বিশ্বব্যাপী পাটের সুদিন ফিরে আসছে।
পাটপণ্যের জাগরণ শুরু হয়েছে নতুন করে। মানুষ যত সচেতন হচ্ছে ততই ব্যবহার বাড়ছে পাটের। বাংলাদেশেও সেই হাওয়া লেগেছে। পাটকে নতুন করে চিনতে শুরু করেছে বিশ্বের মানুষ।পাট পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান প্রোডাক্ট পাটের বস্তা, এশিয়ান ক্লথ-যেগুলো কনস্ট্রাকশন কাজে নিরাপত্তা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ইরান, ইরাক, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপিয়ান বিভিন্ন দেশে এগুলোর চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া সিবিসি (কার্পেট বেকিং ক্লথ), কার্পেটের পেছনে পাটের আস্তরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কার্পেটের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে এর ব্যবহারও বাড়ছে। এদিকে আমাদের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি 'সয়েল সেভার' মাটির ক্ষয় রোধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এটা নতুন সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। রাস্তার মাটি ক্ষয় রোধের কাজে এটি ব্যবহার করছে তারা। পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যবহার করছে নদীভাঙন রোধে। এ ছাড়া আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সয়েল সেভার ব্যবহার করছে। হাতিরঝিল প্রকল্পে রাস্তা করার সময় রাস্তার পাড়ে সয়েল সেভার ব্যবহার করা হয়েছে।
সম্পূর্ণ দেশে উদ্ভাবিত এই পণ্যটি বিদেশেও সমাদৃত হচ্ছে। পাট পণ্যের ব্যবহার বাড়ার কারণে দেশের সরকারি পাটকলগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছয়টি বন্ধ পাট কল চালু করা হয়েছে। এতে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত কয়েক বছর ধরে পাটের আন্তর্জাতিক বাজার ভালো যাচ্ছে।
দিন দিন সেটা বাড়ছে। অনেক দেশ প্লাস্টিক ও সিনথেটিক পণ্য ব্যবহার কমিয়ে পাট পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশের পাটপণ্য বিভিন্নভাবে রপ্তানি হচ্ছে। শপিং ব্যাগ ছাড়াও শোকেজ আইটেম হিসেবে পাটের সামগ্রী বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পাটের জীবন নকশা উন্মোচনের ফলে বাংলাদেশ পাটের ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লোনা পানিতেও পাট উৎপাদন করা যাবে। এ ছাড়া পাটের আরও মিহি তন্তু উদ্ভাবনের মাধ্যমে সুতা তৈরির উদ্যোগও একসময় সফল হবে বলে মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, পাট থেকে স্বাধীনতাপূর্বকালে ৯৮ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। পরে সিনথেটিক পণ্যের বিস্তারের কারণে পাটের ব্যবহার কমে যায়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রেরণার অনুষঙ্গ ছয় দফা দাবির ব্যাখ্যাতেও ছিল পাটের প্রসঙ্গ।
এতে পাটের রপ্তানিমূল্য বর্তমান বাংলাদেশের এখতিয়ারে থাকার কথা উল্লেখ ছিল।
পাট এবং পাটপণ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে গতকাল সকালে মতিঝিলের বিজেএমসি ভবনে কথা হয় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজিএমসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল হুমায়ূন খালেদ (অব.) এর সঙ্গে। তিনি বলেন, বিজেএমসি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাট পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠান। প্রায় চার হাজার কর্মকর্তা, সাত হাজার স্টাফ এবং ৭৮ হাজার শ্রমিকের এই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন ৭ হাজার ৪২৫ টাকা। সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৩০৭ টাকা।
গত বছর জুন থেকে শ্রমিকদের ৭০ শতাংশ মজুরি বাড়ানো হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে আমাদের শ্রমিকদের ১৪ কোটি টাকা বেতন দিতে হয়। গত বছর দিতে হতো সপ্তাহে ৭ কোটি। আমরা বেসরকারি মিলগুলোর চেয়ে অনেক বেশি বেতন দিয়ে থাকি। তিনি বলেন, ২৭টি মিলের মধ্যে ১৮টি স্কুল ও চারটি মাদ্রাসা পরিচালনা করছে বিজেএমসি।
