আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইতালির চলচ্চিত্রে নয়া বাস্তববাদ অথবা ফ্যাসিবাদী প্রচারণার অবসান

সকল অন্ধকারের হোক অবসান

ইতালিতে চলমান শ্রেণীসংগ্রামের বর্তমান অধ্যায়টি এমনই, যা কিনা- হয় বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতা দখলের, নয়তো বিত্তশালী শ্রেণী ও শাসক দলের উদ্যোগে সংঘটিত নিদারুণ প্রতিক্রিয়ার পূর্ব পর্যায়। (আনতোনিও গ্রামশি (১৮৯১-১৯৩৭), প্রবন্ধ:নবজন্মের অভিমুখে সোশ্যালিস্ট পার্টি, ১৯২০) গ্রামশির ভবিষ্যদ্বাণী আধা-আধি সত্যি হয়েই গেলো। কারণ বাক্যটার গঠনটাই এরকম, যে কোনো একটি অংশ সত্যি হবে। যাই হোক, গ্রামশির এ প্রবন্ধ রচনার দুই বছরের মাথায় ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর নেতা বেনিতো মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫) ইতালির রাষ্ট্র মতায় প্রধানমন্ত্রী রূপে যুক্ত হন। রাজা ভিকতর ইমানুয়েল চাপের মুখে এ সুযোগ করে দেন মুসোলিনিকে।

এরপর ১৯২৩ সাল থেকে মুসোলিনি ডিকটেটর হিসেবে তার রূপ দেখাতে শুরু করলেন। ১৯২৪ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিশ্চিত করে ফ্যাসিস্ট গ্র“প। তারপর থেকে চলতে লাগলো আরো চরম অত্যাচার। বিরোধী দলের সাংসদ, নেতা, কর্মী সবাইকে পড়তে হোলো ফ্যাসিস্ট পেটুয়া বাহিনীর কবলে।

নিহত হলেন বহু, কারাভোগে পাঠানো হোলো গ্রামশির মতো আরো অনেককে। এ রোষানল থেকে বাদ যায়নি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম। চলচ্চিত্রকেও সামিল করা হোলো ফ্যাসিস্ট প্রচারণায়। এ সকল কর্মকান্ডের দায়ভার থেকে গা বাঁচানো দূরে থাক, উল্টো দম্ভ করলেন মুসোলিনি: এই মুহূর্তে এইখানে দাঁড়িয়ে, এই বিধানমন্ডলী ও সমগ্র ইতালীর কাছে আমি জানিয়ে দিচ্ছি যে যা-কিছু ঘটেছে, তার প্রত্যেকটি ঘটনার জন্য আমি এবং একা আমিই যাবতীয় রাজনৈতিক, নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব গ্রহণ করছি। .. .. ফ্যাসিবাদ যদি এক অপরাধী ষড়যন্ত্র হয়, তবে আমিই তার প্রধান ষড়যন্ত্রকারী।

(সংসদ বক্তৃতা, ১৯২৫ এর তেসরা জানুয়ারি) ১৯২৭ সালে মুসোলিনির ইশারায় নির্মিত হয় ‘লু ইউনিওনে সিনেমাতোগ্রাফিয়া এদুকাতিভা’ (লুস) নামের এক সংস্থা। যার দায়িত্ব ছিলো তথ্যচিত্র ও সংবাদচিত্র পরিবেশনা। এই সংস্থা প্রথমেই নির্মান করলো মুসোলিনির উত্থান-ইতিহাস নিয়ে তিন পর্বের তথ্যচিত্র। লুস-এর প থেকে এরপর দুই প্রতিনিধিকে পাঠানো হোলো সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং হলিউডে। সিনেমাকে কীভাবে রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীভবনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা যায় এবং কোন কৌশলে মুনাফা করা যায়, এসব শিক্ষা নেয়ার জন্য।

