কাঠগড়ায় কংগ্রেস। কাঠগড়ায় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউ পি এ সরকার।
২০শে তাই চার্জশিট দিয়েছেন দেশের মানুষ।
অভিযোগ বিশ্বাসঘাতকতার। অভিযোগ প্রতিশ্রতিভঙ্গের।
বিশ্বাসঘাতকতা ? বিশ্বাসঘাতকতা নয়!
কি রায় ছিল দেশের মানুষের? সাম্প্রদায়িকতার হিংস্র মুখটাকে কিছুদিন আড়ালে সরিয়ে রেখে ‘ঝক্মকে ভারত’-এর স্লোগান নিয়ে যারা মাঠে নেমেছিলেন, গত লোকসভা নির্বাচনে তাদের মানুষ সাফ রায় দিয়েছিলেন। দেশের অধিকাংশ মানুষের স্পষ্ট রায় ছিল এটাই, তোমাদের ‘সোনালী ভারত’ মানে আত্মহত্যাম করা কৃষকের সারি সারি লাশ, তোমাদের ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’-র অর্থ হলো গুজরাট গণহত্যা । ‘উজ্লা ভারত’-এর স্লোগানের আড়ালে তোমাদের দেশ বেচার ফন্দি, দুনিয়াজুড়ে দখলদারি কায়েমে আমেরিকার যুদ্ধজোটে ছোট শরিক হওয়া। দেশের লাভজনক সরকারী সংস্থা মুনাফালোভী দানব বহুজাতিকের হাতে তুলে দেওয়া, বিশ্বায়ন-বেসরকারীকরণ-নয়া উদারীকরণের ধ্বজা ওড়ানো। অতএব তোমরা আর না।
মানুষের খন্ডিত রায়ে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে একমাত্র লড়াকু শক্তির স্বাধীনোত্তর ভারতের সংসদে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনপ্রাপ্তি এবং একমাত্র তাঁদের সমর্থনেই দেশের সরকার গড়া সম্ভব, এমন পরিস্থিতির উদ্ভব।
হ্যাঁ , এই প্রেক্ষাপটেই বামপন্থীদের সমর্থনে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউ পি এ-র সরকার গঠনের প্রস্তুতি। তখনও মনমোহন সিং-এর বাড়ির ঠিকানা ১৯, সফদরজং রোড থেকে পরিবর্তিত হয়ে ৭, রেসকোর্স রোড হয়নি। ২০০৪ সালের ২০শে মে সাতসকালে ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন (বলা চলে মানুষের রায়কে মনে রেখে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন), তা আজ ওঁর মনে নাও থাকতে পারে। কিন্তু টি ভি চ্যাবনেলের সরাসরি সম্প্রচারের দৌলতে দেশের মানুষের মনে হয়েছিল, হ্যাঁ , আমাদের রায়কে তাহলে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।
মনমোহন সেদিন বলেছিলেন, ‘‘ আমাদের অগ্রাধিকার থাকবে গরিবি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। আমাদের কাজের কেন্দ্রবিন্দু হবে গরিব, গ্রামীণ ও কৃষিক্ষেত্র। ’’ বলেছিলেন, ‘‘বেসরকারীকরণ আমার আদর্শগত দায়বদ্ধতা নয়। ...সংস্কার প্রয়োজন, কিন্তু তা এমনভাবে করতে হবে যাতে তার সুফল যাতে আম আদমি-র কাছে পৌঁছায়। ’’ সেদিনের কথাগুলিই পরে আরো বিস্তারিতভাবে রূপ পেয়েছিল সাধারণ ন্যুনতম কর্মসূচী(সি এম পি)-তে, যা রূপায়ণের শর্তেই সমর্থন দিয়েছিলেন বামপন্থীরা।
সি এম পি-তে প্রতিশ্রুতি ছিল: ‘‘ ইউ পি এ সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলির দামবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। ফট্কাবাজ, মজুতদার এবং কালোবাজারীদের ঠেকাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আইনকে কোনমতেই শিথিল করা হবে না। ’’ গত চার বছরে এবিষয়ে সরকারের ভূমিকা কী ? মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১৩ শতাংশ, গত ষোলো বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জায়গায়। জিনিসের দাম এই সময়ে বেড়েছে দ্বিগুণ, তিনগুণ হারে। খাদ্যশস্যসহ কৃষিপণ্যে ফট্কাবাজির রমরমা চলছে।
কৃষিপণ্যে ফট্কাবাজি রোধে খাদ্য, ক্রেতাবিষয়ক ও গণবন্টন মন্ত্রকের সংসদীয় স্ট্যাণন্ডিং কমিটির সুপারিশ ছিল ২৫টিতে আগাম বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা। অথচ, বামপন্থীরা বার বার দাবি জানানো সত্ত্বেও গত মে মাস পর্যন্ত মাত্র ৪টিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। রেশন ব্যবস্থা কার্যত উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মানুষের জীবন আরো অসহনীয় হয়েছে, মানুষ দেখেছেন সরকার নির্বিকার।
অগ্রাধিকার থাকার কথা ছিল গরিবি দুর করতে, বেকারী প্রশমিত করতে, কৃষকদের ভয়াবহ সমস্যা মোকাবিলায়।
