আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আগুনের বিনোদন: দ্য সিটি ইজ অন ডিসপ্লে!!

http://joyodrath.blogspot.com/
বসুন্ধরা সিটিতে আগুন। আধাবেলা সেই আগুন আমরা দেখলাম টেলিভিশনে। প্রায়-রিয়েল টাইমেই, মানে লাইভ টেলিকাস্ট। সেই অর্থে, আগুনের সূত্রপাত আমাদের চোখের সামনে না ঘটলেও, আগুন পোড়ালো আমাদের চোখের সামনে। আমরা খেতে খেতে দেখলাম আগুন, দিবানিদ্রা দিয়ে উঠে দেখলাম আগুন, অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম দারাপুত্রপরিবার বেশ জমিয়ে জমিয়ে টেলিভিশনে আগুনের বিনোদন দেখছে।

জমিয়ে জমিয়ে না বলে "রসিয়ে রসিয়ে"ও বলা যেত, সংস্কারবশত বললাম না কারণ শত হলেও এটা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং এই আগুন পোড়াচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচে বড় শপিং মলটাকে। এই আগুন পোড়াচ্ছে আমাদের অর্থনীতিকে, এবং কিছু হলেও আমাদের জাতীয়তাবাদী অহমকে। ঘটনাচক্রে দেশের বেশিরভাগ প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলের অফিস বসুন্ধরা সিটি থেকে কয়েকশ গজের মধ্যে। না হলেও সমস্যা ছিল না, সেটা আমরা পিলখানার বিডিআর তাণ্ডব কিংবা সিলেটের সূর্যদীঘল বাড়ি ইভেন্টের বেলায় দেখেছি। কিন্তু হাতের একেবারে নাগালে হওয়ায় বুভূক্ষু টেলিভিশন ঝাঁপিয়ে পড়ল এই মনোরম আগুনে।

অগ্নিস্নাত হল আমাদের চোখ। দেখলাম উনিশতলার আগুনের উদ্দেশ্যে ছিটানো পানি পৌঁছাচ্ছে চৌদ্দতলায়, উড়ছে হেলিকপ্টার, ভবনের ছাদ থেকে জেমস বণ্ড কায়দায় সরাচ্ছে কোনো আটকা-পড়া শরনার্থীকে, উঁচু থেকে পড়ে গিয়ে মরে যেতে দেখলাম এক ফায়ার-ফাইটারকে, দেখলাম উৎসুক জনতার ভিড়, মুহুর্মুহু নিউজ ফোরকাস্ট হতে থাকল সেসব নিয়ে, অজগরের মত আগুন একটু একটু করে গিলছে বসুন্ধরা সিটিকে, আর সেই দৃশ্য নিয়মিত অনুষ্ঠান বাতিল করে টেলিভিশন আমাদের গিলাচ্ছে! এরচে দারুণ থ্রিলার কি হতে পারে আর? পুড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার সবচে বড় শপিংমল, বাতাস পেয়ে পেয়ে লেলিহান হয়ে উঠছে আগুন, ৮০০ ডিগ্রি তাপে গলে গলে পড়ছে এর থাই-কাঁচের বেষ্টনী, দমকলের পানি নাগাল পাচ্ছে না এই লেলিহান শিখার, ধীরে ধীরে আগুন নামছে নিচে, অগ্নিনির্বাপনের সহজ সমীকরণ এখানে কার্যত অবসলিট, ফলে থ্রিল আরো ঘনীভূত, আশপাশের ভবনগুলোও খালি হয়ে পড়ছে, ইতোমধ্যেই আমরা টের পেতে শুরু করেছি এটা রীতিমত ফুল লেংথ মুভির চেয়ে বড় লেংথের বিনোদন, এবং একটা পারফেক্ট থ্রিলারের মতই এর উপসংহার ঝাপসা আর অজানা, কতখানি গিলতে পারবে আগুন এই বসুন্ধরা সিটিকে? আমাদের চোখকে আরো আরাম দেয়ার জন্য টেলিভিশনগুলো তাদের নিজ নিজ ছাদ থেকে নেমে ঘটনাস্থলের আরো কাছে পৌঁছাল। এতে আমরা আগুনে হলকা আরো নিবিড়ভাবে টের পেলাম, সেইসাথে টের পেলাম টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কম্প‌ারেটিভ অ্যাডভান্টেজ! সচল হচ্ছে নাগরিকদের টেলিফোন: : বাংলাভিশন বদলাও, ওরা তো ছাদ থেকে ক্যামেরা ধরছে, এটিএন-এ অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে! : চ্যানেল আই একেবারে লাইভ! : দিগন্ত টিভি দিয়া কী হবে, এনটিভি খোলো এনটিভি। মিস করতেসো!! এভাবে আমরাও জড়িত হয়ে পড়ি এই যুদ্ধে, হাতে রিমোট কন্ট্রোলের মত একটা অস্ত্র নিয়ে। এই চ্যানেল থেকে ওই চ্যানেল, এরকম দারুণ দুর্যোগেও ভোক্তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে! জমছে সন্ধ্যার আড্ডার রসদও, কোন্ চ্যানেলটি না দেখার কারণে কে কী জিনিস মিস করল, ইত্যাদি।

