বিবৃতিটি সরাসরি তুলে দিলাম।
-----------------------------------------------------------------------------
২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ০৯ বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে বিবৃতি
তারিখ : ০৯ মার্চ ২০০৯
২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ০৯ বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রকাশার্থে ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রদান করেছেন। এরাঁ হলেন : বদরুদ্দীন উমর (চিন্তাবিদ ও রাজনীতিক), ফরহাদ মজহার (কবি ও প্রাবন্ধিক), ডা. ডট আলী (চিকিৎসক) প্রাণেশ সমাদ্দার (সাংস্কৃতিক সংগঠক), ড. আকমল হোসেন (অধ্যাপক), মামুনর রশীদ (নাট্যকার), শিবলী কাইয়ুম (রাজনীতিক), ফয়জুল হাকিম (রাজনীতিক), সজিব রায় (শিক্ষক), আদিলুর রহমান খান (আইনজীবী), হাসিবুর রহমান(অধ্যাপক) ও মাসুদ খান(রাজনীতিক)
১.
২৫ ফেব্রুয়ারী ঢাকার বিডিআর হেড কোয়ার্টারে এক বিদ্রোহ হয়েছে। বেতন ভাতা রেশনের স্বল্পতা এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার অভাবের বিষয় নিয়ে দীর্ঘ দিন বিডিআর জওয়ানদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছিল। তাদের চোখের সামনে অফিসারদের সুযোগ সুবিধার প্রাচুর্য ও দুর্নীতি তাদের মধ্যে এই ক্ষোভ তীব্রতর করছিল।
এর প্রতিকারের জন্য জওয়ানরা অফিসারদের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাবী দাওযা পেশ করার চেষ্টা করলেও তাঁদের চেষ্টা সফল হয় নি।
বিডিআর জওয়ানদের দাবী দাওয়াগুলি সঙ্গত ও তার ন্যায্যতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। এই ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায্য দাবী দাওয়া দীর্ঘদিন ধরে অপূর্ণ থাকা ও সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের উপেক্ষা তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ তীব্র করতে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। অর্থাৎ ক্ষোভ পরিণত হয় বিদ্রোহে।
ক্ষোভের মধ্যে স্বতস্ফুর্ততা থাকলেও এবং ক্ষোভকে অবলম্বন করে বিদ্রোহ ঘটলেও বিদ্রোহ কখনো নিতান্ত স্বতস্ফুর্তভাবে হয় না।
তার জন্য উদ্যোগ প্রয়োজন হয় এবং সে উদ্যোগ অল্প সংখ্যক লোকই গ্রহণ করে থাকে। ২৫ ফেব্রুয়ারীর বিডিআর বিদ্রোহ এদিক দিয়ে কোন ব্যতিক্রম নয়।
বিডিআর জওয়ানদের বঞ্চনা ও ক্ষোভকে অবলম্বন করেই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই বিদ্রোহ অল্প সময়ের মধ্যেই যেভাবে সহিংস আকার ধারণ করে নিরস্ত্র অফিসারদের নির্মম হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে এটা এই ধরনের বিদ্রোহের কোন স্বাভাবিক পরিণতি নয়। কাজেই জওয়ানদের ক্ষোভ এবং উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে এই নৃশংস হত্যাকান্ড খুব পরিকল্পিতভাবেই করা হয়েছে।
২.
জওয়ানদের বিক্ষোভ ও বিদ্রোহকে সমগ্র দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে পৃথকভাবে দেখা ঠিক নয়। বাংলাদেশে শ্রেণী বিভাজন ও শ্রেণী শোষণ নির্যাতন আছে এবং রাষ্ট্র ও সরকারের কোন সংস্থা ও সংগঠন এর আওতামুক্ত নয়। কাজেই বিডিআর-এ এই শ্রেণী বৈষম্য এক স্বাভাবিক ব্যাপার। এই স্বাভাবিক শ্রেণী বৈষম্য থেকে উদ্ভূত জওয়ানদের দাবী দাওয়া ও ক্ষোভকে ব্যবহার করে বিদ্রোহ ঘটানো হয়েছে। বিদ্রোহের এই শ্রেণীগত ভিত্তির কারণেই দেশের সর্বত্র শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে এই বিদ্রোহের প্রতি শুরুতে ব্যাপক সমর্থন ও সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল।
৩.
