সংহতি দিবসের দিকে চোখ ফেরানো যাক ।
অনেকেই সংহতি দিবসের উৎপত্তি জানেন না । জানেন না কত গুরুত্বপূর্ণ এই দিন – জানেন না বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা জড়িত এই দিনের সাথে ।
তার আগে আমাদের মৌলিক কিছু জিনিস জানতে হবে । *
পাকিস্তান আর্মির একজন মেজর – মেজর তাহের ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানের মাটিতেই ক্যান্টনমেন্টে নজরবন্দী হয়ে ছিলেন । একাধিকবার চেষ্টায় বর্ডার ক্রস করে আরও দুইজন আর্মি অফিসারের সাথে কেটে পড়েন তিনি পাকিস্তান থেকে ।
মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব নেন ১১নং সেক্টরের কামান্ডার হয়ে ।
প্রথম থেকেই মেজর তাহেরের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমাজতান্ত্রিক । তাঁর লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হাল্কা পালটে সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার ।
তাতে এক ধাক্কায় স্বাধীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম হবে । মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে মেজর জিয়ার সাথে এব্যাপারে তিনি আলোচনাও করেছিলেন । জিয়া তাকে পরোক্ষভাবে সাপোর্টই করেন । তবে সেসবের প্রতিফলন অনেক পরের গল্প ।
বলাই বাহুল্য – প্রতিটি অফিসারই তাঁর চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন না ।
কাজেই সরাসরি না এগিয়েও তাঁর চেতনা তিনি ছড়িয়ে দিতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে । বেশ ভালো গ্রহণযোগ্যতাও পেয়ে যান ।
সমরে অসাধারণ নেতৃত্বের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাহের ।
*
কামালপুর দখলের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় মেজর তাহেরের ।
জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম কামালপুর – জেলার মধ্যে পাকবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ।
সীমান্তের সবচেয়ে কাছে হওয়ায় এই ঘাঁটির বিজয় সহজ করে দিতে পারে ভেতরে ঝটীকা আক্রমণের ।
বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টার পরও মুক্তিযোদ্ধারা ব্যার্থ হন এই ঘাঁটি দখলের । জুলাই মাসের শেষে সবচেয়ে বড় হামলার পরও মেজর জিয়াউর রহমানের বাহিনীও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন ।
১৪ই নভেম্বর , ১৯৭১ ।
মেজর তাহেরের জন্মদিন ।
তিনি চান কামালপুর ঘাঁটি দখল করে সেখানেই উদযাপন করবেন জন্মদিন ।
কমান্ডারের কোডনেম ঠিক করা হয় ‘কর্তা’ ।
যৌথ ভারত-মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী আজ অ্যাকশনে ।
বাহিনীর পিছন থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন মেজর তাহের ।
যথেষ্ট সফলতার সাথে শুরু হয় দ্বিতীয় উদ্যোগ কামালপুর ঘাঁটি দখলের ।
সেকেন্ড লে. মিজান মাঝে মধ্যেই কমান্ডের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন আপডেট ।
সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মিজান একপর্যায়ে ওয়াকিটকিতে বলেন, ‘কর্তা – আমরা পাক বাংকারের একেবারে কাছাকাছি । আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই সরাসরি পাক বাংকারে চার্জ করতে যাচ্ছি। ’
পরমুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে যায় ওয়াকিটকি ।
বার বার প্রশ্ন করেও কোন রেসপন্স পান না কর্ণেল তাহের ।
মরিয়া হয়ে উঠে পড়েন তিনি ।
পেছনের কমান্ডিং বাংকার থেকে বেড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান তিনি ।
ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ব্যাপারটি লক্ষ্য করে হুংকার ছাড়েন , ‘হোয়াট আর ইউ ডুইং কর্তা । ইউ ক্যান্ট মুভ ফ্রম ইয়োর প্লেস’
