পাশের রুম থেকে গোঙ্গানোর শব্দ আসছে।
একটু ভয় ভয় লাগছে ঋভুর।
রঙ্গীন পেন্সিল দিয়ে ড্রইং খাতায় আকিবুকি করছিলো। এমন সময় ওই শব্দটা। এতোদিনে অভ্যেস হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কেন যে হচ্ছে না! এখনও ভয় ভয় লাগে।
নানাভাই এ বাসায় এসেছেন ছয় মাসের উপর হয়ে গেল। কোনো সম্যস্যা হলে বা কোনো কিছুর দরকার হলেই মুখ দিয়ে অবোধ্য শব্দ করেন তিনি। চাপা গোঙ্গানির মতো শব্দটা শুনলেই গা কেঁপে উঠে ঋভুর।
আব্বু-আম্মু অফিসে। নানাভাইয়ের রুমে আছে মোতালেবচাচ্চু।
এ লোকটাকে রাখা হয়েছে নানাভাইয়ের দেখাশোনা করার জন্য। কিন্তু মোতালেবচাচ্চুটা এতো পাজি, মা-বাবা বাড়ি না থাকলে নানাভাইয়ের ধারে-কাছেও যায় না। বসে বসে একমনে টিভি দেখতে থাকে। বিছানায় পেশাব-পায়খানা করে পড়ে থাকে নানাভাই। এক এক সময় পাশের রুম থেকে দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে ঋভুর।
পরিষ্কার করতে বললে খেকিয়ে উঠে মোতালেবচাচ্চু,
অত দরদ থাকলে নিজে গিয়া সাফ করো। হালার বুইড়া, লড়েও না, মরেও না।
শেষের কথাটি নানাভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে মোতালেবচাচ্চু। কথা না বলতে পারলেও নানাভাই কিন্তু সবকিছুই বোঝেন। মোতালেবের এসব কথা শুনে তার দুচোখ বেয়ে পানি নেমে আসে।
নানাভাইয়ের জন্য ঋভুর বুকটা কেমন করতে থাকে। কিন্তু খালি বাড়িতে মোতালেবচাচ্চুকে কিছু বলার সাহস হয় না। এ লোকটিকে একটুও পছন্দ করে না ঋভু। একা থাকলেই ঋভুর সঙ্গে কেমন ধমকে কথা বলে মোতালেব। আবার মা-বাবা বাড়ি থাকলেই তার গলার স্বর পাল্টে যায়।
তখন ছুটোছুটি করে গিয়ে নানাভাইয়ের সব কাজ করতে থাকে। বিছানার চাদর পাল্টে দেওয়া, কাপর-জামা বদলানো, পরিষ্কার করা- সবকিছুই হয়ে যায় চোখের নিমিষে। ঋভুর সঙ্গে কথা বলে মিষ্টি সুরে। অসহ্য, অসহ্য.. ..