বিদ্রোহের মাধ্যমে জওয়ানদের অবস্থার প্রতিকার করা এই বিদ্রোহের প্রকৃত নায়কদের উদ্দেশ্য ছিল না। পরিকল্পিতভাবে হঠাৎ করে অফিসার হত্যা শুরু করে যে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল তার ফলে অর্ধ শতাধিক সামরিক অফিসারের নির্মম অকাল মৃত্যু ঘটিয়ে তাঁদের পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করা হয়েছে এবং সেই সাথে তা সামরিক বাহিনীকেও ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। কিন্তু লক্ষ্য করবার বিষয় যে, এর দ্বারা জওয়ানদের অবস্থারও কোন প্রতিকার হয় নি। তাদের মধ্যে যে অল্প সংখ্যক জওয়ান বিদ্রোহের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল তারা তো নিজেদের সর্বনাশ করেছেই, তার বাইরে প্রায় চৌদ্দ পনেরো হাজার জওয়ান ও তাদের পরিবারও বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাদের দাবী দাওয়ার বিষয়টি ধামাচাপা পড়েছে, উপরন্তু কর্মস্থলে রিপোর্ট সত্ত্বেও তাদের, ও বিশেষ করে তাদের পরিবারের লোকদের দূর্দশার শেষ নেই।
এর থেকে যা স্পষ্টভাবে দেখা যায় তা হচ্ছে, বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহের নামে সামরিক অফিসারদের হত্যা করা হয়েছে এবং এর ফলে জওয়ানদের লাভ হয় নি। পরিস্থিতির এই দুই দিকের তাৎপর্য বিবেচনা করা সহজ হবে যদি এ বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় যে, এই বিদ্রোহে মূল ভূমিকা পালন করেছে অল্পসংখ্যক জওয়ান এবং বহিরাগত কিছু সশস্ত্র লোক।
৪.
২৫ ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহ কোন সাধারণ বিদ্রোহ অথবা অরাজনৈতিক ব্যাপার নয়। এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক ব্যাপার। তবে একে এখন সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে যে রাজনৈতিক চরিত্র প্রদানের চেষ্টা চলছে তার কোন গ্রাহ্যতা নেই এবং তা নিন্দনীয়, কারণ এর দ্বারা সঠিক তদন্ত বিপথগামী ও প্রকৃত অপরাধীকে চোখের আড়ালে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থাই করা হচ্ছে।
এটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে প্রধানমন্ত্রী ২৫ তারিখে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে সেভাবেই কাজ করলেও বিদ্রোহের তদন্তের জন্য যে সরকারী কমিটি হয়েছে তাতে কোন রাজনৈতিক প্রতিনিধি নেই। যেহেতু বিডিআর বিদ্রোহ মূলতঃ একটি রাজনৈতিক ব্যাপার, এ কারণে তদন্ত কমিটিতে সর্বদলীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতিতে এই তদন্ত কাজ কখনোই সুষ্ঠু ও সম্পূর্ণ হতে পারে না।
বিডিআর এর কিছু লোক বাইরের কিছু লোকের সাথে পরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমে ২৫ ফেব্রুয়ারী বিদ্রোহ পরিচালনা করেছে। কে বা কারা এ কাজ করেছে এটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব না হলেও এর রাজনৈতিক চরিত্র বিষয়ে সন্দেহ পোষণ অবাস্তব ও দেশীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক। যে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে তার মাধ্যমে এটা মোটামুটিভাবে জানা সম্ভব যে, কারা এই ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত ছিল, কারা বিদ্রোহ পরিচালনার ক্ষেত্রে সামনে ছিল।
কিন্তু এর পেছনে কারা প্রকৃত পরিকল্পনাকারী এবং এই চক্রান্ত কারা করেছে এটা এই তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করা মোটেই সহজ নয়।
৫.
