আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আঙুলের ছাপ

কেবলই নিজেকে খুঁজছি

ঘরে ফিরে শিউলি ছোট্ট ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়ালো। মুখে লেপটানো লিপস্টিক। কপালের ওপর এলোমেলো চুল। এই ঘন কুয়াশাছন্ন তীব্র শীতের রাতেও শিউলির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। অধর বেয়ে এলোমেলো ধারায় বইছে অশ্রু।

বুক ঘন ঘন ওঠানামা করছে। নিজের চেহারার প্রতি এমন বিরক্তিকর চাহনি, যেন এই চেহারা তার নয়। আয়না থেকে মুখ সরিয়ে ওড়নায় মুখ গুজলো শিউলি। ডুকরে কেঁদে উঠে আবার সহসাই থেমে গেল। টিনের কলস থেকে মগে জল ঢেলে ঘরের বাইরে গেল।

বরফের মতো ঠান্ডা জল তবু বারবার মুখে জলের ঝাপটা দিল। ওয়াক তুললো বার দুই কিন্তু বমি হলো না। কুলিকুচি করে ঘাড় গলা জল দিয়ে ধুয়ে ঘরে এসে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো। গামছা দিয়ে মুখ মুছে বারবার নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালো। এখন কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

হয়তো কেউ বুঝতে পারবে না, জানতেও পারবে না কোনদিন। কিন্তু তার মন থেকে কি মুছে যাবে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা! না, তা মুছবে না। একটু আগেই তার মনে যে কালির দাঁগ পড়েছে তা কোনদিন মুছবে না। বিছানায় বসে শিউলি আবার কেঁদে উঠলো। বিছানায় ঘুমানো শিউলির তিন বছরের ছোট ভাই সুজন হঠাৎ জেগে উঠে সেও শিউলির সঙ্গে কাঁন্নায় যোগ দিল।

শিউলির মা সাবিনা ঘরে ঢুকে ক্রন্দনরত ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে শিউলির কাঁধে চাপ দিয়ে বললো, তোর আবার হলো? ব্যাথা পাইছিস নাকি? শিউলি মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বললো, আমি আর এই জায়গায় থাকপো না মা। আমি নানা বাড়ি চলি যাব। দরকার হলি মানুষের বাড়ি কাজ করি খাব। সালমা বিরক্তির ঢঙে বললো, ইস, নানা বাড়ি মনে হয় তোমার জন্যে সব রান্ধা ভাত নিয়ে বসে আছে। কিছু হলিই নানা বাড়ি যাব, নানা বাড়ি যাব এক গান।

কি অয়ছে তাই কও। কাঁন্না জড়ানো গলায় শিউলি বললো, ঘরে আসার সময় রফিক ভাই আমার বুকে হাত দিয়ে মুখে চুমু খাইছে। ইস! তাতে তোমার শরীর জব্বর য় হইছে! মরা কান্না জুড়ে দিছ। দুদিন পর যে শুতি হবি তখন কি করবি লো মাগি! শিউলি মায়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার চোখে মুখে চকচক করে উঠলো ঘৃনা।

তবু ঘৃনায় চকচকে চোখ দুটিই ঝাপসা হয়ে আসে। কষ্টে। শিউলি আর কিছুই বললো না। বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো লেপ গায়ে দিয়ে। চোখে ঘুম আসে না।

শুধু লেপের কাভারে চোখের জল মোছে। এই জীবন থেকে সে মুক্তি চায়। নানা চিন্তা তার মাথায় ভর করে। পালিয়ে যাবার চিন্তাও তার মাথায় আসে। কিন্তু কোথায় পালাবে সে! কোথায় থাকবে? কি খাবে? এখানে তো তবু খাবারটুকু জুটছে।

নানা বাড়ির দিনগুলোর কথা মনে পড়ে শিউলির। কত আনন্দেই না কাটে দিনগুলো! অভাব সেখানেও থাকে। মাঝে মাঝে মামির মুখ ঝামটাও খেতে হয়। তবুও সেখানকার দিনগুলোয় স্বাধীনতার আনন্দ থাকে। রাবেয়া, মলিনা, বিনাদের সঙ্গে গল্প করে সময় কাঁটানো যায়।

