কতো কী করার আছে বাকি..................
মায়ের ছবিটার ওপর একটা টিকটিকি চার পায়ে আর লেজে সহজাত কৌশলে ধীর হয়ে আছে। তার মুখের কিছু সামনেই রং আর অবয়ব ধরা যায় না এমন একটা পোকা। লালা মাখা টিকটিকির চোয়ালে যার জীবনের শেষ পরিণতি। অথচ এই মুহূর্তে সে ঘুনাক্ষরেও তা জানছে না। পোকাটা খেয়েই টিকটিকিটা সরে যায়।
ভেসে ওঠে মায়ের হাসিটা। কি এক জীবন বোধের হাসি। যেন টলটলে জলাশয়-তাতে অসংখ্য সাদা হাসের সন্তরন। মায়ের হাসির শব্দেও যেন ওই খলবলে আওয়াজটা পাওয়া যেত। হাসিরেণুরা ছিটিয়ে পড়তো চারপাশে।
হাসির দুপাশে ভোরের ঘষা আকাশ-তাতে রাতের ক্লান্তি অথবা বিষন্নতা। আর কপালের টিপটা যেন দিগন্তে জেগে ওঠা ভোরের সেই শিশু সূর্য-কতো কমনীয়তা আর কতো তেজ তার ভেতরে ভরা। মা কখনোই তেজ প্রকাশ করেন নি। আলো ছড়িয়েছেন শুধু। এই পৃথিবীটাই তার কাছে ভালোবাসার জন্য।
পৃথিবীটা যেন তার আঁচলস্পর্শী। ভালোবাসতেন তিনি সবকিছুই। ঘরের একটা শুকনো কি ভেজা ত্যনা থেকে শুরু করে তার সন্তানদের-তার জীবন সঙ্গীকে। মায়ের আঁচলের ছোঁয়ায় সব কিছুই সন্তান হয়ে উঠতে পারতো তবে। মায়ের ঠিকই মনে পড়তো গ্রামের কোন খালা কি কোন বুয়াকে।
সময় পেলেই তাদের গল্প করতেন। গ্রামে চলে যেতেন তাদের সঙ্গ পাবার আশায়। খোঁয়াড়ে তার ছোট বেলায় পালা মুরগি আর বাচ্চাগুলোকে ভুলতে পারেননি মা। বাল্যের সখিদের সাথে বেতুইন অমলকি খাওয়ার স্বাদ তার জিহ্বায় কি শেষ পর্যন্ত লেগে ছিল। মায়ের মৃত্যু তবে অনেক কষ্টের ছিল।
ভাবে সে। মৃত্যু শয্যায় মায়ের মুখ থেকে একে একে কতো মুখচ্ছবি, গন্ধ,দৃশ্য,চিত্র ঝুপ ঝুপ করে বাতির মতো নিভে গেছে নিশ্চয়ই। মাকে নিয়ে গেছে এক নিঃসীম অন্ধকারে। সেই অন্ধকারে যাওয়ার আগে মায়ের মুখে কি যেন এক আকুতি ফুটে উঠেছিল। কি জন্যে সেই আকুতি।
নিজের সন্তানকে ছেড়ে যাচ্ছেন বলে। না কি সালেহা খালাকে পরের ঈদে একটা শাড়ি দেয়ার কথা ভেবে ছিলেন, শেষ মুহূর্তে তাই মনে পড়ে গিয়েছিল মায়ের। না কি সদ্য বাড়িতে লাগিয়ে আসা তিতাকরলা গাছটায় যেন নিয়মিত পানি দেয় জমিলা বুয়া, পেঁচিয়ে বেড়ে ওঠার জন্যে যেন একটা কাঠি দেয় তার গোড়ায়-তাই বলে যেতে চেয়েছেন। কে জানে, মৃত্যুক্ষণে নিরাবলম্বন মা হয়তো ওই কচি করলা গাছেই বেঁচে উঠতে চেয়েছিলেন-কিম্বা বেঁচে ফিরতে আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন কিছু একটা। সেই কিছু একটা হয়তো তিতাকরলা গাছের গোড়ায় পোঁতা কাঠির মতোই কিছু একটা।
