জাহাঙ্গীর আলম আকাশ
পিলখানার মর্মান্তিক ঘটনার পর ুব্ধ সেনা কর্মকর্তাদের কথা শোনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনা সদর দপ্তরে গিয়েছিলেন। সেখানে অনুষ্ঠিত দরবার হলে সেনা প্রধান মঈন উ আহমেদ এর উপস্থিতিতে সেনা কর্মকর্তারা তাদের ােভ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন বাংলার অগ্নিকন্যা কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী।
সেনা সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সেনা কর্মকর্তাদের কথোপকোথনের অডিও ক্যাসেট বাজারে ছাড়া হয়েছে। কিভাবে কেন এই ক্যাসেট এবং কারা বাইরে ছাড়লো? এই অডিও ক্যাসেট ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করেছে বলে শুনেছি।
কথোপকোথনের সময় সেনা কর্মকর্তাদের অনেককেই দেশের গর্ব সশস্ত্র বাহিনীর যে শৃঙ্খলা তার সীমা লঙ্ঘন করেছেন বলে সচেতন অনেকে মনে করেন। সেনা কর্মকর্তারা মাঝে-মধ্যে ‘ঠিক ঠিক’ বলে স্লোগান দিয়েছেন। এধরনের স্লোগান কেবল ইসলামী ছাত্রশিবিরের আলোচনা-সমাবেশে আমরা ল্য করে থাকি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেদিন সেনা কর্মকর্তাদের প্রশ্নের উত্তর দৃঢ়ভাবে দিয়েছেন। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা সাবাশ! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিডিআর পিলখানার ঘটনার সাথে সশস্ত্র বাহিনীর কোন ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর ইন্ধন আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা উচিত। ১৯৭৫ সালের ৫ আগষ্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে যে সা¤প্রদায়িকতার বিষবাস্প ছড়ানো হয়েছে; দেশে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করা হয়েছে, নির্যাতন ও হত্যা-খুনের বিচারহীনতা চালু এবং অপরাধীদৈর দায়মুক্তির যে কালচার শুরু করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে তার অবসান চান দেশবাসি।
জামায়াত, যুদ্ধাপরাধ আর জঙ্গিবাদ বিডিআরের সদর দপ্তরের নজিরবিহীন গণহত্যা-নারকীয় তান্ডবলীলার যোগসূত্র আছে বলে দেশবাসির কাছে ক্রমশ: স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে কেউ কেউ মনে করেন, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পট পরিবর্তনের পর অস্বাভাবিক জরুরি অবস্থা চলাকালে সেনা সদস্যদের নির্যাতন ও বাড়াবাড়ির ঘটনার যোগসূত্রও থাকতে পারে পিলখানার ঘটনার। বিডিআর সদস্যদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ােভ যে ছিল না তাও বলা মুশকিল।
তবে এটি যে নিছক কোন ােভের বহি:প্রকাশ নয় তা আর বলার অপো রাখে না।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরতম পূর্ব পরিকল্পিত সেনা গণহত্যাযজ্ঞ এটি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পিলখানায় বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) এর সদর দপ্তরে গত ২৫ ও ২৬ ফেব্র“য়ারি এই নৃশংসতম ঘটনাটি ঘটে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতেই এই ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে খোদ সরকারের তরফ থেকেই বলা হচ্ছে। ১২ মার্চ বাণিজ্যমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল ফারুক খান গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, পিলখানার হত্যাকান্ডের সাথে নিষিদ্ধ ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জেএমবি (জামাআ’তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ)’র সম্পৃক্ততা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
পিলখানার হত্যাকান্ডে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অর্ধশতাধিক মেধাবি কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন খোদ বিডিআরের নিহত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের পতœীসহ বেশ কছু বেসামরিক মানুষ। তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের নামে দুর্বত্তরা শুধু হত্যাকান্ডই ঘটায়নি, তারা বিডিআর সদর দপ্তরে নজিরবিহীন তান্ডবলীলা, নারী-শিশু নির্যাতন-লাঞ্ছনা করা ছাড়াও ব্যাপক বোমা-গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও লুটতরাজ চালিয়েছে। এ ঘটনায় গোটা দেশের মানুষ এখনও শোকে মুহ্যমান।
মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের আরও তথ্য আছে।
সেটি হলো নিহত সেনা কর্মকর্তাদের মৃত্যু নিশ্চিত জানার পরও ঘাতকের দল লাশের ওপর বেয়নেট চার্জ করে তাদের জিঘাংষা মিটিয়েছে। লাশ গুম করার উদ্দেশে তড়িঘড়ি করে গণকবর দেয়া হয় সেনা কর্মকর্তাদেরকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এখানেই শেষ নয়, নিহত সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের লাশ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখনও নিখোঁজ আছেন অন্ত:ত আরও ৫ জন সেনা কর্মকর্তা। স্বজন হারানো মানুষের আর্তনাদ আর আহাজারিতে সমগ্র দেশের বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।
পিলখানায় সংঘটিত ঘটনা বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। দেশবাসি কখনই এধরনের একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। ইনটেলিজেন্স ফেইলিওরের কারণে এতগুলো প্রাণহানি ঘটেছে বলে অনেকের অভিমত। এমনকি সেনাবাহিনীর অনেক কর্মকর্তাই এমনটা মনে করছেন। দেশে এতগুলো গোয়েন্দা সংস্থা থাকার পরও এতবড় একটা পরিকল্পিত ঘটনা ঘটে গেল তা কেউ টের পেলো না, এটা আমরা ভাবতে পারি না।