শুধু কষ্ট লাগে তখন, যখন রাবেয়ারা সকাল হলেই বই হাতে ছোটে আর সে ঝাড়ু নিয়ে মামা বাড়ির লম্বা উঠোন পরিষ্কার করে। রাবেয়া, মলিনাদের মতো শিউলিরও ইচ্ছে করে স্কুলে যেতে। যদিও স্কুলে যাবার বয়স অনেক আগেই সে পেরিয়ে এসেছে। রাবেয়া-মলিনারা স্কুল থেকে ফিরলেই শিউলি ওদের বাড়িতে যায়। আবার কোন কোনদিন ওরাই আসে।

কত গল্প হয় ওদের সঙ্গে। শিউলি ওদের কাছে স্কুলের গল্প শোনে। ওরাও শিউলির কাছে সার্কাসের গল্প শোনে। শিউলির সার্কাসের গল্প বলতে ভাল লাগে না। তবু ওরা শোনার জন্য জোরাজুরি করে বলে শোনাতে হয়।

ওরা বেশ মজা পায় শুনে। রাবেয়াদের জীবনের জীবনের কথা মনে হলেই শিউলির চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। এবার তেরো বছরের বাতাস লাগতে শুরু করেছে তার শরীরে। শরীরও হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। এখন সে মানুষের চোখে পড়ে।

উঠতি বয়সের ছেলে-ছোকরা থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষও তাকে দেখে। বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে। কি মধু আছে এই বুক দুটোয় কে জানে! সেও মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের নগ্ন বুক দুটো দেখে। আগের চেয়ে একটু বড় হয়েছে আর রঙটা একটু পাল্টেছে এই যা। এ আবার অমন চোখ দিয়ে চেটে দেখার কি আছে! তবে এটুকু বুঝতে পারে শিউলি, এই দুটোর প্রতি পুরুষের অনেক লোভ।

আজ সেটা আরও ভালভাবে বুঝতে পেরেছে। তাদের যে জীবন তাতে শরীরে আঁচড় বাঁচিয়ে চলা খুব কঠিন। নানান রকম আঙুলের ছাপ পড়ে শরীরে। এখানে এমন মেয়ে বা মহিলা খুঁজে পাওয়া কঠিন যাদের শরীরে ভিন্ন ভিন্ন আঙুরের ছাপ নেই। শিউলির মা সাবিনার শরীরেই কত হাতের আঙুলের ছাপ আছে।

তা শিউলিও জানে। সাবিনা দেখতে বেশ সুন্দর। শরীরের গড়নও ভাল। তা এই লাইনে এমন ব্যায়াম চর্চিত গঠিত শরীরে পতিত হাতের ছাপ তো পড়বেই। শিউলি জানে যে তার মায়ের শরীরে ম্যানেজারের আঙুলের ছাপ আছে।

বাদল কাকা, নিয়াজ চাচা তার মায়ের সাথে শোয়। শিবু কাকা তার মায়ের দীঘল কালো কেশ বেণী করে দেয়। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গার কমিটির কতজনকেই তো মাকে খাতির করতে হয়। কিন্তু তেরোয় পা দেয়া একটি মেয়ে কি-ই বা করতে পারে। শিউলির বাবা সোলেমানও এসব জানে।

তার সম্মতিও আছে। কেননা সোলেমান ম্যানেজারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। সবাই সোলেমানকে ম্যানেজারের কাছের লোক হিসেবেই জানে। এসবের বিনিময়েই সাবিনা মাঝে মাঝে ম্যানেজারকে খাতির যত্ন করে। শিউলির এসব ভাল লাগে না।

তবু কিছু করার নাই মুখ বুজে দেখা ছাড়া। শিউলিদের জীবন যাযাবরের মতো। আজ এখানে তো কাল ওখানে। দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেড়ায়। শিউলির জন্মের আগে থেকেই সোলেমান-সাবিনা সার্কাসের দলে কাজ করে।