প্রকৃত পক্ষে জওয়ানদের ন্যায্য দাবী দাওয়া ও ক্ষোভকে অবলম্বন করে বিডিআর বিদ্রোহ ঘটিয়ে সামরিক অফিসারদের হত্যার মাধ্যমে একটি স্তরের চক্রান্ত ও পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, যাদের এভাবে বিদ্রোহের মূল পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য সরাসরি নিযুক্ত করা হয়েছে তারা নিজেরা ব্যবহৃত হয়েছে অন্যদের দ্বারা, যারা দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণের (remote control) মাধ্যমে এক সুচতুর রাজনৈতিক চক্রান্ত কার্যকর করার উদ্দেশ্যেই এ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে দুই স্তরের পরিকল্পনা তৈরী হয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের হত্যাকান্ড এবং এসব থেকে সৃৃষ্ট বিশৃংখল পরিস্থিতিকে অবলম্বন করে সারাদেশে নৈরাজ্য ছড়িয়ে দেয়া হলো এর দ্বিতীয় স্তরের চক্রান্ত ও পরিকল্পনার লক্ষ্য।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা যে বিডিআর এর এই ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ এমন নয়। অন্য ক্ষেত্রে এর পুনরাবৃত্তি ঘটানোও এই দূরবর্তী নিয়ন্ত্রণ শক্তির বৃহত্তর চক্রান্ত ও পরিকল্পনার অংশ। দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টির এই চক্রান্ত দেশের সকল জনগণের জন্যই এক অতি বিপজ্জনক ব্যাপার। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে বহির্শক্তি কর্তৃক এভাবে দেশে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
বাংলাদেশে এখন আভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলনের তাগিদ সর্ব স্তরের জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে।
এই তাগিদ বিশ্বের দেশে দেশে সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতি হিসেবে রেখেই সাম্রাজ্যবাদীরা বিভিন্ন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে এর মোকাবেলা করতে নিযুক্ত হয়েছে। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা দেখেছে যে শুধূ সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং র্যাব এর দমন পীড়নের দ্বারা জনগণের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও বিপ্লবী আন্দোলন ঠেকিয়ে রাখা বা নস্যাৎ করা সম্ভব নয়। তার জন্য এমন সামাজিক অবস্থা তৈরী করা দরকার যা এই ধরনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী প্রতিবন্ধক। এই প্রতিবন্ধক হলো সমাজে নৈরাজ্যের প্রাধান্য।
এই মুহূর্তে বিশৃংখলা ও নৈরাজ্যের থেকে গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও বিপ্লবী আন্দোলনের বড় প্রতিবন্ধক আর কিছু নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীরা দেশে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। পাকিস্তান এর একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। সেখানে যে তারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সকল প্রকার প্রগতিশীল আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করে রেখেছে তাই নয়, এর দ্বারা এমন নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে যাতে মার্কিনীরা এখন সেখানে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানের জনগণের ওপরই বোমা বর্ষণ করছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এখন সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে মধ্যপ্রাচ্যে পরিণত করার দিকে ঠেলে দিতে পারে ।
এদিক দিয়ে বুশ এবং ওবামার পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে কোন মৌলিক, এমনকি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। বাংলাদেশ সহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় এই চক্রান্ত এখন অগ্রসর হচ্ছে।
এই আন্তর্জাতিক ও দক্ষিণ এশীয় পরিপ্রেক্ষিতকে উপেক্ষা করে অথবা আড়ালে রেখে আমাদের দেশের পরিস্থিতিকে, বিশেষতঃ বিডিআর বিদ্রোহের মত ঘটনাকে দেখা অবাস্তব। কাজেই তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার সাথে সরাসরি কারা যুক্ত ছিল তাদের পরিচয় উদ্ঘাটনই যথেষ্ট নয়। এর পেছনে যে দূরবর্তী নিয়ন্ত্রকরা সক্রিয় আছে এবং এই দুই স্তর বিশিষ্ট চক্রান্ত কার্যকর করতে নিযুক্ত হয়েছে তাদের পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্য যা কিছু করা দরকার সেটা করা সকল গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক জনগণের এক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
বার্তা প্রেরক
ফয়জুল হাকিম, ০১৭১৩০৬৩৭৭৬
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।