কিন্তু কি চিত্র এখন? খোদ কেন্দ্রীয় সরকারের সমীক্ষাই বলছে, দেশের ৭৭ শতাংশ মানুষ, যার সংখ্যার প্রায় ৮০ কোটি, তাদের দৈনিক আয় ২০ টাকারও কম। গোটাদেশে কর্মসংস্থান কমেছে, ভয়াবহ অসাম্য, বৈষম্য, এমনকি খাদ্য নিরাপত্তাতেও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দেশের অর্থনীতি দৌড়োচ্ছে ৯ শতাংশ বিকাশের হার নিয়ে, আর বাস্তবে গত ৪ বছরে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মসঙ্কোচন হয়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ। কৃষিক্ষেত্রে উদারীকরণের নীতির ভয়াবহ বহির্প্রকাশ ঘটেছে কৃষকদের আত্মহত্যা র মধ্যে দিয়ে। ন্যা শনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে, ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে ১ লক্ষ ৬৬ হাজার ৩০৪ জন কৃষক আত্মহত্যায় করতে বাধ্য হয়েছেন।
২০০২ সাল থেকে প্রতি ৩০ মিনিটে ১ জন করে কৃষক তার জীবনকে পৃথিবী মুছে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রতিশ্রতি ছিল: দেশের শ্রমজীবীদের ৯৩ শতাংশই যারা, সেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও ক্ষেতমজুরদের সম্পূর্ণ সামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে দু’টি পৃথক আইন তৈরি করা। কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা হলো, অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য নাম কা ওয়াস্তে একটি বিল তৈরি করে তাকে হিমঘরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি শ্রম দপ্তরের স্ট্যাকন্ডিং কমিটি এবিষয়ে যে সুপারিশগুলি করেছে, তাকেও কোনোরকম তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ক্ষেতমজুরদের জন্য আইন তো দুর অস্ত্।
রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতিই বা কোথায় গেলো ? বলা হয়েছিল: ‘‘সাধারণভাবে লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে বেসরকারীকরণ করা হবে না। ’’ তাহলে এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়া কি লোকসানে চলে? যে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বছরে নিট মুনাফা ৪৪৮ কোটি টাকা, আর যে লাভের ৮০ শতাংশই আসে দিল্লি, মুম্বাই আর চেন্নাই বিমানবন্দর থেকে, সেগুলো আধূনিকীকরণের নামে বিক্রি করতে বিদেশী বহুজাতিককে ডেকে আনা কেন ? বামপন্থীদের চাপে শেষপর্যন্ত কলকাতাসহ চেন্নাই বিমানবন্দরের বেসরকারীকরণ আটকালেও রোখা যায়নি দিল্লি ও মুম্বাইকে। ৫২৬১ কোটি টাকার বিশাল মুনাফাকারী এন টি পি সি-র মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার কোন প্রয়োজনে বাজারে বিক্রি, তা বোধগম্য হয়নি মানুষের।
চেষ্টা হয়েছে আরো। আটকেছেন বামপন্থীরা।
ব্যাগঙ্ক, বীমা, পেনশন তহবিল, ভবিষ্যনিধি বেসরকারী হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা ছিল প্রথম দিন থেকেই। পারেনি, কারণ বামপন্থীরা ছিল সতর্ক। শ্রমিকদের ওপর কর্পোরেট প্রভুদের দৌরাত্ম্য বাড়াতে চেষ্টা ছিল শ্রম আইনগুলিকে শিথিল করার। পেছনের দরজা দিয়ে চেষ্টাও হয়েছে অবিরত। যতটা সম্ভব রুখেছেন বামপন্থীরা।
কেন্দ্রের প্রছন্ন সায়ে ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির প্রত্যক্ষ মদতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানে, এমনকি সংগঠিত ক্ষেত্রেও শ্রমিকদের ওপর হিংস্র আক্রমণ নামিয়ে আনার ঘটনা ঘটছে।
সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে, দেশের দীর্ঘলালিত স্বাধীন বিদেশনীতিকে জলাঞ্জলি দেওয়ায়। বি জে পি-র পথেই কংগ্রেস নেতৃত্ব হেঁটেছে আমেরিকার তোষামোদে। পরমাণু চুক্তির নামে স্বাধীনতার পর থেকে চলা সহমতের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ বিদেশনীতি থেকে সরে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক জোটসঙ্গী গড়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। অথচ, সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচীতে স্বাধীন বিদেশনীতি অনুসরণের সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল, ছিল বহুমেরু বিশ্বের ধারণাকে পুষ্ট করার কথা।