তারপরই ১৯৩৩ সালে গঠন করা হোলো কেন্দ্রীয় চলচ্চিত্র পরিচালন সংস্থা ‘ডিজিসি’। ফ্যাসিবাদী সরকার সেন্সরের দায়িত্ব দিলো এ সংস্থাটিকে। কিছুটা আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, ডিজিসি কোনো সিনেমাকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়নি। তবে প্রয়োজনে চিত্রনাট্য পরিবর্তন বা রি-এডিটিং-এর নির্দেশ দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের হাত দিয়ে এসময়, মানে ১৯৩৩ সালেই সিনেমা মুক্তি পেয়েছে ৩৪ টি।

এ কালের সিনেমাগুলোর মধ্যে থাকতো হলিউডি প্রভাব: বাস্তবতাকে এড়িয়ে এক অলিক জগতবাস কিংবা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে নিয়ে কটা। ‘সাদা টেলিফোন’, ‘বাথটাবে সুন্দরী নায়িকা’, কার্পেট ও সোফাসজ্জিত ড্রইংরুম’ - এসব সিনেমা দেখলে মনে হোতো ইতালিতে সুখের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। ‘রেলগাড়ি’ সিনেমায় তো রীতিমতো উপহাস করা হলো মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ নিয়ে। সিনেমাটিতে দেখানো হয় হঠাৎ টাকা পেলে মধ্যবিত্তের অবস্থা হয় ‘অল্প পানির মাছ বেশী পানিতে পড়ার মতো’। বাস্তব ঘেষা এবং বঞ্চিত মানুষের পাঁচালি নিয়ে এসময় সিনেমা তৈরীর বাস্তবতা তৈরী হচ্ছিলো মাত্র।

কারণ ১৯৩৫ সালে ইতালিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় আধুনিক চলচ্চিত্র শিক্ষাকেন্দ্র ‘সেন্ট্রো’। এখানকার শিক্ষক ছিলেন আলেসান্দ্রো ব্লাসেত্তি ও উমবার্তো বারবারোর মতো গুণী ব্যক্তিরা। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন রবার্তো রোসেলিনি, মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি, জুসেপ্পি ডি সান্তিস, পিয়েত্রো জার্মি প্রমুখ। যারা পরবর্তীকালের প্রখ্যাত পরিচালক হয়েছেন। বলার আর অপো রাখে না ফ্যাসিবাদী রং এবং হলিউডি ঢং-এর বাইরে বেরুতে এবং সাধারণ মানুষের কথা বলতেই নয়া বাস্তববাদের আবির্ভাব।

একদিকে পৃথিবী জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগমনী ধ্বণি, ইতালির অভ্যন্তরে সমাজতন্ত্রী এবং ফ্যাসিবাদীদের চরম দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে ইতালির চলচ্চিত্রে নতুন কিছু জন্ম দেয়ার প্রসব বেদনা। ইতিহাসে এই ত্রিশের দশকটি বোধহয় একাই হাজারো ঘটনার জন্মদাতা। ভারতবর্ষে গান্ধির বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, সুভাষচন্দ বোসের একই লক্ষ্যে পৌঁছানোর ভিন্ন কিন্তু সাহসী চেষ্টা। সোভিয়েত রাশিয়া জার্মানের সাথে যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে আপাত স্থির বটে, তলে তলে প্রস্তুত হচ্ছে স্টেলিন এবং হিটলার দু’জনই। যুক্তরাষ্ট্র তখন চিলের দৃষ্টি নিয়ে পর্যবেক্ষণরত।

পুরো পৃথিবীতেই এক তীব্র বাজার সঙ্কট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে বেশীদিন হয়নি। ক্ষয়-ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে দেশগুলো। দুঃখ দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেই ত্রিশের দশকেই ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়া ইতালি আসেন দুই বছরের জন্য।