প্রথমে দুজনেই অন্য একটি দলে কাজ করতো। সেখানেই তাদের পরিচয় হয়। তারাপর প্রেম। প্রেমের কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সোলেমানকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। কেননা সাবিনার প্রতি নজর ছিল কর্তা ব্যক্তিদের।

তারপর একদিন দুজন দল ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। পরে এই দলে যোগ দেয়। এখানে আসার পরই শিউলির জন্ম। বছরের সাত-আট মাস শিউলিরা সার্কাস দলের সাথে থাকে। আর বাকী সময়টা তারা নানা বাড়ি থাকে।

শিউলিদের নিজেদের কোন বাড়ি নেই। জন্মের পর থেকে সে এই ব্যবস্থাই দেখে আসছে। সার্কাস দল আর নানা বাড়ি। জীবনের সুরের কোন বৈচিত্র্য নেই। এক সুরেই বেঁজে চলেছে।

শিউলি মায়ের মুখে শুনেছে। তার দাদা বাড়ি আছে। দাদা বাড়ির অবস্থা খুব ভাল। গেরস্থ পরিবার। আম, কাঁঠাল, নারিকেল গাছে ভরা অনেক বড় বাড়ি।

পুকুর আছে। মাঠে অনেক জমি আছে। হাল চাষের গরু, দুধেল গাই আছে। বাইরের বাড়িতে মসজিদ আছে। জীবনে একবার মাত্র শ্বশুর বাড়িতে গিয়েছে সাবিনা।

সেই দল থেকে পালিয়ে বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। বাড়ির ভিতরেও যেতে পারেনি। বাইরের বাড়ি থেকেই বের করে দিয়েছিল সোলেমানের বাবা। সাবিনা চোখের জল ফেলতে ফেলতে সোলেমানের সাথে বের হয়ে আসার সময় শুধু এক নারী কন্ঠের বুক ভাঙা কাঁন্নার শব্দ শুনতে পেয়েছিল। পরে সোলেমান বলেছিল মায়ের কাঁন্নার শব্দ।

সোলেমানের পরিবার খুব রক্ষণশীল। ধর্মভীরু। সোলেমান ছোটবেলা থেকেই বাইন্ডুলে স্বভাবের। একদিন লুকিয়ে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সার্কাস দেখতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। সার্কাস দলে যোগ দিয়েছিল।

পরে বাড়িতে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল। তার রক্ষণশীল পিতা শুনে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। সমাজে তার মানহানি হয়েছিল। কদিন পরই তিনি সোলেমানকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। কয়েক মাস পর সোলেমান বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করা হয়েছে।

তারপর অনেকদিন পর বাড়িতে গিয়েছিল বউকে নিয়ে। বাইরের বাড়ি থেকেই ফিরে আসতে হয়েছে। তারপর আর কোনদিন বাড়িতে যায়নি। শিউলির বয়স যখন সাত বছর তখন থেকেই সে খেলা দেখাতে শুরু করেছে। এখন সে একজন নিপূণ সার্কাস শিল্পী।

কিন্ত এই জীবন শিউলিকে মোটেই টানে না। জন্মসূত্রেই তাকে এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশার সঙ্গে জড়াতে হয়েছে। ছোট-বড় অনেক আঘাত সে পেয়েছে। একবার হাত ভেঙে তিন মাস বসে থাকতে হয়েছিল। আরেক বার বা পা মচকে গিয়েছিল।

হাত-পা ভাল হলে আবার কাজ শুরু করতে হয়েছিল। শিউলির ছোট বোন নয় বছরের বেলিও ভাল খেলা দেখাতে পারে। ওরও হাত ভেঙেছে একবার। হাত ভাঙুক আর পা ভাঙুক তার চিকিৎসা আছে। তবু এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশা থেকে তাদের মুক্তি নেই।

বেশ সকালেই ঘুম ভেঙে গেল শিউলির। একে তো মাঘ মাস। তার ওপর অঁজো পাড়াগাঁ। আর এই জায়গাটা খোলা মাঠের পাশে। অন্যপাশে পরিত্যাক্ত রেললাইন।

