বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
হাসন রাজারে কে বাউলা বানাল? জীবনভর এই প্রশ্নটি নিয়ে বিব্রত থেকেছেন হাসন রাজা। জীবনভর মাটির পিনজিরার ভিতর মনময়নার ছটপটানি টের পেয়েছেন। লোকে যখন বলল: তোমার বাড়িঘর ভালো না হাছন-তখন হাসন প্রশ্ন করেছেন-কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার ...জীবনভর প্রশ্ন করেছেন- কানাই খেইড় খেলাও কেনে/ রঙ্গের রঙ্গিলা কানাই/খেইড় খেলাও কেনে।
ভাবলে অবাক লাগে-হাসন রাজার মৃত্যু ১৯২২ সালে। কথাটা এই জন্য বলা হাসনের গান শুনলে মনে হয় গানগুলি অত পুরনো নয়-সাম্প্রতিক।
নিশা লাগিল রে,
বাঁকা দু নয়নে নিশা লাগিল রে।
বাংলা এইভাবেই আবহমান। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষনে বলেছিলেন,‘পূর্ববঙ্গের একজন গ্রাম্য কবির গানে দর্শনের একটি বড় তত্ত্ব পাই।
সেটি এই যে, ব্যাক্তিসরুপের সহিত সম্বন্ধসূত্রই বিশ্ব সত্য’।
‘ব্যাক্তিসরুপের সহিত সম্বন্ধসূত্রই বিশ্ব সত্য’। হাসনের গানে এই সত্যটি প্রতিফলিত।
উড়িয়া যাইব শুয়া পাখি পড়িয়া রইব কায়া
কিসের দেশ কিসের বেশ কিসের মায়া দয়া ।
নেত্রকোণার উকিল মুনশীর গানেও শুয়া চান পাখির কথা আছে।
শুয়া চান পাখি আমার শুয়া চান পাখি
এক ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি?
সম্ভবত, শুয়া পাখি জীবনের প্রতীক। জীবন শেষ হয়ে গেলে পড়ে রইবে কেবল স্মৃতি। হাসন সেই কথাই বলছেন। এই শুয়া পাখিই আবার হাসনের মন-ময়না।
মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে
কান্দে হাসন রাজার মনময়নায় রে।
হাসন রাজার পুরো নাম দেওয়ান হাসন রাজা। জন্ম ১৮৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে। সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী (লখনছিড়ি) গ্রামের জমিদার পরিবারে। হাসন রাজার পূর্বপুরুষ অযোধ্যায় বাস করতেন এবং তারা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী । পরে পরিবারটি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে সুনামগঞ্জ আসেন এবং সেকানেই স্থায়িভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।
হাসন রাজার পিতার নাম পিতার নাম দেওয়ান আলী রজা চৌধুরী।
স্কুলকলেজে পড়েন নি হাসন। তৎকালীন সময়ে পূর্ববঙ্গের কুলিন পরিবারের সন্তানেরা কোলকাতায় বাড়িভাড়া করে লেখাপড়া শিখত। হাসনের ক্ষেত্রে সেরকম হয়নি। এত বড় দার্শনিক-স্কুলকলেজে কী শিখবেন! যা হোক।
হাসনের পনেরো বছর বয়েসে হাসনের বাবা মারা যান। সংসার ও জমিদারি দেখা শোনার দায়িত্ব হাসনের উপর এসে পড়ে। খানিক কি উদাসীন ছিলেন হাসন? কেননা, ততদিনে বুঝে গিয়েছিলেন-
মায়ে বাপে করলা বন্দি খুশির মাঝারে
লালে ধলায় হইলা বন্দি পিনজিরার মাজারে।
হাসনের কাছে জীবন ও জগৎ ‘খুশির মাঝার’। বিষয়টি আকস্মিক নয়।
বাংলার বাউলেরা সব জগৎপ্রেমী-জগতে এত দুঃখকষ্ট সত্ত্বেও। ঐ একই গানের অন্য রুপ-
মায়ে বাপে বন্দি হইল কুটির মাঝারে
লালে দোলায় বন্দি হইল পিঞ্জিরার মাঝারে।
মা -বাবা মিলিত হল। তারপর আমাকে লাল-সাদা জগতে বন্দি করল? লাল-সাদা জগতে সুখ থাকলেও স্বস্তি নেই। প্রাপ্তির আনন্দ থাকলে আছে - হারানোর আশঙ্কা।
এই নিদারুন সত্যটি ততদিনে বুঝে গিয়েছিলেন হাসন-তাই বলছিলাম: খানিক কি উদাসীন ছিলেন হাসন?
শোনা যায়-যৌবনে সৌখিন ও বিলাসী ছিলেন হাসন। মদ ও কামে মজেছিলেন। তার কৈফিয়তও দিয়েছিলেন।
আমিই মুল নাগর রে।
আসিয়াছি খেউড় খেলিতে, ভব সাগরে রে।
আমি রাধা, আমি কানু, আমি শিবশঙ্করী।
অধর চাঁদ হই আমি, আমি গৌর হরি।
অতি গভীর কথা!
হাসনের একটি জনপ্রিয় গান-
নিশা লাগিল রে
বাঁকা দু নয়নে নিশা লাগিল রে
হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিল রে।
পিয়ারী কে? কোনও নারী? জানি, হাসনগবেষকগন জানেন পিয়ারী কে। আমি অন্যভাবে দেখতে চাইছি ব্যাপারটা।
এ গানটি সম্ভবত হাসনের যৌবনপর্বের গান। কিন্তু, কে পিয়ারী? কোনও নারী? ‘হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিল রে। ’ মদ ও কামে মজে থেকেও কেবল একজনকে ভালো লাগল? হাসনের অন্য একটি গানে আছে-
রূপের ঝলক দেখিয়া তার আমি হইলাম কানা। (কার পিয়ারীর?)