– থামেন না তাহের - ‘আই মাস্ট ফাইন্ড লে. মিজান – মাই ফ্রন্ট লাইন ফাইটার’
*
লে. মিজান সাড়া দেন ওয়াকিটকিতে বেশ কিছুক্ষণ পর ।
তিনি জানান যান্ত্রিক গোলযোগে যন্ত্রটি কাজ করছিল না বলেই এই বিপত্তি ।
তাহের তখন উঁচু এক ঢিপির মাথায় উঠে নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন , অসীম আত্মবিশ্বাসে তিনি বেপরোয়া ।
হঠাৎ একটি শেল পড়ে – সেই সঙ্গে ছিটকে পড়েন তাহের । ভাই বেলাল ছুটে এসে অবস্হা দেখে ওয়াকিটকিতে বলে বসেন, ‘কর্তা মারা গেছেন – কমান্ডার হ্যাজ বিন কিলড’
কিন্তু মারা যাননি তাহের ।
খন্ডিত পা নিয়ে স্ট্রেচারে যখন তাকে তুলে নেওয়া হল বিদ্রুপের একটা হাসি মুখে ঝুলিয়ে নির্দেশ দেন, ‘আমি বলিনি, ওরা কখনো আমার মাথায় আঘাত করতে পারবে না। এই দেখো পায়ে লাগিয়েছে ।
মাই হেড ইজ স্টিল হাই । গো ফাইট দি এনিমি । ওকুপাই কামালপুর বিওপি । ’
*
যুদ্ধ শেষ – কিন্তু তাহেরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি ।
বাংলাদেশ সমাজতন্ত্রের পাশ দিয়েও যায় নি ।
মেজর তাহের আজ কর্ণেল তাহের ।
নকল একটি পা লাগিয়ে ক্রাচে ভর করে চলাফেরা করেন তিনি ।
মনের মত স্ট্র্যাটেজির একটি সমাজতান্ত্রিক দল খুঁজেও হতাশ তিনি । তাঁর চিন্তাভাবনার সাথে মেলে না অন্যদের চিন্তা ।
অবশেষে কোন একটা দল পেলেন তাঁর চিন্তাধারার ।
যোগ দিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল - জাসদে ।
তবে সেনাবাহিনীতে থেকে তখনও অবসর নেননি তাহের ।
কাজেই তাঁর নাম গোপন রাখা হয় দলের প্রধান কর্মীদের সারি থেকে ।
দেশের মধ্যে আনা সমাজতান্ত্রিক অভূত্থানের জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র একটি দিক ।
তার লক্ষ্যেই সংগোপনে এগিয়ে যায় ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ তৈরীর কাজ ।
সাধারণ সৈনিকরাই যোগ দেয় এই দলে ।
ক্যান্টনমেন্টের একটা বড় অংশ কর্ণেল তাহেরের অনুগত হয়ে যায় সবার অগোচরেই ।
*
স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ যাচাই করে যাচ্ছেন ।
অবশেষে বাকশালে থিতু হলেন তিনি । খন্দকার মোশতাক আগে থেকেই শেখ মুজিব বিরোধী আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ক্রিয় কিন্তু উপেক্ষার অযোগ্য রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব ছিল ।
তাকে কেন্দ্র করে মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদ পরিকল্পনা করে এক ষড়যন্ত্রের ।
১৫ই আগষ্ট নিহত হলেন মুজিব ।
ট্যাংক এবং কামানের জোরেই দেশের ভবিষ্যৎ পালটে দিল মেজর ফারুক ও রশিদের বাহিনী ।
বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিল খন্দকার মোশতাক ।
অচিরেই বন্দি করা হল প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীন আহমেদসহ চার নেতাকে ।
*
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডে – খন্দকার মোশতাকের মত মানুষের ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ ছিলেন সেনাবাহিনীর অনেকেই ।
ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এমনই দুইজন ব্যক্তিত্ব ।
মিলিটারি অভ্যুত্থানের পর ধ্বংস হয়ে যাওয়া চেইন অফ কমান্ড ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পরিকল্পনা করেন তাঁরা ।
আর্মি চীফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন । তিনি নিষ্ক্রিয় ।
ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত তাঁর কাছে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, ‘লেট আস ওয়েট এন্ড সী’