মোতালেবচাচ্চুর নামে মা-বাবার কাছে বিচার দিয়ে কোনো লাভতো হয়ইনি, বরং উল্টো ফল পেয়েছে। মোতালেবচাচ্চুর কাজ-কর্মে ভিষণ সন্তুষ্ট মা-বাবা ঋভুর অভিযোগ আমলেই আনেননি।
অন্যদিকে মা-বাবা অফিসে চলে যাওয়ার পর তাকে আচ্ছামতো শাসিয়েছে মোতালেবচাচ্চু। মা-বাবার কাছে আর কখনো তার নামে নালিশ জানালে ছয় তলার বারান্দা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে বলে ভয় দেখিয়েছে। এ ঘটনার পর সাবধানে বারান্দায় গিয়ে রেলিংয়ের নীচে তাকিয়ে দেখেছে ঋভু। বাব্বা! রাস্তাটা এতো নীচে! এখান থেকে পড়লেতো একেবারে ছাতু হয়ে যাবে। ছাতু জিনিসটা কি ঋভু জানে না, তবে বুঝতে পারে গুড়াগুড়া কিছু একটা।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এখন আবার মায়ের বদলে মোতালেবচাচ্চু ঋভুকে স্কুলে আনা-নেওয়া করে। আগে স্কুলে যাওয়া-আসাটা ছিলো কতো আনন্দের। আর এখন স্কুলে যেতেই মন চায় না। আর একবার স্কুলে ঢুকলে আর বাড়ি ফিরে যেতে মন চায় না। আসলে মোতালেবকে যতোটা ভয় পায়, তারচেয়ে অনেক বেশি ঘৃণা করে ঋভু।
আজকে আম্মু একটু আগেই ফিরে এসেছেন। আব্বু ফিরবেন কিছুনের মধ্যেই। নানাভাইকে কাপড় পরিয়ে তৈরি করছে মোতালেবচাচ্চু। হুইল চেয়ারে বসিয়ে পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবে। ডাক্তারের নির্দেশে প্রতিদিনই একবার বাইরে নিয়ে যেতে হয় নানাভাইকে।
সুযোগ মতো আজ বাড়িতে আম্মুকে একলা পেয়ে মনের দু:খের কথাগুলো বলতে শুরু করে ঋভু। তার কথা মানেতো মোতালেবচাচ্চুর নামে অভিযোগ। বরাবরের মতোই আমলে নেননা আম্মু। ঋভুর ছোট্ট মাথায় এটা ঢোকার কথা না যে মোতালেবকে পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন বাবা-মা। চলাচলের শক্তিহীন, বাকরুদ্ধ অসুস্থ্য এই বৃদ্ধকে নিয়ে অতল জলে পড়েছিলো এই চাকরিজীবী দম্পতি।
এ সময় মোতালেবকে পাওয়া যেন হাতে চাঁদ পাওয়া। ঋভুর মামুলি অভিযোগে মোতালেবের চাকরি যাবে না।
বেলের শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দরজা খোলে ঋভু।
গম্ভীর মুখে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকেন আব্বু। বেশ কিছুদিন ধরেই কোনো একটা বিষয়ে আব্বু-আম্মুর মধ্যে ঝগড়া চলছে।
সাধারণত ঋভুর সামনে তারা কখনো ঝগড়া করেন না। কিন্তু আজকে বাড়ি ফিরেই ফেটে পড়েন আব্বু,
'ঢাকা শহরেতো উনার আরো অনেক ছেলে মেয়ে আছে, কই তারাতো এখন কোনো খোঁজও নিচ্ছে না। জায়গা সম্পত্তি ভাগ করে দেওয়ার সময় ছেলেরা; আর অসুস্থ্য হয়ে এখন এসে পড়েছেন আমাদের ঘাড়ে। '
ঝগড়ার এক পর্যায়ে দুজনই গটমট করে ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করেন। যেন অন্য ভাষায় কথা বললেই সেটা ঋভু ধরতে পারবে না।
তারা ভুলেই যান, শহরের নামকরা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র ঋভু প্রায় ইংরেজদের মতো উচ্চারণে এ ভাষাটি বলতে পারে।
ঋভু বুঝতে পারে নানাভাইকে নিয়ে কথা হচ্ছে। আব্বু-আম্মু মনে করেন এখনো বুঝি ঋভু ছোট্টই আছে, কিছুই বোঝে না। তাদের জানা নেই, ছোটরাও অনেক কিছু বুঝতে পারে। এমনকী কখনো কখনো বড়রাও ছোটদের মতো করে বিষয়গুলো ধরতে পারে না।