তার সবসময়ই মনে হয় মায়ের মৃত্যুটা খুবই কষ্টের ছিল। বাবার মৃত্যুও কি কষ্টের ছিল। বাবা একেবারেই পুরুষ ছিলেন। সংসারের হাল বেয়ে গেছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। কতো ঢেউ-কতো ঝড় দাঁতে কেটেছেন।
রক্তক্ষরণের বেদনা বাবার ছিল। তাই চাইতেন সন্তান যেন বড়ো কিছু হয়। পুরুষ হয়। বাবা গ্রামে যেতেন। কারণ সেখানে সহজেই পুরুষ হওয়া যেত।
গ্রামের লোকেরা তাকে মান্য করতো। সালিশ বিচার করতো। শহুরে পোশাক ছেড়ে সেই পুরুষ, হাল বাওয়া বন্ধুর সাথে জমিয়ে গল্প বলতেন। আবার শহরে ফিরে এলে বাবাকে পুরুষ সাজতেই হত, উপায় নেই। পুরুষ ছাড়া শহরে কে পারে দৌড়াতে।
বাবার দৌড় একদিন শেষ হয়ে এলো। চলমান রাস্তার শেষে দাড়ি হয়ে উঠলো তার নিশ্চল শরীর আর বিছানা। সেই বিছানায় শুয়ে বাবা নিশ্চয়ই তাকিয়েছেন পথের দিকে। কি ভেবেছেন তিনি, জীবনে কখনো জারুল কৃষ্ণচূড়া দেখা হয়নি, সময় হয়নি মজা করে বৃষ্টিতে ভেজার। পুকুরের জল উথাল পাথাল হয়ে উঠতো যার পাখার ঝাপটানিতে, সেই বাবাই ক্রমশ নিথর, নিস্তরঙ্গ চাদরে শয়ান।
শেষ দিকে কেমন কুঁকড়ে গিয়েছিল তার পুরুষ বাবা। মায়ের পাশে সেই ছবিটা দেখে কখনো কেউ ভাবতেই পারবে না এই দৃশ্য।
ভাত খেতে খেতেই মা বাবার ছবির দিকে চোখ চলে যায় তার। মায়ের ছবি বরাবর নীচে চেয়ারে বসা তার বউ। একেবারে গৃহলক্ষী।
সংসারের প্রতি তার বিশ্বাস,ভালোবাসা অমূল্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু কোথায় যেন তার বউটা মা হয়ে উঠতে পারেনি। সেই গন্ধটা নেই। আঁচল থাকলেও তার পরিপাট্যই প্রধাণ। একমাত্র কাজের মেয়েটির প্রতি তার ভালোবাসার কমতি নেই।
কিন্তু এটুকুই। খালি হাতে বা গোমড়া মুখে কেউ বাসা থেকে যায় না। উচ্চ শিক্ষিত তার বউয়ের পৃথিবীতে মানুষ কম। গ্রাম নেই-খালাবুয়া নেই-জলপাই বেতুন নেই। মাটি নেই কাদা নেই।
বুকে ঘামের গন্ধ নেই। এটা সে বেশ বুঝতে পারে। নারী তবে ঘর থেকে বেরুচ্ছে এটা সত্যি, কিন্তু উন্মুল হচ্ছে, নারী আর তবে মা হয়ে উঠছে না। এ আরো বড় সত্যি। নাকি সে এসব ভুল ভাবছে।
তার বউ বসন্ত বর্ষা এসব ভালোবাসে। কিন্তু তারতো ঝড়জলে আম কুড়ানো হয়নি কখনোই। পুকুর দাপানো দুপুর তার জীবনে আসেনি। আরেকটা সন্তান তো তার জন্যে নেই যে সবুজ পাতায়-শাখা প্রশাখায়-কচি ডাল আর পুষ্পে বিকশিত হয়। কোথাওতো এতটুকু মাটি তার জন্যে নেই যে জায়গাটা সে মমতায় ছোপাতে পারে।
তার জন্যে শুধু ইটবালিসিমেন্ট।