ক্ষুব্ধ শাফায়াত এবং খালেদ মোশাররফ পরিকল্পনা করেন চেইন অফ কমান্ড ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করবেন তাঁরা । বিতাড়িত করবেন খন্দকার মোশতাকের সরকারকে ।
খালেদ মোশাররফ অধীনস্থঃ সবাইকে বার বার মনে করিয়ে দেন ।
‘এই অভ্যুত্থানে কোন রক্তপাত হবে না । ’
*
২রা নভেম্বর, ১৯৭৫ ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহর একটি দল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায় যান তাঁকে বন্দী করতে ।
রাতের পোশাক পড়া জিয়াউর রহমান বেড়িয়ে দেখেন তাঁর ব্যাক্তিগত রক্ষীরা আত্মসমর্পণ করেছে । এগিয়ে আসেন ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহ, ‘স্যার – আপনি চীফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফের নির্দেশে বন্দি । ’
নিচতলার ড্রয়িং রুমের টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় ।
মেজর জেনারেল জিয়া পদত্যাদ করেন , হয়ত ঘটনার গতিপথ বুঝেই ।
তবে পদত্যাগ জীবনের নিরাপত্তা দিচ্ছে না তাঁর – এ তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পারেন ।
সেনাবাহিনীর প্রধান হন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ।
*
বঙ্গভবনের চারপাশ থেকে মোসতাক বাহিনীর নিরাপত্তা বলয়ের আর্টিলারি সরে যায় খালেদ মোশাররফের অদৃশ্য ইঙ্গিতে ।
নৌবাহিনী আর বিমানবাহিনী যোগ দিয়েছে খালেদ মোশাররফের সঙ্গেই ।
মেজর জিয়া – যাকে নিজ হাতে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান বানিয়েছেন মোশতাক – তিনি তো খালেদ মোশাররফেরই বন্দি ।
মোশতাক আঁচ করেন – এ হয়ত আওয়ামী লীগেরই পরবর্তী চাল । চার নেতার চক্রান্ত ।
মুজিব হত্যা করে সরকার দখলের পেব্যাক ।
সম্পূর্ণ ভুল ধারণার ওপর নতুন ভিত্তি ঠিক করে - টেলিফোনে মোশতাক যোগাযোগ করেন খালেদের সঙ্গে ।
মেজরদের – যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে তাদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য প্লেন দেওয়ার চুক্তি করে মোশতাক – নিজেদের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলার বিনিময়ে।
খালেদ মোশাররফ রক্তপাত চান না । তাছাড়া বিদ্রোহীরা চুক্তিতে আসতে চাইছে ।
কাজেই রাজি হয়ে যান তিনি ।
*
পদত্যাগের আগের রাতে ছোট্ট একটা কাজ করে যান জিয়াউর রহমান ।
হাফিজুল্লাহ জানতেন না – বেডরুমে আরেকটি টেলিফোন আছে ।
জিয়াউর রহমান একটি মাত্র ফোন কল করলেন ঝুঁকি নিয়ে ।
কর্ণেল তাহেরের কাছে ।
তাহেরের হাতে ফোন আসতেই তিনি মাত্র তিনটি বাক্য উচ্চারণ করলেন ,
‘তাহের, লিসেন কেয়ারফুলি । আই এম ইন ডেঞ্জার । সেভ মাই লাইফ ।
’
*
মোশতাক এবং খালেদ মোশাররফের চুক্তির বেশি পরে নয় – মেজর ফারুকের বিশ্বস্ত রিসালদার মোসলেউদ্দীন – যে নিজ হাতেই হত্যা করেছে শেখ মণিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চলে যায় একটি দলকে নিয়ে ।
খন্দকার মোশতাকের নির্দেশে ।
জেলখানায় বন্দিদের হত্যার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করতে গেলে বাধা দেন জেলের আইজি, ডিআইজি এবং জেলার ।
ফোন করে মেজর রশিদ । আইজিকে কথা বলিয়ে দেয় প্রেসিডেন্টের সাথে ।
আইজি নুরুজ্জামান বলেন, ‘স্যার, মোসলেউদ্দীন তো বন্দিদের গুলি করবার কথা বলছেন’
প্রেসিডেন্ট মোশতাকের জবাব, ‘সে যা বলছে – তাই হবে । ’
১নং সেলে এনে হত্যা করা হয় বাংলার জাতীয় চার নেতাকে ।
অথচ মোশতাকবাহিনীর যে ধারণার ওপর ভিত্তি করে তাঁদের হত্যা করা হল – তা ছিল সম্পূর্ণ অমূলক ।
চার নেতা অথবা আওয়ামিলীগের কোন সংযোগই ছিল না এই অভূত্থানের ।
খালেদ মোশাররফ কেবলমাত্র চেয়েছিলেন চেইন অব কমান্ড ঠিক করতে ।
*
নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন তাহের ।