অল্পদূরেই বাজার। শিউলি গা থেকে লেপ সরিয়ে গায়ে চাদর পেচিয়ে নিল। পাশে ছোট বোন বেলী এখনও ঘুমিয়ে আছে। তারপর ভাই সুজন, এর পর মা-বাবা। ছোট্ট একটা ছাপরা ঘরে গাদাগাদি করে থাকতে হয় সবাইকে।

শিউলি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো। বাইরে তীব্র কুয়াশা। সদ্য স্নান করা নারীর লম্বা চুল থেকে যেমনি ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে তেমনি বড় বড় গাছগুলোর পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ছে। ঘন কুয়াশায় দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কলতলায় গিয়ে মুখে জল দিল শিউলি।

বরফের মতো ঠান্ড জল। সারা শরীর কেঁপে উঠলো। 'কিরে মা এত সকালে উঠে পড়ছিস!' ঘাড় ঘুরিয়ে ছোট্ট মানুষটির দিকে তাকিয়ে শিউলি বললো, তুমিও তো আজ তাড়াতারি উঠছ মামা। আর কইস নে মা। পেটের গন্ডগোল।

নইলে এই শীতে আমার বাপও আমারে উঠাইতে পারতো না। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে চলে যায় শিউলি। শিউলির এই মামার নাম সিরাজ। সিরাজ মামাকে খুবই পছন্দ করে শিউলি। সিরাজ মামা বামন।

উচ্চতা তিন ফুঁটের মতো। দলের অন্যতম জোকার সে। হাসাতে হাসাতে মানুষের পেটে খিল ধরিয়ে দেয়। কিন্তু এমনিতে মানুষটি খুবই গম্ভীর। একেবারে নিরেট ভাল মানুষ।

বিয়ে করেছিল সিরাজমামা। বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে অন্য একজনের সঙ্গে। আর বিয়ে করেনি সিরাজ। সিরাজমামা মাঝে মাঝে বলে, সৃষ্টিকর্তার মাটিতে কম পড়ছিল। তাই আমারে ছোট বানাইছে।

সিরাজ মামার স্বভাব-চরিত্র নিয়ে কেউ কোন খারাপ কথা বলতে পারবে না। আরো কয়েক জন বামন জোকার আছে দলে। কিন্তু সিরাজমামা তাদের মতো না। তার মনে কষ্ট আছে সে বামন বলে, কষ্ট আছে তার বউ তাকে ছেড়ে চলে যাবার। তবু সে অন্যদের হাসায়, নিজে হাসে।

হেসে নিজেকে সব কষ্ট থেকে নির্ভার রাখে। এরপর দুদিন কেটে গেল। শিউলি সাবিনার সঙ্গে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলেনি। সে চুপচাপ নিজের মতো ছিল। বিকেলের শো শেষ হলে শিউলি ঘরে ফিরে দেখে রফিক আর সাবিনা গল্প করছে।

সে ঘরে ঢুকতেই তারা চুপ হয়ে গেল। রাগে শিউলির গা জ্বলে যাচ্ছে। ঘৃনায় গা গুলিয়ে উঠছে। রফিক তার শরীরে হাত দিয়েছে। অথচ তার নিজের মা সে কথা জেনেও রফিকের সাথে বসে গল্প করছে! চাদর নিয়ে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল শিউলি।

সাবিনা ডাক দিল, শোন শিউলি। শিউলি দাঁড়াল। রফিক সেদিন ছেলেমানুষী করিছে। তার জন্যি তোর কাছে মাফ চাতি আয়চে। শিউলি কোন কথা না বলে সামনের দিকে পা বাড়ায়।

সাবিনা ধমক দিয়ে বলে, দাঁড়া শিউলি। মেয়ে মানুষের এত দেমাগ ভাল না। রফিক ছেলে খারাপ না। বয়সের দোষে না হয় একটা ভুল করেই ফেলছে। তার জন্য তো মাফ চাতি আয়চে।