: কাল কিন্তু বাবুকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
: বাইরে কোথায় নিয়ে যেতে চাও।
: তুমিতো ওই এক শিশু পার্কই চিনো। কাল চলো আশপাশে কোন গ্রামে যাই।
যেখানে কেউ আমাদের চেনে না।
: কিভাবে যাবা।
: কেনো কোন লোকাল বাসে চেপে।
: তুমি কখনো লোকাল বাসে চড়েছো।
: না, তবে দেখেছি আর দুয়েকবার যে চড়িনি তাতো নয়।
: হ্যাঁ, দুয়েকবার তো চড়বেই। কাল চড়তে চাচ্ছো কেন।
: আমাদের বাচ্চাটাকে এসব শেখানো দরকার না। দেখানো দরকার এসব।
: নিজেই দেখোনি তো বাচ্চাকে কি দেখাবে।
: তুমিইতো বলো, আমিও চাই। তোমার ভরসাতেইতো আমি বাচ্চাকে এসব শেখাতে চাই।
: চাও, কিন্তু হয় না। কতো ভেবেছি, ওকে গ্রামে নিয়ে পড়াবো । অন্তত ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত।
কই হলো।
: হয়নি। হওয়া সম্ভব না।
: তুমি কি তোমার গ্রামের লোকজন কে চিনো। বলতে পারবে তোমাদের গ্রামে খেটে খায়, অন্যের বাড়িতে কাজ করে খায় এমন কারুর নাম।
তাদের কোনো গল্প।
: না। আমি কি আর গ্রামে ছিলাম বলো। কিভাবে পারবো।
ভাত খেতে খেতে বউয়ের সাথে এই কথপোকথনে কোন কিছু তৈরি হয় না কেবল ভাত খাওয়ার ইচ্ছেটা মরে যাওয়া ব্যতিত।
ভাত খাওয়া থেকে উঠে বউয়ের সাথে গোছানোর কাজ করে। সেই ফাঁকে চুলায় চায়ের পানি চাপায়। ভাবতে থাকে তার মায়েরই কথা। মা বলতেন
: বুচ্ছস তেতুল অইতাছে শয়তাইন্যা ফল-দেখলেই লালচ লাগে-লালা গড়ায়া পড়ে। এই খায়া কি অয় ক, পেট ভরে না শইল্যে শক্তি অয়।
তেতুল কয়-দেহো মানুষ তোমার মইদ্যে অহনও লালচ আছে-লোভ আছে। সামলায়া চলো।
তার বউ কি এই তেঁতুল মাহাত্ম্য জানে। কি করে শেখাবে তার সন্তানকে তেঁতুল থেকে সংযমের শিক্ষা। মনে আছে যখন তারা শহরে উঠে আসে গ্রাম থেকে।
মা কোন কিছুই বাদ দেন নি। ব্যাগে ভরে সবই নিয়ে এসেছেন। ফুল গাছ, মরিচ গাছ, ম্যাচ, সব। অথচ এই মা কতোবার টাকা অলংকার হারিয়েছেন। ভাবতে ভাবতে তার সামনে চুলার আঁচে স্বচ্ছ চায়ের পানির নীচে বুদ্বুদ ওঠে।
আবার মিলায়ে যায়। এই দৃশ্য কেন যেন তার চোখে লেগে থাকে। চা-সিগারেট-ঘুমানোর প্রস্তুতি। দৃশ্যটা চোখ থেকে মোছেই না। রাতের ঘন অন্ধকারে বুঝতে পারে কোন অর্থ সে তালাশ করে চলেছে এই দৃশ্যের।
এই যে মায়ের মৃত্যু, তার বউ, সন্তান, মান-অভিমান-আলাপ-স্বপ্ন। সমস্তই মহাকালের একেকটি বুদ্বুদ। মিলায়, আবার তৈরি হয় আবার মিলায়। তাপ বাড়তে থাকে। বাষ্প হয়ে পানি উবে যায়।