এই যেমন মোতালেবচাচ্চু। মা-বাবার জানা নেই, তারা যখন বাড়ি না থাকে তখন নানা ভাইয়ের রুমে ডিভিডিতে মোতালেবচাচ্চু আজেবাজে ছবি দেখে। এমন আরো অনেক তথ্য ঋভুর জানা আছে, যা মা-বাবা কেউই জানেন না।
বাবার কথা শুনে সমান তেজে জবাব দেন আম্মু, যে ফ্যাটটিতে বসে এতো বড় বড় কথা বলছো সেটিওতো ওই বুড়ো লোকটির কাছ থেকেই হাত পেতে নিয়েছো। আমার বাবার জন্যতো তোমার কিছুই করতে হচ্ছে না।
মাইনে করা লোক দিয়েইতো তার সব কাজ করানো হচ্ছে।
বেশ কিছুণ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলে দুজনের মধ্যে।
মোতালেবের কঠোর ঋভুর হাতটা টন টন করে ব্যথা করছে। মুচড়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সে পারবে কেন! প্রতিদিন স্কুল গেটের কাছে এসে এভাবেই হাতটা চেপে ধরে মোতালেবচাচ্চু।
ঋভুর ভয় হয়, যে কোনো সময় মট্ করে তার হাতের হাড় ভেঙ্গে যাবে। যেমন ভেঙ্গেছে তার কাশের আয়ানের। বাঁ হাতে মস্ত প্লাস্টার আটা আয়ানকে এখন সব কাজ এক হাতেই করতে হয়।
আজকে কাশে রুমানা আপা এসেই একটা মজার কাজ করতে দিল। 'পেট' নিয়ে প্যারাগ্রাফ লিখতে হবে।
পেট কি সেটাও বুঝিয়ে দিলেন তিনি। বাড়িতে আমরা যেসব পশু-পাখিকে যত্নের সঙ্গে পালি তাদেরকেই পেট বা পোশা প্রাণী বলে। এসব পোষা প্রাণীদের আমরা যত্ন করি, খাবার খেতে দেই, বেড়াল বা কুকুরের মতো পশুগুলোকে প্রতিদিন নিয়ম করে বেড়াতে নিয়ে যাই, অসুস্থ্য হলে চিকিৎসা করাই, আমাদেও বাড়ির কেউ কেউ পোশা প্রাণীকে বেশি যত্ন করে; আবার কেউ বা এ প্রাণীকে অপছন্দ করে। প্যারাগ্রাফে এ কথাগুলোই গুছিয়ে লিখতে হবে।
কিছুণ কলম কামড়ে অনেক ভেবে চিন্তে সুন্দও করে প্যারাগ্রাফ লিখলো ঋভু।
তার লেখাটি খুব ভালো হয়েছে নিশ্চই নয়তো কেন রুমানা আপা এটা তার সঙ্গে দিয়ে দিল। মা-বাবাকেইবা দেখাতে বললো কেন! বাড়ি ফিরে সময় গুনতে থাকে ঋভু কখন আব্বু-আম্মু বাড়ি ফিরবেন। কি আশ্চর্য, আজকে দুজন এক সঙ্গেই অফিস থেকে ফিরেছেন। সময় নষ্ট না করে এক দৌড়ে মার কাছে গিয়ে হাতে ইংলিশ কাস ওয়ার্কের খাতাটা ধরিয়ে দেয় ঋভু। কপাল কুঁচকে ঋভুর লেখা প্যারাগ্রাফটা পড়তে থাকেন তিনি।
মুখটা থমথমে হয়ে যায়।
কাঁচা হাতে ঋভু লিখেছে, আমাদের বাড়িতে কোনো পোষা পশু বা পাখি নেই। আমাদের বাড়িতে একজন পোষা প্রাণীর মতো নানাভাই আছেন। আমার মা তাকে পছন্দ করেন, কিন্তু বাবা করেন না। বাড়িতে একজন লোক রাখা আছে তার দেখা-শোনার জন্য।
সে প্রতিদিনই নানাভাইকে বাইরে নিয়ে যায়। তবে সে নানাভাইকে অনেক কষ্ট দেয়। একটুও যত্ন করে না। আমি আমার পোষা নানাভাইকে খুব পছন্দ করি। আবার মাঝে মাঝে ভয় পাই।
মা নানাভাইকে বাড়িতে রাখতে চায়। আমিও চাই। বাবা চাননা। এ নিয়ে প্রায়ই তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়।
নি:শব্দে খাতাটা আব্বুর দিকে বাড়িয়ে দেন আম্মু।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।