সেই অবধি লাগল আমার শ্যাম পিরীতির টানা। (শ্যাম=কৃষ্ণ)
হাসন রাজা হইল পাগল লোকের হইল জানা।
নাচে নাচে তালে তালে আগে গায় গানা।
শেষ দুটি চরণই বলে দিচ্ছে পিয়ারী ঠিক জাগতিক প্রেমবস্তু নয়-বরং এমন কিছু -যাকে দেখলে পাগল হয়ে যেতে হয় আর নেচে নেচে তালে তালে গান গাইতে হয়।
যাক। মদে কামে ডুবে থেকেও একদিন গেয়ে উঠলেন হাসন-
বাউলা কে বানাইল রে হাসন রাজারে।
বানাইল বানাইল বাউলা কার নাম হইতে মৌলা
দেখিয়া তার রুপের ছটক হাসন রাজা হইল বাউলা।
(কার? পিয়ারীর?)
হাসন রাজা হইছে পাগল প্রাণবন্দে কারণে। (কে প্রাণের বন্ধু? পিয়ারী?)
বন্ধু বিণে হাসন রাজায় মন যে নাহি মানে।
হাসন রাজা গাইছে গান হাতে তালি দিয়া
সাক্ষাতে দাঁড়াইয়া শোনে হাসন রাজার বিয়া। (বেশ দূরুহ লাইন ...)
এই গানের পর কি আর সংসারে মন টেকে? বিষয়সম্পত্তি সব বিলিবন্টন করে হাসনের বাউলা জীবনের শুরু। কেননা-
ভালা করি ঘর বানায়া কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকন্ াচুল আমার।
লখনছিড়িতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেন হাসন। মেধাবী ছাত্রদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
হাসন রাজায় কয় আমি কিছু নয় আমি কিছু নয়
অন্তরে বাহিরে দেখি কেবল দয়াময়।
ভিতর থেকে গান আসছিল। একের পর এক।
সে গান শুনত লোকে। দূরদূরান্ত থেকে এসে শুনত। আর সে কী গান। বাউলের জীবনদর্শন এমন সুরেলা ও ছান্দিক প্রকাশ।
লোকে বলে/ বলে রে/ ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার।
কি ঘর বানাইমু আমি/ শূন্যেরই মাঝার।
লোকে হাসনের গান অবশ হয়ে শুনত। কেউ কেউ গানের বই বের কথার কথাও বলল। গানের বই প্রকাশ করলেন হাসন। হাছন উদাস (১৯০৭) শৌখিন বাহার, হাছন বাহার।
ভারি আল্লাভক্ত ছিলেন হাসন।
আমি যাইমুরে যাইমু আল্লার সঙ্গে
হাছন রাজায় আল্লাবিনে কিছু নাহি মাঙ্গে।
রাধাকৃষ্ণর লীলা নিয়েও গান করলেন।
কেন আইলাম না রে, রাধার কালাচান্দ।
বাঁশীটি বাজাইয়া আমার লইয়া যাও পরাণ।
কালী মায়ের কথাও উঠে এসেছে হাসনের গানে।
ওমা কালী, কালী গো, এতনা ভঙ্গিমা জান।
কত রঙ্গ ঢঙ্গ করা যা ইচ্ছা হয় মন।
মাগো স্বামীর বুকে পা দেও মা ক্রোদ্ধ হইলে রণ।
কৃষ্ণরুপে প্রেমভাবে মামীর বসন টান।
এভাবেই বাংলার গানের গুরুরা অসাম্প্রদায়িক । সেকথা আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই এই লেখা। আবহমান বাংলার সংস্কৃতি বিন্দুমাত্র হৃদয়ে গ্রহন করলে সাম্প্রদায়িক হওয়া যায় না। তাছাড়া, বাংলার সংস্কৃতির একটা অটুটু ঐক্যও আছে। রবীন্দ্রনাথ, লালন ও হাসন-উভয়কেই বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন।
হাসনের মৃত্যু ১৯২২ সালের ৭ ডিসেম্বর।
চলেন আসছে শীতে সুনামগঞ্জের লখনছিড়ি যাই। শুনেছি, হাসনের ঘরবাড়ির দৈন্যদশা। (এই নিয়ে কিছুদিন আগে ব্লগে একটা লেখা পড়েছি)। লখনছিড়িতে হাসনের বাড়িঘরের বেহাল অবস্থা।
আসলে এ আমাদেরই মন ও বিবেকের দৈন্যদশা। শুনেছি, সিলেটে শ্রীচৈতন্যদেবে পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি পুড়িয়ে দিয়েছে বছর কয়েক আগে। হাসনের গানগুলি ইন্টারনেটে রয়েছে। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতে সে গান পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হবে। সে গান ভবিষ্যত প্রজন্ম (আপনাদেরই ছেলেমেয়ে) জানবে।
তারা কেউ কেউ লখনছিড়ির তীর্থে যেতে চাইবে। তারপর তারা লখনছিড়ি পৌঁছে যা দেখবে-দেখে আমাদের বিবেকের দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করবে। ছিঃ, আপনারা!
গানের সূত্র: লোকগীতি। ই-সংকলন: সুদীপ্ত মূখার্জী, সোমেন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য্য।
তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়ায় তসিকুল ইসলামের লেখা একটি নিবন্ধ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।