রাতে ঘুমের স্বপ্নে সে গোসল করে এক পুকুরে, যেখানে পানি নেই। শুদু কাদা। সেই ভুসভুসে কাদায় ডুব দেয়। লেপ্টে থাকা কাদা গায়েই সে গোসলের আমেজ নিয়ে উঠে আসে-তার লুঙ্গি গামছায় লেগে থাকে সেই কাদা। সকালে আয়নায় নিজের মুখে বারবারই কাদা দেখে।
পেষ্টের ঝাঁঝ গলায় চলে এলে একটি ঘটনা তার মনে পড়ে। তার এক বোনের শ্বশুর বাড়ির পাশেই এক লোককে তার দলের অন্যরা শাস্তি স্বরুপ ক্ষেতের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে লোদকাদা খাইয়েছিল। বোন সেই লোকের গোঙানি শুনেছে। বউ বাচ্চাসহ নাস্তার টেবিলে বসে রুটি খেতে খেতে তার মনে হয় ওই কাদা মলা রুটিই সে খাচ্ছে। গলায় যেন বালি বালি পানসে কাদার স্বাদ, দলা পাকানো, গিলতে ভীষণ কষ্ট।
ভাজা ডিম দিয়ে সে যা খাচ্ছে, কি বিস্ময়, তা কাদারুটি।
নাস্তা শেষে পত্রিকাটা হাতে নেয়। পত্রিকায় তার আগ্রহ কম। অভ্যস্ততার বশে পড়ে। তাও কোন রাজনৈতিক খবর না।
আশপাশের খবর। রাজনীতির ফলাফলটাই সে পড়ে থাকে। আজো ভেতরের পাতার খবর পড়ছিল। সেখানেই খবরটা দেখতে পায়। স্বাভাবিক-কিন্তু এই সকালের জন্যে খবরটা বিভ্রান্তিকর।
যখন সে তার বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে-তখন এই খবর দ্বিধা তৈরি করে বৈকি। একটা মেয়ে অভিমানে গলায় ফাঁসি দিয়েছে। এমন খবরতো নতুন নয়। তবু সে বিচলিত হয়। বের হওয়ার সিদ্ধান্ত বাদ দিতে চায়।
পত্রিকা রেখে একটা সিগারেট ধরায়। ভুলে থাকতে চায় খবরটা। সিগারেটের ধোঁয়ায় মনোনিবেশ করে। সেই উর্দ্ধমুখী ধোঁয়া ছাদে মিলায়-ছাদে নীরব সিলিং ফ্যান। ধোঁয়াগুলো সেখানে গিয়ে ফন্দি আঁটে।
হাত পা সমেত মনুষ্য শরীরে গঠিত হতে থাকে। এরপর মেয়েটির অবয়বে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলতে থাকে সিলিং ফ্যানে। চমকে ওঠে সে। চিন্তাটা ভুলে যেতে তৈরি হয় বাইরে যাওয়ার জন্য। মোজা,শার্ট,বেল্ট পড়তে পড়তে সেই চিন্তা তার নাসা রন্ধ্রে, তার হাতের তেলোয় জীবন্ত হয়ে ওঠে।
ঈদে জামা পায়নি বলেই আত্মহত্যা করেছে মেয়েটি। অস্থির হয়ে নিজের সন্তানের কাছে যায়। তাকে তৈরি করতে থাকে। ভাবতে থাকে এটাও একটা ছবি আঁকা বা এমন কিছু। নিজের হাতে সাজানোর আনন্দ পেতে চায়।
কিন্তু সেখানেও তার বাচ্চাটার চোখের মনিতে সে তাকায় না। নিচু হয়ে থাকে। দ্রুত বাসা থেকে বের হয় ট্যাক্সি ক্যাব ডাকবে বলে।
শহরের আসা যাওয়ার পথে শেষ বসন্তের বাতাস গলিয়ে তাদের গাড়ি এগিয়ে যায়। হা বসন্ত।