এসময় প্রভাবিত হলেন ইতালির তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীরা। রেনোয়া তৈরী করলেন যুদ্ধবিরোধী এবং মানবতাবাদী সিনেমা ‘ল গ্রঁদ ইলিউশঁ’ (১৯৩৭)। অনুপ্রাণিত হলেন লুসিনো ভিসকন্তি (১৯০৬-১৯৬৭)। ইতালিতে অবস্থানকালে রেনোয়ার সাথে কাজও করেছেন ভিসকন্তি। ১৯৩৯ সালে শুরু হোলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

ইতালি সেখানে অংশ নিলো ১৯৪০-এর জুন মাসে, হিটলারের দোসর হয়ে। এটা মেনে নিতে পারেননি অনেকেই। গঠিত হোলো ফ্যাসি-বিরোধী জোট। এমন এক অবস্থার মধ্যে ১৯৪২ সালে মুক্তি পেলো ‘ওসেসন’। ভিসকন্তির এ ছবিটিকেই ধরা হয় নয়া আঙ্গিকের সূচনা, অন্যভাবে বললে নয়া বাস্তববাদের মুখবন্ধ।

যদিও নয়া বাস্তবাদ শব্দবন্ধটি তখনো চালু হয়নি। ১৯৪৩ এ ‘ইল ফিল্ম’ পত্রিকায় উমবারতো বারবারো চলচ্চিত্রে ‘নয়া বাস্তববাদ’ শব্দবন্ধটি চালু করেন। ওদিকে, একই বছরে ইতালি বিভক্ত হয়ে পড়লো উত্তর আর দক্ষিণাঞ্চলে। উত্তরে অক্ষশক্তি এবং দক্ষিণে মিত্রশক্তি। ১৯৪৪ সালে ইতালির ভিতরকার অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে উঠলো।

মুসোলিনি নিরুপায় হয়ে পালাতে বাধ্য হলেন। আশ্রয় নিলেন জার্মান বাহিনীর একটি দলে। শেষ রক্ষা হোলো না। মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্মমভাবে নিহত হোন ফ্যাসিস্ট এই নেতা। ১৯৪৫ সালে শক্তিশালী হয়ে উঠলো বামদলগুলো।

ফ্যাসী বিরোধী লড়াই-সংগ্রামে সফল হওয়ার জন্যই বামদলগুলো পেলো জনপ্রিয়তা। ঠিক এ বছরেই চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ, নয়া বাস্তববাদী সিনেমাটি নিবেদিত হোলো: রবার্তো রোসেলিনির ‘রোম, ওপেন সিটি’। নয়া বাস্তববাদী জামানার সিনেমা চেনা যায় খুব সহজেই। সাধারণ মানুষের জীবন যাপন, তাদের সুখ-দুঃখ, বেদনা, মানুষের পারষ্পরিক সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা, তাদের মানসিক টানা-পোড়েন, সামাজিক কিংবা মানসিক তাড়নায় মানুষের মূল্যবোধ, তাদের আবেগ, মানবিকতা, ভালো লাগা মন্দ লাগা ইত্যাদি। মোট কথা হলিউডি ছকের বাইরে এসে অপেশাদার অভিনেতা দিয়ে জীবনের কথাই বলতে চেয়েছে এসময়ের সিনেমাগুলো।

