পরে
কেন যে লোকটা এই কথা বলে উঠেছিল কে জানে। সন্ধ্যাবেলা আমি বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম খুব মাথা ধরেছিল বলে। বাইরে একটা ভেজা ভেজা ভাব। ভাবলাম এর মধ্যে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করলে মাথা পরিষ্কার হয়ে যাবে। জিগাতলা পোস্টঅফিস মোড়ের উৎকট দুর্গন্ধ উপেক্ষা করে এগুতে লাগলাম।
জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড মোড়ে বেশকিছু রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে সবসময়। এমন কয়েকটি রিকশাকে পাশ কাটানোর সময় কথাটা কানে আসল। এক রিকশাঅলা বলছে আরেকজনকে। 'আসুক, বৃষ্টি আসুক। আইসা সব উল্টায়া পাল্টায়া দেক!' আমি শিউরে উঠলাম।
কী বলে কী লোকটা! কোনো কবি টবি নয়তো! আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখি।
আহ, বৃষ্টি সব উল্টায়া পাল্টায়া দিক। গাড়িগুলো রাস্তা হারিয়ে ফেলুক। ট্রাফিক পুলিশ ভুল করুক সিগন্যালে। আমি জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডের উল্টোপাশে নেসক্যাফেতে কফি কিনে, ধানমন্ডি লেক ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই আমার শৈশবে, রংপুরে।
আমার নানিবাড়ির চলতে ওঠা টিনের চালে ঝমঝম করে বর্ষা নামুক। ভর-ভরন্ত দুপুরে রংপুরের আকাশে কী মিশমিশে কালি! যেন জিগাতলার সন্ধ্যা ভর করেছে রংপুরকে! আমার খালামনির ছোট্ট অডিও প্লেয়ার, ন্যাশনাল প্যানাসনিক। সেখানে লতা মুঙ্গেশকর তার অভাবনীয় মিষ্টতায় গেয়ে উঠুক, বৃষ্টি-বৃষ্টি-বৃষ্টি, তুমি কোন অপরূপ সৃষ্টি, মিষ্টি কী যে মিষ্টি, আজ হারিয়ে গেছে দৃষ্টি...। সেই গাঢ় অন্ধকারে দুই ঘরের ছোট্ট সে বাসার মাটির বারান্দায় জল ছুঁই ছুঁই। আর জানালার শিক গলে বাইরে তাকিয়ে দেখি, চারদিকে জল থই থই।
একটু বৃষ্টিতেই জায়গাটাতে পানি জমে যেত। ভদ্র পাড়ার পাশেই ছিল বেদেপাড়া। তাদের বলা হতো 'বাদিয়া'। আমরা তাদের দিকে ঘৃণা নিয়ে তাকাতাম। কারণ তারা পশুর চামড়া ছেলে, গরু ছাগলের লেজ খায়।
নানির কড়া বারণ ছিল, বাদিয়াদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। বাদিয়ারা অবশ্য কথা বলত কম, গালিগালাজ করত বেশি। আমার নানিবাড়ির চারপাশের থই থই জলে বাদিয়ারা গামছা পড়ে, কলাগাছ নিয়ে নেমে পড়ত। একটা কলাগাছের ওপর উঠে, একজন একজন করে, শৈশবের প্রবল উল্লাসে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত জলে! গালি দিতে দিতে আরেকজন গিয়ে উঠত কলাগাছে। কলাগাছে ওঠাটা মোটেই সহজ ছিল না।
পিছলে পিছলে পড়ে যেতে হতো। তারপরও কী আনন্দ নিয়ে একেকজন কাজটা করত! পানিতে পড়ে গিয়ে হাত দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে গালিগালাজ করতে করতে হেসে গড়িয়ে পরত বাদিয়া শিশুরা। ঝরঝর করে নেমে আসা বৃষ্টি তাদের কালো কালো পিচ্ছিল ত্বক বেয়ে চুঁয়ে পড়ত। আর জংধরা জানালার শিকের আরেকপাশে আমি সতর্ক চোখে তাকাতাম। আমি আমার ভেতর ইচ্ছা তৈরি হতে দিতাম না।
আমি যেন নিশ্চিত হয়েই থাকতাম, আমার কখনো গা ডোবানো হবে না ওই নোংরা জলে, যে জল স্পর্শ করে সেইসব নোংরা শরীরকে। ছাদে উঠলে মানুষের একটা অনুভূতি হয় না, পা কেমন যেনো শিরশির করে লাফ দেওয়ার জন্য – আমারও তেমন একটা কিছু হতো হয়তো। কলাগাছ থেকে লাফ দেওয়া দুরন্ত শৈশব আমারও পেতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু বহু আগেই আমার রক্তে একটা বারণ গুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই শৈশব তোমার নয়।
তোমার শৈশব টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টি শুনতে শুনতে বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থাকে। কারণ তোমাকে টিচারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতে হয়। বৃষ্টি তোমার কাছে গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া আকাশ আর থামবার অপেক্ষা। সেই প্রতীক্ষায় আবহ হিসাবে 'বৃষ্টি, বৃষ্টি...' গানটা বাজতে থাকে, একটানা।
এদিকে জিগাতলা বাসস্ট্যান্ডেও সবকিছু 'উল্টায়া পাল্টায়া' যায় না।
ধান্মন্ডি লেকের ওপর একটা নির্বিকার অন্ধকার নামে। কাঁপতে কাঁপতে লেকের জল এসে ছোঁয় আবর্জনা ছড়ানো কিনারগুলো। অন্ধকারেরও একরকম প্রতিফলন আছে। আমি তেমন কিছুই খেয়াল করি লেকের জলে। লোহার শীতল রেলিংয়ে হাত রেখে আমার বিষণ্নতার অনুভূতি হয়।
কী বিষণ্ন সময়! বিখ্যাত এক ফরাসি দার্শনিকের একটা লেখার কথা মনে আসে, যেখানে একটা আধো অন্ধকার ঘরে পিং পং বলের মতো বাড়ি খায় সময়, এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে। আমার মনে হয় আমাকে যেন এই আর্দ্র সন্ধ্যা হাত ধরে টানে। কোথায় নিয়ে যেতে চায় সে আমাকে? আমি জানি তো, কোথায় তার শেষ, কী আছে শেষে। এই যে লেক, এর এ পারেও কঙ্ক্রীট, কঙ্ক্রীট ওপারেও। কঙ্ক্রীটের ফাঁক গলে কিছু গাছ মাথা বের করে দিয়েছে ।
কিন্তু তারা বড্ড অসহায় উদ্ভিদ। তাদেরকে দেখলে মৃত্যুর করুণার কথা মনে আসে; জীবনের আত্মসমর্পণের কথা। এই রকম অনেক সন্ধ্যা আমি দেখেছি, এসব সন্ধ্যায় কোনো এক অজানা কারণে গাছগুলো আরো বেশি মন খারাপ করে থাকে। সুতরাং এই সন্ধ্যার খপ্পর থেকে আমি একরকম রেহাই পেতে চাই। এমন সময় কয়েকটা বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ে আমার ঘাড়ে।
আমি সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই, পালিয়ে বাঁচতে চাই। এ ধরনের বড় বড় ফোঁটারা খুব বিপদজনক। কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আগেই রাইফেলস স্কোয়ারের সিঁড়িতে আশ্রয় নিতে হবে। সেদিকে এগুতে এগুতে ভাবি, এবারও বৃষ্টি কোনো কিছুই উল্টে দিতে পারল না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।