সময় হয়েছে এবার একটা অ্যাকশনে নামার ।
মিটিঙ-এ বসেন কর্ণেল তাহের – জাসদের নেতাদের সাথে ।
অনেক বাকবিতন্ডার পর তারা সকলেই একমত হন একটি বিপ্লবের ।
‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ জাসদের একটি অংগসংগঠন হলেও এই বিপ্লব চালানোর মত যথেষ্টই শক্তিশালী ।
তারওপর সাধারণ সৈনিকরা যথেষ্টই ক্ষিপ্ত ।
অফিসাররা হুকুম করছেন – তারা তামিল করছে ।
মুজিব হত্যা – মোশতাক সরকারের টেকওভার – তারপর আবারও খালেদ মোশাররফের ক্যু ।
প্রতিটি ক্ষেত্রেই সৈনিকেরা হুকুম তামিল করে যাচ্ছেন ।
আউটুপুট নিচ্ছে অন্য কেউ – ঝুঁকি থাকছে সাধারণ সৈনিকদের মাথার ওপর ।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চান তারা ।
মাত্র কয়েকদিনে অনেক সৈনিক যোগ দিলেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সাথে ।
অফিসারদের ঠান্ডা করে পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার সুযোগ কর্ণেল তাহেরের মাঝেই দেখতে পায় তারা ।
প্রস্তুত হল একটি লিফলেট ।
লেখলেন ট্যাংক রেজমেন্টের হাবিলদার বারী এবং সুবেদার জালাল ।
ঐতিহাসিক সেই লিফলেটটি তুলে দিচ্ছি -
“সৈনিক ভাইয়েরা, আমরা আর ধনিক শ্রেণীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার হতে চাই না । নিগৃহীত , অধিকারবঞ্চিত সৈনিকরা আর কামানের খোরাক হইবে না । আসুন আমরা একটা অভ্যুত্থান ঘটাই । আমাদের এই অভ্যুত্থান শুধুমাত্র নেতৃত্বের পরিবর্তন করিবার জন্য হইবে না বরং এই অভ্যুত্থান হইবে সমাজের দরিদ্রশ্রেণির স্বার্থরক্ষার জন্য । এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়া আমরা ঔপন্যবেশিক আমলের রীতিনীতি বদলাইয়া ফেলিয়া সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী একটি বাহিনীতে পরিণত করিব ।
আমরা রাজবন্দীদের মুক্ত করিব । দুর্নীতিবাজদের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করিব । মনে রাখিবেন এখন সিপাই আর জনতার ভাগ্য এক । তাই সিপাই জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করিতে হইবে । সিপাই সিপাই ভাই ভাই সুতরাং সিপাইদের ঐক্যবদ্ধভাবে অফিসারদের এই ক্ষমতার লড়াইকে রুখিয়া দাঁড়াইতে হইবে ।
যদি অফিসাররা নির্দেশ দেয় আরেক সৈনিক ভায়ের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরিবার তাহা হইলে আপনারা বন্দুক ধরিবেন না । আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ করি । ”
ক্যান্টনমেন্টেও কৌশলে যথেষ্ট পরিমাণ লিফলেট বিলি করা হল ।
কর্ণেল তাহের আরও কিছুদিন সময় চাচ্ছিলেন । কিন্তু ৬ই নভেম্বরে খালেদ মোশাররফ টের পেয়ে যান কিছু একটা চলছে ।
সৈনিকদের বিভিন্ন জেলায় বদলি করে দিতে থাকেন তিনি ।
বিপ্লবী সীনিক সংস্থার নেতাদের গ্রেপ্তার করেন ।
বাধ্য হয়ে ৭ই নভেম্বর-ই অভ্যুত্থানের দিন ঠিক করেন কর্ণেল তাহের ।
*
অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতায় কাওকে বসাতে হবে ।
খালেদ মোশাররফের মত তালগোল পাকানো অভ্যুত্থানে বিশ্বাসী নন তাহের ।
তবে এই মুহূর্তে জাসদকে জনতা মেনে নেবে না ।
কাজেই সিপাই এবং জনগণ সমর্থন করবে – এমন মধ্যবর্তী অরাজনৈতিক কাওকে ক্ষমতায় বসাতে হবে – আবার যাতে পরিস্থিতি জাসদেরও কন্ট্রোলে থাকে ।
তাহের সাজেস্ট করেন মেজর জেনারেল (অবঃ) জিয়াউর রহমানের কথা ।
তিনি ন্যাশনালিস্ট , সৎ - তার ওপর মুক্তিযুদ্ধের অবদান – স্বাধীনতার ঘোষণা – এসবের কারণে জনতার চোখে তিনিই হিরো । তাছাড়া আগে জিয়াউর রহমানের সাথে কথাও হয়েছে তাঁর এ ব্যাপারে ।
এবং তিনি তাহেরকে সাপোর্টই দিয়েছেন ।