শিমুল নাই পলাশ নাই খালি ধুলো মলিনতা। পুরো শহরেই ধুলোর ময়লা শাদা আস্তরণ। যেন শহরের গায়ে গায়ে বুনন চলছে মৃতের বসনের, ধীরে ধীরে। একদিন শহরটা ঢেকে যাবে শবের কাফনে। অসমাপ্ত বুননের নীচে সেই আয়োজনের বিরাম নেই।
শহর জুড়ে রক্ত বারুদ আর রোদে ঝিলিক দেয়া অস্ত্রের আঘাতে মানব মৃত্যুর মচ্ছব চলছে। সেই কাফন গায়ে জড়ানোর অপেক্ষাতেই আছে বোধহয় সভ্যতা। গাড়ির জানলায় বাতাস কাটা পড়ে-কিছু তার চুল এলোমেলো করে দেয়। বাকিটা চলে যায় ফেলে আসা পথে। বউ তার গান ধরে।
আসা যাওয়ার পথের ধারে
কেটেছে দিন
গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন
যাবার বেলায় দেবো কারে
যাবার বেলায়
দেবো কারে বুকের কাছে বাজলো যে বীণ
এই আসা যাওয়ার সংসারের পথ তবে কি ওই অনন্তেই মিলায়। নইলে বউ তার এই গান ধরলো কেন। নাকি সেও পড়েছে সকালের পত্রিকা। অথবা শহরের মৃত্যুগামীতা বিষয়ক আগের কোন আলোচনা তার মাথায় উঁকি দেয়-সে গেয়ে ওঠে এই গান। কে জানে।
সে শুধু ভবতে থাকে যাওয়ার বেলায় কোন বীণ বেজে ওঠে মৃত্যুমুখা মানুষের মনে। সেই গাছের ডালে ঝুলে পড়া মেয়েটি ঠিকরে বের হয়ে আসা চোখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কি এই আশায় তাকিয়ে ছিল যে কেউ আসবে দুহাতে তার ঈদের জামা নিয়ে । তার বুকের ভেতরে বেঁচে ওঠার যে বীণ বেজেছিল তাতে সাড়া দেয়নি কোন হাত-তাল লয়ে কম্পিত হয়নি কোন হৃদয়। সবার অগোচরে তার গমন। হয়তো কেবল আঁচড় বসিয়ে গেছে তার মা বাবার স্মৃতিপটে।
কাঁধ থেকে ঝুলে থাকা এই দুহাতে সেও তো মেয়েটির জন্য ঈদের জামা কিনে নিয়ে যেতে পারতো। তবে কি এই দুহাত শুধু টাকা গুনে যাবে, বাজার করে যাবে, বউ আর সন্তানকে সোহাগ করে যাবে। এই দুহাতের ছোঁয়ার বেঁচে উঠবে না কোন জীবন, কোন বৃক্ষ। অসহায়্ত্ব গ্রাস করে তাকে। নিজের হাতে চুলে বিলি কাটে।
হয়তো হাতগুলোকে স্বার্থক করে তুলতেই তা করে।
পার্কে বউ-বাচ্চাকে ঘুরতে পাঠিয়ে সে নিজে পায়চারি করে। চৈত্র আসছে। চৈত্র কী ভিষণ-বেঁচে থাকার আকুতিকে প্রচন্ড করে তোলে সে। চৈত্রের কি তবে পুরুষ স্বভাব আছে।
সন্তানটি তার নাগরদোলায় চড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে পাশেই একটি বেঞ্চিতে বসে সিগারেট ধরায়। চোখে পড়ে চানাচুরের ঝাল নুন তেলমাখা পত্রিকার টুকরা। ফলাফল প্রকাশ বা খেলায়াড়দের উল্লাসের ছবি। হঠাৎ তার মনে হয়-এই টুকরার তো আরো অংশ আছে।