পারফেক্ট থ্রিলারের মতই আগুন হাজির করল তার নিজস্ব কনস্পিরেসি থিওরি। ছুটির দিন আগুন লাগল কিভাবে, কেনই বা বসুন্ধরা গ্রুপের অফিসগুলোতেই আগুন লাগল বেছে বেছে, বিশেষ করে এই আওয়ামী লীগ আমলে, এই আগুনের সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার যোগাযোগ কিভাবে, এটা কি "ন্যাশনাল প্রাইড"কে ধ্বংস করবার কোনো ভারতীয় ষড়যন্ত্র কি না, অগ্নিদগ্ধ কোনো একটি ফ্লোরে নাকি ভারতীয় পতাকা মিলেছে ... এসব কাহিনিতে সয়লাব হল ব্লগ। দিনভর চললো আলোচনা, বাদ বিসম্বাদ, তাতে ব্লগের পুরনো রাজনৈতিক মেরুকরণের হেরফের হল না বিশেষ। যে যার আদি অবস্থানে থেকেই নিজ নিজ থিওরি হাজির করতে পারলেন আগুনের উপাখ্যান নিয়ে। বিডিআর তাণ্ডবেও পেরেছিলেন।

ব্লগে কনস্পিরেসি কাহিনির জন্য দুটোমাত্র ইডিওলজি চ্যানেল: আওয়ামি-ভারতীয় আর পাকি-জামাত। যাবতীয় ফেনোমেনা এই দুই চ্যানেলেই প্রবাহিত হয়। ফলে আগুন যতই সর্বগ্রাসী আর অভূতপূর্বরূপেই আসুক না কেন, তাকেও এই দুই চ্যানেল দিয়ে ব্লগে প্রবাহিত হতে হল। এভাবে টেলিভিশন আমাদের একের পর এক রূদ্ধশ্বাস থ্রিলার উপহার দিয়ে চলছে। আর তার সাথে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে অনলাইন ব্লগ, নানারকম ভাব ভাষ্য পোলারাইজেশন আর কনস্পিরেসি কাহিনিসহকারে।

এই দুই মিডিয়া মিলে ঢাকাশহরকে আমাদের ১৪ থেকে ২৪ ইঞ্চি স্ক্রীণে বন্দী করে ফেলছে অবলীলায়। দ্য সিটি ইজ অন ডিসপ্লে!! আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অনুপ্রাসের দোলায় উঠে বলেছিলেন, "এই মনোরম মনোটনাস শহরে"! ভিজুয়াল মিডিয়ার রিয়েল টাইম ব্রডকাস্ট আর ব্লগ মিডিয়ার ইনস্ট্যান্ট আখ্যানরচনার এই দক্ষযজ্ঞে আমাদের শহর আরো মনোরম হয়ে উঠছে দিনকে দিন, মনোটনাস তো একেবারেই নয়। আজ সকালে পত্রিকা খুলে যখন দেখি বসুন্ধরার আগুন লিড নিউজ হয়েছে, কেমন বাসি বাসি লাগল। মনে মনে বললাম, এই আগুন তোমাকেই বরং মনোটনাস করে ফেললো হে নিউজপেপার, দ্য সিটি ইজ অন ডিসপ্লে!!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।