তাছাড়া বিপ্লবের পরিকল্পনায় সপষ্টতই জিয়াকে বের করে এনে তাহেরের সাথে দেখা করানোর কথা । ক্যানটনমেন্টের বাইরে থাকলে জিয়া এমনিতেই পায়ের নিচে মাটি পাবেন না । তাছাড়া তার প্রাণরক্ষার ব্যাপারটাও থাকছে । কাজেই জিয়া পরবর্তীতে সমর্থন দিতে বাধ্য থাকবেন ।
পার্টি তাত্ত্বিক সিরাজুদ্দীন আলম খান অনুমোদন করেন এ প্রস্তাব ।
তবে ক্যান্টনমেন্ট দখলের পর স্লোগান দেয়ার ব্যাপারে জাসদ কর্মী বা কর্ণেল তাহেরের নাম না বলে জিয়ার নামে স্লোগান দিতে বলা হয় । জনগণের মনে নতুন কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে পাবলিক সেন্টিমেন্ট ঘুরে যাক – সেটা চাননি কর্ণেল তাহের ।
*
প্রায় নিঁখুত ভাবে সৈনিকদের এই অভ্যুত্থান সংঘটিত হল ।
খালেদ মোশাররফের বাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করা হল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ।
শুধুমাত্র বের করে আনা গেল না জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ।
সেখানে গিয়েই বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট এবং জিয়াকে সেনাবাহিনী প্রধান করার নির্দেশ দেন তাহের ।
যা বাস্তবায়িত হয় অবিলম্বে ।
কিন্তু, ক্যান্টনমেন্টে পায়ের তলায় জিয়া ঠিকই মাটি পেলেন ।
এবং মাত্র কয়েকদিনে এত বছরের পরিকল্পনার কর্ণেল তাহেরের অভ্যুত্থান আলতো করে নিয়ে নিলেন নিজের কব্জায় – নিজের কন্ট্রোলে ।
সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে চলল জাসদের কর্মীদের ।
তাহের পলাতক থাকেন । সেই তাহের – যিনি জিয়াকে তার চরম ক্রান্তিকালে বের করে এনে নতুন জীবনে দেন – সেই তাহেরই জিয়ার হাত থেকে প্রাণরক্ষার জন্য থাকেন পলাতক ।
তাহেরকে গ্রেপ্তার করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে চলল জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ।
অবশেষে ফুপুর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ৭ই নভেম্বরের সংহতি দিবসের নায়ক কর্ণেল তাহেরকে ।
*
কর্ণেল তাহেরের স্বপ্ন ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক দলের ।
সেই স্বপ্নের জোরেই এতবড় একটি আন্দোলন এবং জিয়াউর রহমানের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা ।
তবে জিয়াউর রহমান তাহেরের পথ ধরে হাঁটছিলেন না ।
ঘটনাচক্রে তাহের এমন এক অবস্থানে যা তাকে করে দিয়েছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ।
তাহের এমন একজন মানুষ যাকে আবার দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলার কোনই উপায় নেই ।
তাঁকে জেলে আটকে রাখার মত ভুল করলে একদিন জেল থেকে তাহের বেরুবেন – তখন ঠিকই আরেকটি আন্দোলনের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিজের দিকে নিয়ে নিবেন ।
কাজেই – তাহেরের জন্য এক বিশেষ ট্রাইবুনালের ব্যাবস্থা করা হল ।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না – এবং রুদ্ধদ্বার এই বিচারের কোন তথ্য বাইরে প্রকাশ শাস্তিযোগ্য অপরাধ ।
আইনজীবিদের শপথ করানো হয় ৭ বছর সময়ের মাঝে এই আদালতের সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে – নাহলে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ।
তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগঃ
১।
বৈধ সরকারকে উৎখাতের অপচেষ্টা ।
২। সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি । প্রথমতঃ হাস্যকর ব্যাপার হল – বৈধ সরকার ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার । তার থেকে বেআইনীভাবে ক্ষমতা দখল করে খন্দকার মোশতাক এবং তার থেকে ক্ষমতার দন্ড সরিয়ে নেন খালেদ মোশাররফ সেখান থেকে তাহের কোন বৈধ সরকারকে উৎখাত করলেন সেটাই রহস্য !!!