তার বদলে যে দেশ ইরাকে, আফগানিস্তানে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গণতন্ত্রকে পদদলিত করছে, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির প্রভাব যে ভয়ঙ্কর হবে, সেই সতর্কবার্তা বার বার জানিয়েছিলেন বামপন্থীরা। বামপন্থীরা বলেছেন, এই চুক্তির ফলে ১০০ কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারত আমেরিকার যুদ্ধজোটে মিত্র হওয়ার ফলে গোটা পৃথিবীর ভারসাম্য টলে যাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে। এই ঘটনা আমরা কখনই মেনে নিতে পারি না। এবং মানেননি তাঁরা, সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যানহার করেছেন।
আগেই সি এম পি-তে দেওয়া প্রতিশ্রুতির ভূলে যাওয়ার চেষ্টা ছিল।
আর ৮ই জুলাইয়ের পর মনোভাব ‘গোল্লায় যাক সি এম পি’। তাই আস্থাভোটে জুয়াচুরি করে জেতার পরদিনই, ২৩শে জুলাই অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের বন্ধনমুক্তির উল্লাস। বণিক সভা ফিকি-র বৈঠকে গিয়ে তিনি বলছেন, ব্যা ঙ্ক-বীমা-পেনশন তহবিলকে বেসরকারীকরণের লক্ষ্যে আনা বকেয়া বিল তিনটি সংসদের পরের অধিবেশনেই পেশ করা হবে। একটি অংশের বাধায় এগুলো বকেয়া থেকে গেছে। এদিকে, মাত্র ৭দিনের মাথায় কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ম্যানেজারের তালিকায় ঢোকানো হলো ভায়া অমর সিং ‘নতুন মিত্র’ অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ক্যাপিটালকে।
পাইপলাইনে আছে আরো অনেক কিছুই, যা সরকার গড়ার সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিপরীতমুখী।
এর পরেও বলবেন বিশ্বাসঘাতকতা নয়? দেশের মানুষের সঙ্গে এই প্রতারণার মাশুল গুণতে হবে কংগ্রেসকে, যেমন গুণতে হয়েছিল ১৯৯৬ সালেও। তার থেকে শিক্ষা নেয়নি, কারণ ওদের ভবি ভোলবার নয়। আসলে পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন-বেসরকারীকরণ-নয়া উদারীকরণের পথে হাঁটা কংগ্রেস যে মানুষের স্বার্থের নীতিতে অবিচল থাকতে পারে না, তা বামপন্থীরাও জানতেন, জানেন দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষও। তাই ওদের সরকারের ঘোষণা করা ‘জাতীয় সাধারণ ন্যুনতম কর্মসূচী’ ওরাই এখন আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে চাইছে।
আর সেই সাধারণ ন্যুনতম কর্মসূচী রূপায়ণের শর্তে প্রতিনিয়ত চাপ দেওয়ার পাশাপাশি বামপন্থীদের বিশ্রামহীন লড়াই চলেছে সংসদের ভেতরে ও বাইরে। লড়াই চলেছে উদারীকরণের নীতির বিরুদ্ধে, যার শুরু ১৯৯১ সাল থেকেই।
২০শে আগস্ট ছিল সেই লড়াইয়েরই একটা ধাপ, যার মধ্যে দিয়ে আরো বড় লড়াইয়ের শুরু। ১৯৯১ সালের ২৯ শে নভেম্বর বিশ্বায়ন-বেসরকারীকরণ-নয়া উদারীকরণের নীতির বিরুদ্ধে প্রথম দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ সাধারণ ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষ জানান দিয়েছিলেন যে, মানছি না সাম্রাজ্যবাদের প্রেসক্রিপশন অনুসারী তোমাদের এই নীতিকে। তারপর থেকে ২০০৬ সালের ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১১ বার দেশজুড়ে ঐক্যবদ্ধ সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে।
২০শে আগস্ট ছিল ১২ তম। প্রতিবারই ধর্মঘটের পরিধি বেড়েছে, যোগ দিয়েছে নতুন নতুন মিত্র। এবারের পরিধি হয়েছে আরো বড়, ধর্মঘটের সাফল্যও ছিল ব্যা পকতর। আর তা হবে বুঝেই পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনের পুরনো খেলায় নেমেছিল কংগ্রেস।
কিন্তু ওদের বিসমিল্লায় গলদ একটাই।
অভিজ্ঞতা থেকে শেখার অভ্যা স নেই যে কংগ্রেসের! গত লোকসভা নির্বাচনের আগে সরকারী কোষাগারে জমা হওয়া জনগণের ৪০০ কোটি টাকা খরচ করে ‘ঝক্মকে ভারত’-এর বিজ্ঞাপন দিয়েও বি জে পি-র শেষরক্ষা হয়নি। তল্পি-তল্পা গোটাতে বাধ্য করেছিলেন দেশের মানুষ।
কংগ্রেসেরও কি প্রহর গোনা শুরু হয়নি ? ২০শে আগস্ট তা সজোরে তা জানান দিয়েছে।
গণশক্তি, ২১শে আগস্ট, ২০০৮, উত্তর-সম্পাদকীয়
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।