সব অংশ মিলিয়ে যে প্রত্রিকা হয় তাতেও কি ছাপা আছে ওই মেয়েটির মৃত্যু সংবাদ। কিংবা অন্য কোন মানুষ মরার খবর। নাহলে কি আর আজকে যুগে সে পত্রিকা হয়ে উঠতে পারে। পত্রিকার কালো কালো অক্ষরগুলোকে তার কাছে শুকিয়ে আসা জমাট কালো রক্ত মনে হয়। তার ঝিম ধরা মাথায় সেই কালোয় শুধু সংখ্যা ভেসে ওঠে পত্রিকার পাতায়।
মৃতের সংখ্য। অসংখ্য অগুনতি। প্রথম পাতা ভরে গিয়ে দ্বিতীয় পাতায়ও। খালি সংখ্যা। নাগরদোলা ঘুরতে থাকে-ক্যাঁএএএউঁ-ক্যাঁএএএউঁ।
পত্রিকা জুড়ে শুধু যত মানুষ মরেছে তার সংখ্যা। তীক্ষ্ণ হয় ক্যাঁএএএউঁ। অস্থির হয়ে পাতা ওল্টায় সে। পুরো পত্রিকা জুড়েই খালি সংখ্যা আর সংখ্যা। সাংবাদিকের পক্ষে অন্য কোন সংবাদ ছাপানোই সম্ভব হচ্ছে না।
সংখ্যার কি ভয়াবহ রুপ। পাতা ওল্টানোর গতি দ্রুত হয়। ক্যাএএএউঁ শব্দ বৃত্ত রচনা করে। সে দেখতে পায় মৃতের সংখ্যা কেমন যেন গোল গোল ছোট বৃত্ত হয়ে যায়। এতোবড় পত্রিকার পুরোটা জুড়েই সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালো বৃত্ত।
ক্যাঁএএএএউঁ এর সাথে এবার কচি কন্ঠের চিৎকার মিশে যায়। আর পত্রিকার মাথায় সে দেখতে পায়- সম্পাদকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আজ শুধু মৃতদের একটি করে চোখের মনি ছাপানো হয়েছে। অন্য কোন খবর ছাপানো সম্ভব হয়নি বলে আমরা দুঃখিত।
শ্বাসটান উঠে যাওয়ার অবস্থা হয় তার। চোখের সামনে সর্বগ্রাসী এক কালো গহ্বর দেখতে পায় যার কিনারায় সে ঝুঁকে আছে।
হঠাৎ আব্বু ডাকে টলে ওঠে। নাগরদোলায় যতো উল্লাস নিয়ে চড়েছিল, নামার সময় ততটাই শুণ্যতার বোধ বাচ্চাটার সেই উল্লাসকে ভয়ে পরিণত করেছে। বাবার বুক এখন তার আশ্রয়। বাবাও যেন এক ঝলক বাতাস চাইছিলেন। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে তার বুক থেকে সেই বাতাসটুকু টেনে নিলেন।
কান্নার বেগটাকে দমন করলেন। নিজের দুই হাতের তালু, আঙ্গুলের ডগা- ভাঁজ, কররেখার খাঁজে জমে থাকা সমস্ত মমতা দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় সে সন্তানটাকে। তার মুখে ঘামলালার গন্ধে জীবন আছে। বিকাশ আছে। বাচ্চাটা যেন সেই কচি করলার লতা।
তার গোড়ার কাঠিটা হয়ে উঠতে চায় সে। আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে বেড়ে উঠবে বাচ্চাটা। শাদা ফুলে হেঁসে উঠবে পরাগায়নের রোমাঞ্চে। ওই মেয়েটির মত্যু তবে শুধু পত্রিকারই সংবাদ। ওই মেয়েটির মৃত্যু তবে তার জীবনের জন্য অপ্রাসঙ্গিক মত্যু।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।