দ্বিতীয়তঃ সেনাবাহিনীতে বিশৃংখল সৃষ্টির এই ঘটনার সম্পূর্ণ সমর্থন জিয়াউর রহমান দিয়েছিলেন ।
যার সুবিধাভোগ করেই আজ তিনি তাহেরকে গ্রেপ্তার করার মত স্থানে আছেন । এবং এই জিয়াউর রহমানই ৭ই নভেম্বরকে ‘জাতীয় সংহতি দিবস’ ঘোষণা করেছেন । একই ঘটনা কি করে একই সাথে বিশৃংখলা আর সংহতি দিবস হয় ?
*
রায় হল ১৭ই জুলাই ।
অভিযুক্ত জাসদ কর্মীদের একেকজনকে একেক শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয় ।
শুধুমাত্র মেজর এম জলীল আর আবু ইউসুফের বেলায় রায় হয় মৃত্যুদন্ড ।
তবে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য তা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং সমস্ত সপত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় ।
‘অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল আবু তাহেরকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হল’
লক্ষ্য করুন – জিয়াউর রহমানকে উদ্ধার করে আনা কাজের ভুইয়া অভিযোগ বাদই দিলাম । বীর বিক্রম মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুদন্ড থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায় – অথচ জীবিত সর্বোচ্চ খেতাব বীর উত্তম প্রাপ্ত এবং একই সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে যেই মুক্তিযোদ্ধার পা হারিয়েছে তাকে মৃত্যুদন্ডই দিতে হল ।
দৃশ্যপট থেকে তাহের সরে যাক – এবং সরে যাক চিরতরে – চেয়েছিলেন জিয়া ।
রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে চান তাহেরের আইনজীবি ।
তাহের বলেন, ‘না, রাষ্ট্রপতির কাছে কোন আবেদন করবেন না । এ রাষ্ট্রপতিকে আমিই ক্ষমতায় বসিয়েছি । এই বিশ্বাসঘাতকের কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইতে পারি না । ’
*
২০ জুলাই , ভোর চারটা এক ।
ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়ে গেলেন জাতীয় সংহতি দিবসের নায়ক কর্ণেল তাহের ।
‘জন্মেছি সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে
কাঁপিয়েই গেলাম
জন্মেছি তাদের বুজে পদচিহ্ন আকব বলে
এঁকেই গেলাম
জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করব বলে
করেই গেলাম
জন্ম আর মৃত্যুর দুটো বিশাল পাথর
রেখে গেলাম
সেই পাথরের নিচে শোষক আর শাসকের
কবর দিলাম
পৃথিবী
এবারের মত অবশেষে বিদায় নিলাম’
‘অলরাইট । গো এহেড । ডু ইওর ডিউটি । আই অ্যাম রেডি । ’
গলায় ফাঁসির দড়ি তুলে নেন ক্রাচে ভর করে হেঁটে চলা কিংবদন্তি কর্ণেল তাহের ।
‘বিদায় বাংলাদেশ । বিদায় দেশবাসী । ’ কর্ণেল তাহেরের শেষ দুটো বাক্য ।
*
আমার নিজস্ব মতামতঃ
আমি বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র সমর্থন করি না । আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে ক্যাপিটালিস্ট সমাজ হয়ত ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে যাবে ।
কিন্তু সমাজতন্ত্রে এই দেশের মানুষই ক্ষমতায় গেলে ধ্বংস হয়ে যাবে বাংলাদেশ নিসন্দেহে । এর ব্যাখ্যা হয়ত অন্য কোন দিন আমি দেব ।
কর্ণেল তাহের যেহেতু ৭ই নভেম্বরের জাতীয় সংহতি দিবসের নেতা – তাঁর দিক থেকে লেখতে গিয়ে অনেকটা সমাজতন্ত্রের পক্ষে বলা কথা মনে হতে পারে । তাই শেষে এ কথাগুলো না বলে পারলাম না ।
এবং কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে আমার দৃষ্টিভঙ্গির আকাশ-পাতাল তফাত থাকলেও – তাঁর ব্যক্তিত্ব কেড়ে নিয়েছে আমার শ্রদ্ধা ।
স্যালুট টু হিম ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।