর বেশি একটা দেরী নেই। পরে তাড়াহুরো লেগে যাবে।
" -শাহেদের গলার সূরে ব্যস্ততা।
নীরা শাহেদকে দেখলো। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, সে কি হীনমন্যতায় ভুগে? বিয়ের পর সে শাহেদকে ইমিগ্র্যান্ট করে নিয়ে গেছে, পড়িয়েছি; সবেমাত্র একটা চাকরীতে ঢুকেছে, তাও নীরার সুপারিশে। মেয়ে কলিগরা নীরার স্বামীভাগ্যে খুব ইর্ষান্বিত। ছেলেগুলি আড়ালে ডাকে স্ত্রৈণ্য।
তার, মাঝে মাঝে মনে হয় শাহেদ এতটা কৃতজ্ঞতা না দেখালেও পারে। কোথায় যেন একটা মেকী ভাব আছে।
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নীরা ব্যাগ গুছাতে বসলো।
২
এই বাংলোটা অফিসার্স কোয়ার্টারগুলির একদম শেষ প্রান্তে। লাল খোয়ার রাস্তাটা, এর গেটে এসেই থেমে গেছে।
কিছুটা চূড়ার মতো জায়গা। এর পরপরই টিলাটা ঝপ করে নেমে গেছে কয়েকশ ফিট। ঝুলানো বারান্দায় দাড়ালে মনে হয় যেন ভাসছি।
সিগারেট টা হাতে নিয়ে সাজ্জাদ বারান্দায় দাড়িয়ে। আজ অনেক বছর পর শাহেদের সাথে দেখা তার।
ভার্সিটিতে অনু, শাহেদ আর সাজ্জাদ এক ব্যাচেই ছিল। অনু আর শাহেদ ছিল তাদের ইয়ারের প্রথম জুটি। কিন্তু অনুর প্রতি তার দূর্বলতার কথা কারোই অজানা ছিল না। মুখ ফুটে কখনো দাবী নিয়ে দাড়ানোর কথা সে কখনোই ভাবেনি; দুজনেই ছিল তার খুব কাছের মানুষ। অনুকে বিয়ে করাটা তাই, তার জন্য ছিল স্বপ্নের মতো!
তখনও জানা ছিল না, স্বপ্নরাও একদিন..........
"অদ্ভুত শান্তি জায়গাটায়!!"- রুনীর কিন্নর কন্ঠ যেন কাঁচের চুড়ির মতো।
হঠাৎ নির্জনতা ভাঙ্গায় একটু চমকে গেলো সাজ্জাদ।
কে বলবে একটু ভারী গড়নের কোমল মুখের এই মেয়েটা এতো কঠিন হতে পারে! কিশোরী মায়ার স্বপ্ন দেখা শেষ না হতেই পাশবিক থাবায় যার জীবনটা প্রায় তছনছ হয়ে পড়েছিল। তারপরেও দৃঢ়তা নিয়ে লড়েছে সমাজের সাথে, আদালতে, পশুদের চিনিয়ে দিতে। উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এক মুহুর্তের জন্যও থামেনি তার যুদ্ধ থেকে। তার ছোট শহরের সবাই তাকে চিনে।
কিন্তু ভালবাসার হাত বাড়িয়ে কেউ পাশে দাড়ানোর সৎসাহস করে উঠতে পারেনি কখনো।
'এই জায়গাটা দেখেই কিন্তু চাকরিটা নিয়েছিলাম"- স্মিত হাসি সাজ্জাদের মুখে।
"আচ্ছা, অনু ভাবি এখানে থাকতে চাইতো না কেন?"
"নির্জনতা ওর খুব অপছন্দ ছিল। দু/তিনদিন থাকলেই অস্থির হয়ে পড়তো। একবার যখন ঠিক করতো ঢাকা ফিরবো; কোন কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারতো না।
সেইদিনও তো জোর করে ঝড় বৃষ্টির ভেতর....."- সাজ্জাদের গলাটা ভেজা শোনালো।
রুনি আর কিছু বল্লো না।
অমাবস্যার আঁধারে আকাশে তারাদের মিছিল বসেছে যেন। সাজ্জাদ সেদিকে তাকিয়েই বুঝি কিছু একটা দেখছিল।
"আচ্ছা, আপনি কি প্ল্যানচেটের কথা শুনেছেন?"
হঠাৎ এমন প্রশ্নে সজ্জাদ ভাবনার রেশ হারিয়ে ফেললো।
"ইয়ে, তেমন একটা না। কেন বলোতো?!" - বিস্ময়ের রেশ গলায়।
"আজকেতো অমাবস্যার রাত। আমি ভাবছি প্ল্যানচ্যাট করে আমাদের ভবিষ্যত জেনে নেবো!"
রুনির প্রগলভ কন্ঠে কিছুটা কিশোরী চপলতা মাখানো।
"জানেন তো? প্ল্যানচ্যাটে যদি কোন আত্মার দেখা পাওয়া যায়, সে ইচ্ছে করলেই জানিয়ে দিতে পারে যে কারো ভবিষ্যত।
"
রুনি কি হাসি চাপছে?! আঁধারে কিছুটা বিভ্রম হলো।
সাজ্জাদও কিছুটা তরল গলায় জবাব দিল-
"বেশতো, চলো দেখা যাক, আগে ভাগে জেনে গেলে মন্দ কি? "
ভেতর থেকে একটা হারিক্যান এনে রাখলো কে যেন। সেই আলোতে রুনীর মুখখানি অনেক মায়াকাড়া লাগলো সাজ্জাদের কাছে।
বারান্দার রেলিং এর পাশে চকিতে সরে যাওয়া ছায়াটা দুজনেরই নজর এড়িয়ে গেলো।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।