তাছাড়া রফিক তোরে বিয়ে করতি চায়। এতক্ষনে হাঁড়ির খবর জানতে পারে শিউলি। মায়ের মনে তাহলে এই ছিল? এই জন্যেই কি রফিকের হয়ে এত ছাফাই গাওয়া! নিজের মেয়ের শরীরে হাত দিয়েছে জেনেও প্রতিবাদ না করে চুপ করে থাকা! আর থাকতে পারে না শিউলি। জোর করে নিজেকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে সে। আর সহ্য করা যায় না।

রফিকের মতো একটা লম্পটকে বিয়ে করার চেয়ে মরাও ভাল। রিনা আপার সাথে রফিক শোয় একথা সে মায়ের মুখেই শুনেছে। আর আজ সেই রফিক এত ভাল হয়ে গেল! যে রফিকের সাথে মা তাকে বিয়ে দিতে চায়। তারপর দুদিন পর তার অবস্থাও তার মায়ের মতোই হবে। রফিকের সম্মত্তিতেই তাকে নানা জনের সঙ্গে শুতে হবে।

তার শরীরেও মায়ের মতো পঞ্চভূতের আঙুলের ছাপ পড়বে। সার্কাস শিল্পীর আড়ালে পতিতাবৃত্তিই হবে জীবিকার মাধ্যম। তার স্বপ্ন কোনদিন পূরণ হবে না। কোন এক গ্রামে গাছপালায় ভরপুর ছায়াঘেরা বাড়ি, টিনের ঘর, দুধেল গাই, গোয়াল ঘর, স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তার কোনদিনই হবে না। এখানে থাকলে মা-বাবা তাকে রফিকের সঙ্গেই বিয়ে দেবে।

এই বয়সেও সে জীবনের অনেক দেখেছে, অনেক জেনেছে। আর নয়। তাকে পালাতেই হবে। এখানে থাকলে তার জীবন অন্ধকার। আর বাইরে গেলে বড়জোর না হয় মৃত্যু হবে।

তবু এই জীবন্ত মৃত্যুর চেয়ে প্রাণহীন মৃত্যু অনেক ভাল। রাতের শো শেষ হবার সাথে সাথে চাদর মুড়ি দিয়ে দর্শকের ভিড়ে মিশে যায় শিউলি। ভয়ে বুক ঘন ঘন ওঠা নামা করছে তার। কোন মতো গেটের বাইরে যেতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচা। গেটের কাছে পরিচিত লোকজন থাকে।

কোনদিকে না তাকিয়ে ভিড় ঠেলে কোনমতে বাইরে চলে এলো সে। তার ইচ্ছে করছে এখন জোরে একটা দৌড় দিতে। কিন্ত দৌড় দিলে ধরা পড়ে যাবে। তাই ইচ্ছেটাকে অনিচ্ছায় চাপা দিয়ে অন্যদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে সে। প্রচন্ড শীত হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে আর তীব্র কুয়াশায় চাদর ভিজে যাচ্ছে।

অন্যসব লোকজন বাজারের রাস্তা, গ্রামের রাস্তা ধরে চলে গেলেও সে সোজা রেললাইন ধরেই হাঁটতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে একা হয়ে পড়লো সে। এখন ধরা পড়ার আর কোন সম্ভাবনা নেই। অনেক দূর চলে এসেছে সে। পিছনে বার কয়েক তাকালো।

না, কোথাও কেউ নেই। এখন সে স্বাধীন, মুক্ত। এই মুক্ত পৃথিবীর কোথায় সে যাবে, রাতে কোথায় শোবে, সকাল হলে কি খাবে তা জানেনা। তবু তাকে যেতে হবে। পাথর ভেঙে ভেঙে হাঁটতে থাকে শিউলি।

মাঝে মাঝে হোঁচট খায় আর নানান ভাবনা জট পাকায় মাথার মধ্যে। তার বাকী জীবনটাও হয়তো এমনিই পাথুরে। সেই পাথুরে পথও তাকে এমনিভাবেই ডিঙোতে হবে হোঁচট খেতে খেতে। খাবে হোঁচট, তবু রফিকের ঘরের পুতুল বউ হয়ে পঞ্চভূতের বিষাক্ত হাতের আঙুলের ছাপ পড়তে দেবে না শরীরে। রচনাকাল ফেব্রুয়ারী ২০০৮


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.