যুদ্ধের ডামাডোলে জন্ম নেয়া চলচ্চিত্রের এ ধারাটি বাস্তবকে আকড়ে থেকেছে, আঁকতে চেয়েছে যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের মানুষে কাল-যাপনের চলচ্ছবি। দামী গাড়ি-বাড়ি ও’লা মানুষের জীবনকে সরিয়ে রেখে এ ধারার চলচ্চিত্রে আসতে থাকলো বস্তিতে থাকা মানুষের জীবন, যাদের কাছে একটি সাইকেল মানেই অন্ন-বস্ত্র এবং পরিবার পালন। নয়া বাস্তববাদী সিনেমার ক্যামেরায় লং শটের ব্যবহার, শাদা কালোর মধ্যে মানুষের চরিত্রের ত্রি-মাত্রিক উপস্থাপন, ফ্রেমে পার্সপেক্টিভের সফল যোজনা: গভীরে, চরিত্রের দারুণ গভীরে ঢোকার পথ সুগম করে দেয়, দর্শককে চিন্তাশীল করে তোলার ইন্ধন যোগায়। ক্যামেরা কৌশল, মিজ-অঁ-সিন, সাদা-কালোর প্রোপটে আলোক সম্পাত ও কম্পোজিশন, সবকিছু মিলিয়ে নয়া বাস্তববাদী সিনেমা সত্যিকার অর্থেই তখন হয়ে উঠেছিলো স্বতন্ত্র। যা স্থায়ী ছিলো ১৯৫২ সাল পর্যন্ত।

বলা হয় ১৯৫২ সালে নির্মিত ভিত্তোরিয়া ডি সিকার ‘উমবার্তো-ডি’ হোলো এ ধারার সর্বশেষ চলচ্চিত্র। ইতালিতে এরপর চলচ্চিত্র মোড় নিয়েছে ভিন্ন পথে। পেছনে তখন তার ঋজু ভঙ্গিমার এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। ভিসকন্তির ‘ওসেসন’ (১৯৪২) এর পর রসোলিনি যুদ্ধ ও যুদ্ধের ভয়াবহতাকে তুলে ধরেন: ‘রোম, ওপেন সিটি’ (১৯৪৫), ‘পাইসা’ (১৯৪৬) এবং ‘জার্মনিয়া আন্নো জেরো’ (১৯৪৭) এই তিন চলচ্চিত্রে। রসোলিনির পাশাপাশি ডি-সিকা উপহার দিলেন বুট পালিশ করে এমন এক কিশোরের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র: ‘শু শাইন’ (১৯৪৬)।

এ ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছিলেন জাভাত্তিনি। ‘শু শাইন’ এর পর ডি-সিকা হাজির করলেন নয়া বাস্তববাদী চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ উপহার: ‘দি বাইসাইকেল থিভ’ (১৯৪৭)। যুদ্ধ পরবর্তী বেকার শ্রমিকের জীবন সংগ্রাম নিয়ে নির্মিত এই সিনেমাটিতে ডি-সিকা ব্যবহার করেছিলেন অপেশাদার অভিনেতাদের। ফলে সিনেমার প্রধান চরিত্র অনেক বেশী সাধারণ মানুষের অনুভূতিতে মিশে যেতে পেরেছিলেন। ১৯৪৮ এ ভিসকন্তি বানালেন সিসিলি অঞ্চলের জেলেদের জীবন গাঁথা নিয়ে ‘লা টেরা ট্রিমা’।

১৯৫০ এবং ১৯৫২ সালে ডি-সিকা বানালেন যথাক্রমে ‘মিরাকল ইন মিলান’ এবং ‘উমবার্তো-ডি’। আগেই বলেছি ‘উমবার্তো-ডি’ চলচ্চিত্রটিই এ ধারার সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। অবশ্য ভারতে এ ধারার অনুসারী ১৯৫২-এর পরেও পাওয়া যায়। যেমন মহাত্মা সত্যজিৎ রায়। নয়া বাস্তববাদ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

সময়ের দাবীতেই এ ধারার উদ্ভব। ইতিহাসের সে সময়কে নয়া বাস্তববাদ যা উপহার দিয়েছিল তা সময়েরই দান। বিশ্বের লাখো শিল্প-পিপাসু মানুষ সময়ের সাথে সাদরেই গ্রহণ করেছিলেন সেই নয়া বাস্তববাদের দেয়া উপহার, চলচ্চিত্রগুলোকে। এতে নির্মাতারা ঋণী হয়েছিলেন নিশ্চয়। মানুষের যে ভালোবাসা এখনো বহমান তাঁদের জন্য তাতে তাঁরা ঋণী না হয়ে পারেন!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.