এটা একটা যুদ্ধের পরিস্থিতি। এই সংকট সফলভাবে মোকাবেলা করতেই হবে। নইলে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
পিলখানা থেকে কি পরিমাণ বিস্ফোরক, গোলাবারুদ ও অস্ত্র হারিয়ে গেছে তা আমরা এখনও জানি না। সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সকল রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিডিআর, মিডিয়াসহ দেশের জনগণ সকলেরই পজিটিভ ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
যেসমস্ত অস্ত্র গোলাবারুদ হারিয়ে গেছে এবং ঘাতকদের ধরতে সরকার রিবেল হান্ট নামে একটি অপারেশন শুরু করেছে ইতোমধ্যে। এই অপারেশনে যাতে কোন নিরীহ-সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার না হয় সে ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীকে সজাগ থাকতে হবে। এই অপারেশনের নামে যাতে ‘হাট এ্যাটাক’, ক্রসফায়ার এর পুনরাবৃত্তি ঘটানো যাবে না।
পিলখানা থেকে হারিয়ে যাওয়া অস্ত্র, গোলাবারুদ উদ্ধার করা না গেলে সেগুলো জনগণের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ হবার সম্ভাবনা থাকে। আমরা চাই একটা নিরপে ও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
যাতে ভবিষ্যতে এধরনের কোন ঘটনা আর না ঘটে। জাতীয় নিরাপত্তা রা ও সকল ষড়যন্ত্রের বেড়াজালকে ছিন্ন করাই হবে আমাদের সকলেরই প্রধান কাজ। সামরিক-বেসামরিক সকল প্রশাসনের সব রকমের মেশিনারিজ ও এফোর্ট ব্যবহার করে কালপ্রিটদের ধরে বিচারে সোর্পদ করার চেষ্টা করাই হবে সকলের নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এেেত্র প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে যেন কোন ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। সেদিকটায় বিশেষভাবে খেয়াল রখতে হবে।
পিলখানার ঘটনায় সরকার যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটি সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত থেকে স্বচ্ছভাবে তাদের তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলে আমরা আশা করছি। বিডিআর সদর দপ্তরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের তদন্ত যেন ‘ জজ মিয়া’ রকমের কোন তদন্ত না হয়। আমরা আশা করবো, তদন্ত রিপোর্ট মিডিয়ার মাধ্যমে জনসমে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার।
বিডিআর সদর দপ্তরের ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণে দেশবাসি মনে করছেন, সেনাবাহিনী ও বিডিআরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বিশেষ একটি মহল সরকার ও দেশকে একটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে চেয়েছিল।
সন্দেহ নেই, পিলখানার ঘটনায় দেশের অপূরণীয় তি হয়েছে। কিন্তু প্রচন্ড ােভ ও শোকের মধ্যেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা অকল্পনীয় সংযম, ধৈর্য্য আর সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের পরিচয় দিয়েছেন। এজন্য আমরা সেনা প্রধান মঈন উ আহমদকে ধন্যবাদ জানাই।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিচণ সিদ্ধান্ত আর সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন সংযমের এক দারুণ সম্মিলনে দেশ ও জাতি আরও ভয়াবহ কোন বিপর্যয় থেকে রা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সেদিন সাধারণ মা ঘোষণা না করলে হয়ত আজকে দেশের অবস্থা অন্য রকম হয়ে যেতো।
অথচ আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই ঐতিহাসিক সময়োচিত সিদ্ধান্ত-পদপেকে কৌশলগত ভুল বলে আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্র“য়ারির পৈশাচিক বর্বরতার সাথে আমরা সাদৃশ্য দেখতে পাই ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট, ৩ নভেম্বর, ২০০৪ সালের ২১ আগষ্টের হত্যাকান্ডের। এই ঘটনার বিচার করতেই হবে। পিলখানার ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেই হবে। পাশাপাশি একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ’৭৫ এর ১৫ আগষ্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা মামলার বিচারের রায় কার্যকর, ৩ নভেম্বর জেলহত্যা মামলার পুন:বিচার, ২১ আগষ্টের ঘটনার সাথে জড়িত কিলার ও নেপথ্যের পরিকল্পনাকারীদের বিচার করতে না পারলে এধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
দেশবাসি এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না।
পিলখানার নিষ্ঠুর, বর্বর ঘটনা পরবর্তী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার কথাবার্তাও দেশবাসির কাছে সন্দেহ সৃষ্টি করছে। খ্যাতিমান সাংবাদিক, কলামিষ্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অবশ্য ইতোমধ্যে বলেছেন যে, বেগম জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে না দিলে আবারও ১৫ আগষ্ট ঘটতে পারে। দেশবাসি চরম এক অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার মধ্য দিয়ে অপো করছেন পিলখানার ঘটনার সাথে জড়িত ও তাদের নেপথ্যের গডফাদারদের চিহ্নিত করে সরকার শিগগিরই তা জনগণের সামনে প্রকাশ করবে। দৃষ্টান্তশূলক শাস্তি পাবে খুনিচক্র।
দেশের মানুষ বিডিআর সদর দপ্তরের ন্যক্কারজনক ঘটনা নিয়ে কোন রাজনীতি চায় না। দেশবাসি চান, শান্তি এবং খুনিদের ষড়যন্ত্রকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। পিলখানার গণহত্যার পরিকল্পনাকারী অপরাধী, খুনিক্রকে দায়মুক্তি দেয়া চলবে না। #
লেখক: সাংবাদিক-মানবাধিকারকর্মী
http://www.humanrightstoday.info
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।