১৮টি দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা করা হচ্ছে। ক্রীড়াঙ্গনে সংস্থাটির বড় ভূমিকা রাখার কথা উল্লেখ করে বিজেএমসি চেয়ারম্যান বলেন, জাতীয় পর্যায়ে এই সংস্থার ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যবহ।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া মেজর জেনারেল হুমায়ূন খালেদ (অব.) এর আগে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) কমান্ডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে লাইবেরিয়া ও সিয়েরালিওনে কন্টিনজেন্ট কমান্ডার হিসাবেও কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। হুমায়ূন খালেদ বলেন, আমাদের খাদ্য গুদামগুলোতে ধান, চাল সংরক্ষণের জন্য পাটের ব্যাগ/বস্তা ব্যবহার অনেক বেড়েছে।
খাদ্য বিভাগ গত বছর আমাদের কাছ থেকে ৪০ লাখ বস্তা কিনেছে। এবার কিনেছে সোয়া তিন কোটি বস্তা। আমরা চেষ্টা করছি, বেসরকারি চাতালগুলোতে পাটের বস্তা ব্যবহারে উদ্বুব্ধ করতে। এটা করা গেলে ৫০ কোটি পিস বস্তার জোগান দিতে হবে প্রতি বছর।
বিজেএমসি চেয়ারম্যান বলেন, বিশ্বে পাটপণ্যের চাহিদা বাড়লে আমাদের মিলগুলোতে আরও নতুন জনবল নিয়োগ করা যাবে।
বর্তমানে আমরা আমাদের মিলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতার ৮০ ভাগ ব্যবহার করছি। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ১০ শতাংশ বাড়লে আমাদের পক্ষে আর এঙ্পোর্ট করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, আমরা আমাদের উৎপাদনের মাত্র ১০ ভাগ দেশে ব্যবহার করছি। ১৬ কোটি মানুষের দেশে পাট পণ্যের চাহিদা বাড়লে আমরা দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ে পরিবেশ সচেতনতার বিষয়ে আরও গুরুত্ব দেওয়ার কথা উল্লেখ করে (বিজিএমসি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল হুমায়ূন খালেদ (অব.) বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেতন করে তুলতে হবে।
তাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে গণমাধ্যমকেও ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পাটের সঙ্গে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে জড়িত। বর্তমানে ২৭টি মিলে প্রায় ৯০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। তাদের ওপর নির্ভরশীল প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। তিনি বলেন, পাট উৎপাদন করে কৃষক সবসময় ঠিক দাম পায় না।
আসলে পাট বিক্রির ক্ষেত্রে কিছু বিষয় কাজ করে। কৃষক তার প্রয়োজনে অপেক্ষাকৃত কমদামে পাট বিক্রি করে দেয়। সেটা দালাল বা ফড়িয়ারা কিনে মজুদ করে রাখে। এদিকে কৃষকরা যে পাটের বিক্রি মূল্য হিসাব করে তার সঙ্গে কিন্তু সোলার দামটা ধরে না। সেই সোলাটাও অনেক দামি।
এক মণ পাটের সঙ্গে দেড় থেকে দুই মণ সোলা পাওয়া যায়। গত কয়েক বছর ধরে এই সোলাও রপ্তানি হচ্ছে। পাটের পাতা শুকিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। আর পাটশাক তো এখন সারা দেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার হিসেবে পরিচিত। পাটের কোনো অংশই ফেলনা নয়।
তিনি বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে পাট কিনতে বিজেএমসির ১৭৫টি পাট ক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। বিজিএমসি চেয়ারম্যান বলেন, সরকার ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট ২০১০ করেছে। এতে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি পার্লামেন্টে পাস করা হয়েছে। কিন্তু কার্যকর করা যাচ্ছে না।
দেশে যদি এই আইনটি কার্যকর করা যেত তাহলে আমাদের দেশেই পাটপণ্যের ব্যবহার অনেক বেড়ে যেত। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করতে গিয়ে আমরা দরকষাকষি করতে পারতাম। তখন রপ্তানি মূল্যও বেশি পাওয়া যেত। এজন্য বাধ্যতামূলক প্যাকেজিং অ্যাক্ট বাস্তবায়ন করা খুব জরুরি। পলিথিন দূষণের ভয়াবহতা উল্লেখ করে মেজর জেনারেল হুমায়ূন (অব.) খালেদ বলেন, অনেক দেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশেও পলিথিন ও সিনথেটিক পণ্য ব্যবহারে কঠোর অবস্থান নিয়ে পাটপণ্যের বিকাশে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।